পুঁজির
উন্নয়ন সমাজের স্বার্থ দেখে না, দেখে মুনাফা। পুঁজির বাজারে টেকসই উন্নয়ন
সম্ভব নয়। ‘টেকসই’ কথাটিকে পুঁজি ব্যবহার করে মুনাফাকে বুঝাতে। পরিবেশ
বিকাশে উদ্যোগিরা টেকসই কথাটিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন প্রাকৃতিক ব্যবস্থাদি,
জলাভূমি, বনভূমি সংরক্ষণ, বাতাসের বিশুদ্ধতা ইত্যাদি বুঝাতে। দু এর মধ্যে
দ্বন্ধ আছে। কোন উন্নত পুঁজির দেশেও সার্বিক পরিবেশ বাস্তবায়নে, নগর ও
সামাজিক পরিকল্পনায় নিযুক্ত হওয়ার মত কোন রাষ্ট্রীয় এজেন্সি বা কর্পোরেট
ভিত্তিক পরিকল্পনা ব্যবস্থার অস্তিত্ব নাই। কোন প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর
মধ্যে রূপান্তরিত হওয়া দুরে থাক, একটি উন্নত পরিবেশ বিকাশের ধারনাটিও তারা
কোন বাস্তবতায় আনতে পারেনি। জগত সম্পর্কিত মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও
চিন্তারীতির পূর্ণবিন্যাস না হলে সামগ্রিক বিনষ্ট পরিবেশ উন্নয়নে বাস্তব
পদক্ষেপ নেয়া যায় না।
উন্নত দেশগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার
মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় কমিয়ে আনতে পেরেছে। মরুভূমির দেশ হিসাবে পরিচিত
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ কৃত্রিমভাবে শহরে সবুজায়ন ঘটিয়েছে। জেদ্দা,
দোহা, দুবাই এ সব শহরে নতুন রাস্তা তৈরির সময় মাটি ও পানি সংকট সত্বেও
বিশেষ ব্যবস্থায় একইসঙ্গে রাস্তার পাশে গাছ ও ঘাস লাগানো হচ্ছে, যাতে
উষ্ণতা প্রতিরোধ করা যায়। দেশে দেশে দাবানলের কারনে ইউরোপ আমেরিকায় প্রায়ই
বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। ২০২২ সালে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজনের একটা অংশ
পুড়ে গেছে বা পুড়া হয়েছে। গত মে মাসে সংঘটিত আগুনে সুন্দরবনের কিছুটা হলেও
ক্ষতি হয়েছে যাতে সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন ছিল।
বুড়িগঙ্গাকে দুষণমুক্ত
করতে হাজারীবাগের টেনারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর হয়েছে, যেহেতু
বুড়িগঙ্গার দূষণ চরম মাত্রায় পৌছেছিল। কিন্তু এখন হেমায়েতপুর থেকে সিঙ্গাইর
হয়ে মানিকগঞ্জ গেলে দেখতে পারেন কিভাবে নদীর পানি দুষিত হয়েছে। নদী আর
রাস্তার দুপাশে বা খালের দুপাশে গাছের বাতাস উপভোগ করা যায় কিন্তু টেনারির
বর্জ্যে ভরা পানি দেখলে বা তার দুগর্ন্ধ আপনাকে করবে বিরক্ত। এচিত্র শুধু
গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ বা সাভারে নয় শহর, গ্রাম- যেখানেই শিল্পায়ন হচ্ছে
সেখানেই এ চিত্র। রাজধানী ও আশপাশের এলাকার পানি সংগ্রহ করে দেখা গেছে সে
পানিতে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি ও উদরাময় করে এমন
ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। এ ব্যাকটেরিয়া প্রজননক্ষমতা হ্রাস, ভ্রুনের বৃদ্ধি
ও থাইরয়েড হরমোন ফাংশনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া মানুষের রোগ
প্রতিরোধ ক্ষমতাও হ্রাস পায়। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে বাংলাদেশ একেবারেই নীরব।
এখানে শিল্পোক্তারা নতুন নতুন শিল্প তৈরি করেন কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় তাঁরা
বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর কর্মসংস্থানে ভূমিকা
রাখছেন, সুতরাং পরিবেশ একটু আধটু ক্ষতি মেনেই নিতে হবে। অথচ একটি
শিল্পকারখানা চালু করার আগে পরিবেশের ক্ষতি না করার অঙ্গীকারসহ অন্যান্য
ব্যবস্থাদি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সার্টিফিকেট নিতে হয়। অনেক শিল্প
প্রতিষ্ঠানের পানি পরিশোধন না করেই প্রাকৃতিক জলাশয়ে সরাসরি ফেলা হচ্ছে।
অথচ প্রতিটি কারখানাতেই নিজস্ব ইটিপি থাকার কথা।
যত্রতত্র ময়লা ফেলার
অভ্যাস থেকে আমরা দুরে সরে আসতে পারছিনা। প্লাষ্টিক ও পলিথিন বর্জ্যরে
