একটা
দেশের সংবিধান হচ্ছে সেই দেশের ভিত্তিমূল। সংবিধান সংশোধনের নামে দলীয়করণ
করেছে প্রতিটি সরকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে মৌলিক অধিকারের ওপরও জোর
দেওয়া প্রয়োজন। সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজন ভিন্নমত, ভিন্নধর্মের সবার
অংশগ্রহণ। রাজনীতি, সুশাসন, আইনের শাসন আনতে হলে ভবিষ্যতে সংবিধান
পুনর্লিখন প্রয়োজন।...
বাংলাদেশ বহুজাতিক গণতান্ত্রিক একটি দেশ।
গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখা, একই সঙ্গে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের জন্য সংস্কার
প্রয়োজন। বর্তমান সংবিধান ১৯৭১-এর পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল। তারপর এটি
বারে বারেই পরিবর্তিত হয়েছে। যে আইন করা হয়েছিল শাসকশ্রেণির শোষণের জন্য,
সেই আইন এখনো কীভাবে বিদ্যমান থাকে? প্রশাসনকে যদি কিনে ফেলা যায়, তা হলে
গণতন্ত্র কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে? ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করা না
গেলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। সংবিধান বাতিলের মধ্যে গেলে ১০-২০ বছর
পরে তা আবারও বাতিল হবে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার আবশ্যক মনে হয়।
আমাদের ছাত্ররা কোটা সংস্কার নিয়ে একটি আন্দোলন করেছে।
এই আন্দোলন
কোনো রাজনৈতিক দলের ছিল না। তবুও এদের পেছনে লাখ লাখ মানুষ দাঁড়িয়ে
গিয়েছিল। এটি রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের জন্য একটি শিক্ষা। মানুষের মনের
কথা, তাদের মনের ভাষা অর্থাৎ জনগণের পালসটা আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের মনে
রাখতে হবে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি বাড়ি-গাড়ি, অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তির
জন্য নয়। তখন আমাদের ভাবনায় একটি কথাই ছিল- বাঁচতে হবে এবং বাঁচতে হলে
মারতে হবে। সম্মুখসমরে যারা যুদ্ধ করেছেন, তারা সার্টিফিকেটের জন্য যুদ্ধ
করেননি। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে ছিলেন, দেশে ফিরে আসার পর তারাই আগে
মুক্তিযোদ্ধা খেতাব নিয়েছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা খেতাবের পেছনে, এমনকি
মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সাধারণ নাগরিক কোনো উপাধি নেননি। পুরো
প্রক্রিয়াটিতেই ঘাপলা আছে, যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই পরিবর্তনশীল।
আমরা
একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম। '৭১-এর পর সংবিধান রচনায় যে ধরনের আলোচনা
হয়েছিল, তা থেকে আমরা দিকনির্দেশনা পেতে পারি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে
সংবিধানের পরিবর্তন হয়েছে। সংবিধান এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে, যেখানে
ব্যক্তিস্বার্থ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ ব্যক্তির হাতে অর্থাৎ
প্রধানমন্ত্রীর হাতে অবাধ ক্ষমতা থাকায় দলীয়, রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে
একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী
হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে সংবিধান সংস্কার নয়, পুনর্লিখন প্রয়োজন।
নতুনভাবে
কোনো দল ক্ষমতায় এসে সংবিধানে নিজেদের মতো পরিবর্তন করতে না পারে।
সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
নিশ্চিত করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে সংখ্যাগুরুর অত্যাচার বন্ধের উপায় খুঁজে
বের করতে হবে। সংবিধান পরিশীলনে জনগণের মতের প্রতিফলন আদৌ হচ্ছে কি না,
এটাও দেখা প্রয়োজন আছে। বেশকিছু অনুচ্ছেদ বিবেচনা করে সংবিধানে সংশোধন করতে
হবে। আদর্শিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো থেকে জনগণের সদিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
১৯৭১-এর প্রেক্ষাপট থেকে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংবিধানে নতুনত্ব আনতে
হবে। সব প্রতিষ্ঠানকে বিগত সরকার এমনভাবে ধ্বংস করে গেছে যে
ব্যক্তিপর্যায়েও স্বৈরাচারী আচরণ শুরু হয়েছে, এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
একটা
