উচ্চমাধ্যমিক
পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবে আগামী ১৫ অক্টোবর। এরপর শুরু হবে প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধের
প্রস্তুতি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় উচ্চশিক্ষার
সুযোগ সবার জন্য একই রকম নয়। এ কারণে প্রতি বছর যত সংখ্যক শিক্ষার্থী
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে, সব শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়,
মেডিকেল কলেজও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই। এই
পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন সংখ্যা সীমিত হওয়ায় ভর্তি পরীক্ষার
ব্যবস্থা করে থাকে।
একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ধরন একেক রকম।
ফলে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি চরম রূপ ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি পরীক্ষা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। পরীক্ষার সময় দেশের বিভিন্ন
প্রান্তে বসবাসরত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পরীক্ষার প্রস্তুতি, আর্থিক,
মানসিক, শারীরিক, ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন দিক থেকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এতে অতিষ্ঠ হয়ে বর্তমানে ভর্তি পরীক্ষা না বলে কেউ কেউ ভর্তি যুদ্ধ
বলছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ভর্তি-ইচ্ছুক হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও
তাদের অভিভাবকদের লাগামহীন দুর্ভোগের বিষয় বিবেচনা করে এর একটা
গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রয়োজন।
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা
পদ্ধতি কিছুটা ভয় ভীতির। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হওয়ায়
প্রতিযোগিতা দিন দিন বাড়ছে। ফলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকলেও সবাই
পাশ করে না বা প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল অর্জিত হয় না। অনেক শিক্ষার্থী
কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কাক্সিক্ষত বিষয়ে ভর্তি হতে পারে না। এছাড়া
একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য একই বিশ্ববিদ্যালয়েই
একাধিক অনুষদে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় । শুধু তা-ই নয়, দেশের বিভিন্ন পালিক
বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। এমনকি একই দিনে বা এক দিনের
ব্যবধানে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
ফলে
ইচ্ছা থাকলেও সব শিক্ষার্থীর পক্ষে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়
অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। আর্থিক, শারীরিক ও মানসিক দুর্ভোগের পাশাপাশি
এখানে ছাত্রীদের জন্য রয়েছে বাড়তি ঝুঁকি । সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে
অনুসরণ করে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি পরীক্ষা বিভাগীয়
শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া শুরু করেছে। আবার গত কয়েক বছর ধরে অনেকগুলো
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে ভোগান্তি কিছুটা হ্রাস
করেছে।
কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার সম্ভাব্য ঝুঁকি এড়ানোর নামে ভর্তি
পরীক্ষার সময় হলগুলো বন্ধ রাখে । কিন্তু ছাত্রীদের জন্য এই ব্যাপারটি
অত্যন্ত কঠিন। কারণ তাদের সব দুর্ভোগের পাশাপাশি দেশে বিরাজমান নারী
হয়রানির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। যেখানে-সেখানে গিয়ে তারা থাকতে পারে না
এবং যে কারো সঙ্গে তাদের বাড়ি থেকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য যেতেও
দেওয়া যায় না। অনেক পরিবারে বাবা বা ভাই থাকে না, আবার বাবা থাকলেও তাঁরা
হয়তো কেউ চাকরি করেন, কেউ ব্যবসা করেন, কেউ অসুস্থ এমন নানান সমস্যা থাকে।
মা,
বাবা, ভাই, বোন সবাইকে যে পরিমাণে মানসিক এবং আর্থিক দুর্ভোগের মধ্যে
পড়তে হয়, তা দেখে মনে হয় বর্তমান প্রযুক্তির যুগে আমরা যেন হাজার হাজার
শিক্ষার্থীকে চরম ভোগান্তির মধ্যে আবদ্ধ রেখেছি। যদিও তা ইচ্ছাকৃত নয়, তবে
অবশ্যই তা পরিকল্পনা পদ্ধতিগত কারণে সৃষ্ট। বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা
মেডিকেল কলেজের মত নেওয়া যেতে পারে এক্ষেত্রে ইউনিট ভিত্তিক আলাদা ব্যবস্থা
করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি চান, আন্তরিকভাবে চিন্তা
করেন, সরকার যদি উদ্যোগ নেন তবে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার
পরিবর্তন সম্ভব। প্রথাগত পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে সরে পরিস্থিতি বিবেচনা
সাপেক্ষে পরিবর্তন আনয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শিক্ষকগণ আন্তরিক হতে
হবে।
যেহেতু প্রথাগত ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসার উদাহরণ ইতিমধ্যে
সৃষ্টি হয়েছে, শিক্ষার্থী-অভিভাবকের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে সেটিকে আরো
সহজ করাও সম্ভব। পরিবর্তিত পরীক্ষা পদ্ধতি যেমন গুচ্ছ পদ্ধতিতে কিছু
সমস্যার কথা জানা গেছে: যেমন, ইউনিট বা বিষয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে
শিক্ষার্থীদের আর্থিক বোঝাসহ অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এই
সীমাবদ্ধতাগুলো মাথায় রেখে সামনে আরো শিক্ষার্থীবান্ধব পরীক্ষার আয়োজন করতে
হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যুগোপযোগী পরিকল্পনার মাধ্যমে ভর্তি
পরীক্ষা পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন দরকার। যে পরিবর্তনের মাধ্যমে ভর্তি-ইচ্ছুক
শিক্ষার্থীদের ও পরিবারবর্গের অনেক দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব। সঠিক
পরিকল্পনায় সমন্বিত পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সারা দেশের সকল পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে সহজতর করা যেতে পারে।
প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজসমূহ যদি এটি করতে সক্ষম হয়, বাংলাদেশের
অন্যন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পারবে নিঃসন্দেহে। ভর্তি-ইচ্ছুকদের
ভোগান্তি দূর করে কীভারে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিকে আরো কার্যকর ও বিজ্ঞান
ভিত্তিক করা যায় এ ভাবনার সময় এসেছে। যে পদ্ধতিতে সত্যিকার অর্থে
শিক্ষার্থীদের মেধা, মননশীলতা এবং একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকটি
যথাযথভাবে যাচাই এমন একিিট ব্যবস্থা গ্রহন করা যেতে পারে।
তাছাড়া
পরীক্ষা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনা জরুরি। আমার ধারনা এমসিকিউ নির্ভর পরীক্ষার
মাধ্যমে সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থী নির্বাচন করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে
কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আসন সংখ্যা যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি
করা যেতে পারে। তবে অবশ্য সেখানে আগেই শ্রেনি কক্ষও শিক্ষকের ব্যবস্থা করে
নিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার মান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের
সুসম্পর্কের লক্ষ্যে অনুপাত বিবেচনায় রাখতে হবে, যাতে একজন শিক্ষক তার
ক্লাসের সব শিক্ষার্থীকে চেনা-জানার সুযোগ পান।
কেবল শিক্ষার্থী বা তার
পরিবার নয়, ভর্তি পরীক্ষার সময় সারা দেশের পরিবহন, যানজট, নিরাপত্তাসহ
নানামুখী সংকট দেখা দেয়। শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
বিদ্যমান অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। কীভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
শিক্ষার্থীবান্ধব করে গড়ে তোলা যায়, সেদিকে আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে।
বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে দেশ
জাতি ও পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা লাভবান হবে। আলাদা কমিশন অথবা কমিটি করে
জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সংস্কার
প্রয়োজন।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।