বিপর্যয়ে সারাদশে নিমজ্জিত ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায় ঢাকায় বছরে ৬৪৬
টন প্লাষ্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে রিসাইক্লিং হয় মাত্র এক তৃতিয়াংশ
(প্রায় ৩৭ শতাংশ)। এ বর্জ্যরে পরিমাণ দিন দিন আরও বাড়বে বলে সবার ধারনা।
নৌযান থেকে যত্রতত্র প্লাষ্টিক ফেলায় নদীর তলদেশেও প্লাষ্টিক জমা হচ্ছে যা
জমা হতে থাকলে ভবিষ্যতে এক মহাবিপর্যয় দেখা দিবে।
দেশে পরিবেশ দূষণের
একটি বড় কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাশয়, জলাধার (পুকুর, খাল-বিল) ভরাট, নদী
সংকোচন বা ভরাট, বৃক্ষ নিধন, পাহাড়-বন ধ্বংস, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা,
উন্নয়ন কর্মকান্ডে চলার পথে ধূলিবালি তথা বায়ুদূষণ, অপরিকল্পিতভাবে
ভগর্ভস্থ পানি উত্তোলন। যেখানে সেখানে ইটভাটা ও বায়ুদোষনের একটি প্রধান
কারণ। পার্বত্য জেলাগুলিও এর থেকে মুক্ত নয়। ইটভাটায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও
জেলা প্রশাসকের অনুমতি প্রয়োজন হয় যেথায় দূনীর্তি প্রধান অন্তরায়। সরকার
বর্তমানে ইটভাটার অনুমোদন বন্ধ করে দিয়েছে যা একটি মহৎ উদ্যোগ। কন্তিু ইটের
বদলে যে ব্লক ব্যবহার করা হয় তা ব্যবহারে উদ্যোগ নেয়া দরকার। সাইকেল
ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার কারণ একটি যাত্রীবাহী মোটরযান ৫
মেট্রিকটন কার্বন নিগর্মন করে কিন্তু সাইকেল ব্যবহারে শহরে ৬৭ শতাংশ কার্বন
নির্গমন কমানো সম্ভব। তাই সাইকেলের জন্য ফুটপাত নয় পৃথক লেন তৈরি করে
জনগণকে উৎসাহিত করা উচিত।
বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য মানুষের
কার্যকলাপই দায়ী। অতিমাত্রায় কার্বন নি:সরন, বৃক্ষনির্ধন, বন ধ্বংস আর
অপরিকল্পিত নগরায়নের কারনেই এ উষ্ণতা। তবে উন্নত বিশে^ অনেক ইতিবাচক
উদ্যোগের ফলে পরিস্থিতির অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। গত এক শতকে পৃথিবীর
তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। যা জলবায়ু পরিবর্তনে
নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। পরিসংখ্যানে জানা গেছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন,
পৃথিবীব্যাপী ৫৫ শতাংশের বেশী কার্বন নি:সরন করে। দেশে এবছর এপ্রিল-মে
মাসে অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ ঘটেছে আর পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে সর্বোচ্চ
তাপমাত্রা মরুভূমির দেশকেও ছাড়িয়ে ৫৩ ডিগ্রীতে পৌছেছে। পরিবেশ রক্ষায়
বিকল্প জ¦ালানী যেমন, সৌর, বায়ু বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তম। বিকল্প
হিসাবে বিদ্যুত চালিত যানবাহন ব্যবহার শুরু করতে হবে।
উন্নয়ন আর সভ্যতা
সমবেগে চলে। তাই বলে উন্নয়নের জন্য পরিবেশ দুষণ বাড়িয়ে নাগরিক
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও চলাচল বিঘ্নতা মেনে নেয়া যায় না। ট্রাডিশনেলি ঢাকা ও বড়
বড় শহরে সেবা সংস্থাগুলির সেবা কার্যক্রম রক্ষায় রাস্তাগুলি খোঁড়াখুঁড়ির
কারনে পরিবেশ দোষন ঘটে। জনদূর্ভোগ সারা বছরই লেগে থাকে। উন্নত দেশগুলিতে
সারা বছরই উন্নয়ন কার্যক্রম চলে কিন্তু সাধারণ জনগোষ্ঠির কোন দূর্ভোগ ঘটে
না। জনবহুল শহরে উন্নয়ন কাজ রাতে চলে। সেসব দেশের কর্মকাণ্ড অনুসরন করে
আমাদের জনদূর্ভোগ হ্রাস করতে হবে। সামগ্রিক দোষণ বন্ধ রেখে একটি বাসযোগ্য
পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনে সবচে বেশি প্রয়োজন নাগরিক সচেতনতা। সেই জন্য সকলেই
তার নিজস্ব অবস্থান থেকে জাগ্রত হওয়া দরকার। সেখানেই চাই সামাজিক অঙ্গীকার
আর প্রতিবেশ পরিবেশ রক্ষাকারী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় সফল উদ্যোগ।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