দেশের সংবিধান হচ্ছে সেই দেশের ভিত্তিমূল। দেশের সার্বভৌমত্ব জনগণের, যার
প্রতিফলন আমরা দেখিনি। মৌলিক অধিকার, সমতার কথা বলা থাকলেও তা বাস্তবায়নের
কথা সংবিধানে বলা নেই। নানারকম রাজনৈতিক বৈষম্যের কারণে পিছিয়ে পড়া
মানুষদের কথা তুলে আনতে হবে। সংবিধান সংশোধনের নামে দলীয়করণ করেছে প্রতিটি
সরকার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে মৌলিক অধিকারের ওপরও জোর দেওয়া
প্রয়োজন। সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজন ভিন্নমত, ভিন্নধর্মের সবার
অংশগ্রহণ। দেশ ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তা থেকে উত্তরণের জন্য
সংবিধান সংস্কার জরুরি। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম আমাদের দেশের রাজনৈতিক,
প্রশাসনিক কোনো ব্যক্তিকেই ভরসা করতে পারেন না। তারা মনে করেন যে এই
প্রজন্মের মানুষ ক্ষমতা পেলেই লুটপাট করবে। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার যে
ভঙ্গুর অবস্থা, তা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ,
সুশীল সমাজ যদি সংবিধান সংশোধনে এগিয়ে আসে- তাদের উচিত হবে দ্রুত সময়ে কাজ
করা।
যে আন্দোলন হয়েছে তা ছিল প্রথমত কোটাবিরোধী আন্দোলন, সমাজ
পরিবর্তনের আন্দোলন নয়। তবে পরিবর্তন সবাই চায়, পরিবর্তন হওয়া উচিত।
দারিদ্র্যের জন্য গণতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করতে পারছে না বিশাল জনগোষ্ঠী।
শ্রেণি বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে, গণতন্ত্রের ফল আস্বাদন করতে
হলে সংশোধন জরুরি। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনে সদিচ্ছার প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দেওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ আসবে, তা যেন
জনগণের মতের প্রতিফলন সংবিধানে নিয়ে আসে। সংবিধানের সংশোধন না করে
একনায়কত্বকে প্রতিরোধ করা যাবে না। সংবিধান সংস্কারের দায়িত্ব সবারই।
অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে সংবিধান সংশোধনের। মৌলিক কাঠামো
পরিবর্তন না করেই সংবিধান সংশোধনযোগ্য করা সম্ভব।
তরুণ প্রজন্ম, জনগণের
আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক দলের সুপারিশগুলো নিয়ে সরকারের কাজ করা প্রয়োজন। নতুন
সংবিধানে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয়
বিভিন্ন গোত্রের জনগোষ্ঠী সবারই অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের
সংবিধান থেকে শিক্ষা নিয়ে সব জাতিগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দেশে
গণতন্ত্রের পুনর্গঠন সম্ভব। বর্তমান সংবিধানে জাতিগত নিরপেক্ষতা নেই, যা
অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সর্বদাই প্রশ্নের সম্মুখীন। সারা বিশ্বের বিচার
বিভাগ নাগরিকদের অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠান, আর বাংলাদেশের বিচার বিভাগ
অধিকার হরণের প্রতিষ্ঠান।
ইতিহাস বিকৃত করে সংবিধানকে হাতিয়ার বানানো
হয়েছে। সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ যেহেতু সংশোধনের কোনো উপায় নেই, তাই সংবিধান
পুনর্লিখন প্রশ্নের বিষয়। আদালত সংবিধান সংশোধন করতে পারে না, ব্যাখ্যা
দিতে পারে। আইনজীবীরা কেউ চ্যালেঞ্জ না করায় আইন মন্ত্রণালয় থেকে সংবিধান
বারংবার সংশোধিত হয়ে এসেছে। এমনভাবে সংবিধানকে পরিবর্তন করা হয়েছে যে, এখন
আর এটি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন করে না। ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ইচ্ছার প্রতিফলন
দেখতে পাই। রাজনীতি, সুশাসন, আইনের শাসন আনতে হলে ভবিষ্যতে সংবিধান
পুনর্লিখন প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতাসীন দলগুলোর কাছে সংবিধান কুক্ষিগত
ছিল। সাবেক সরকার যে ক্ষমতাগুলো ভোগ করেছে তা সাংবিধানিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত।
কোনো কিছু করতে গেলেই সংবিধানবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী কাজ হিসেবে বলা হয়ে
থাকে। এই ভয় নাগরিকদের কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন। কাজেই শুধু সংস্কার নয়,
গণতন্ত্র পুনর্গঠনের মাধ্যমে দেশ গঠনের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।
লেখক: সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী