৩০শে জানুয়ারী
মহাত্মা গান্ধীর প্রয়াণ দিবস। তিন দশক আগে এই দিনে আমি দিল্লীতে ছিলাম।
গিয়েছিলাম রাজঘাটে গান্ধীজীর সমাধিস্থলে। দিল্লীর জানুয়ারীর বিকেল - শীত
পড়েছিল বেশ। পড়ন্ত নরম রোদ ছিল রাজঘাটে - পাশের নদী থেকে বইছিল উত্তরের
ঠান্ডা বাতাস। সমাধি ঘিরে বসা নর-নারীর কণ্ঠে গুঞ্জিত হচ্ছিল, ‘রঘুপতি রাঘব
রাজারাম, পতিত পাবন সীতারাম’। চারদিকের আবহ একটি পবিত্র স্বর্গীয় পরিবেশের
সৃষ্টি করছিল। কোথাও কোন শব্দ নেই, কোন কথা নেই, শুধু মৃদুস্বরে ভেসে
আসছিলো,
রঘুপতি রাঘব রাজা রাম
পতিত পাবন সীতা রাম
ঈশ্বর আল্লাহ তেরহ নাম
সবকো সংমতী দে ভগবান
ঈশ্বর আল্লাহ তেরহ নাম
সবকো সংমতী দে ভগবান
রঘুপতি রাঘব রাজা রাম
পতিত পাবন সীতা রাম
কৈশোরে
নাস্তিক্যের প্রান্ত ছুঁয়ে পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধী (২ অক্টোবর ১৮৬৯ -
৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮) প্রবেশ করেছিলেন তীব্র আধ্যাত্মিক আকুলতায়। তবে যে-ভাবে
কোনো কোনো যোগী পুরুষ ঈশ্বরের সাক্ষাৎ দর্শন লাভ করেন বলে আমরা শুনেছি,
গান্ধীর জীবনে সে রকম অভিজ্ঞতার কথা জানা যায় না। এ বিষয়ে তাঁর দাবী ছিল
সংযত এবং বিনীত। “তাঁকে আমি দেখিনি, তাঁকে আমি জানি না; তাঁর প্রতি বিশ্বের
যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসকে আমি আপন করে নিয়েছি।” কথাগুলি পাই গান্ধীর
আত্মজীবনীতে।
ঈশ্বরের ব্যক্তিস্বরূপে তাঁর আস্থা ছিল কি না সে বিষয়ে
সন্দেহ আছে। যদিও তিনি মানুষের ভিতর ভগবানকে অনুভব করেছেন, তবু একথাও তিনি
বলেছেন, “ঈশ্বরকে আমি ব্যক্তিরূপে ভাবি না। আমি মনে করি, সত্যই ইশ্বর,
ঈশ্বর এবং তাঁর নিয়ম অভিন্ন। তিনি ও তাঁর নিয়ম সর্বত্র বিরাজ করছে এবং সব
কিছু চালিত করছে।” এসব বিষয়ে দুয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে অবশ্য কিছু প্রমাণ করা
কঠিন। একই ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এমন অনেক কথা বলেন যার নানা
অর্থ করা সম্ভব। তবু এ কথাটা ধরে নিলে ভুল হবে না যে, গান্ধীর কাছে ঈশ্বরের
অন্বেষণ মানেই হল ঈশ্বরের নিয়মের অন্বেষণ। তিনি চাননি শুধ এক মুহুর্তের
কোনো দৈবী অভিজ্ঞতা; তিনি চেয়েছিলেন সেই নিয়ম, সেই অন্যান্য পন্থা সম্বন্ধে
সম্যক বোধ, যার দ্বারা জীবনের সকল কর্মে চালিত হয়ো সম্ভব।
কী সেই
অন্যান্য পন্থা? গান্ধী এই প্রতীতিতে উপনীত হয়েছিলেন যে, ঈশ্বরের নিয়ম
মানেই প্রেমের নিয়ম, সত্যের আহ্বান। তিনি লিখেছিরেন, “এই প্রেমের বিধান
মানেই হল সত্যের বিধান।” তাঁর দৃষ্টিতে প্রেম এবং সত্য অভিন্ন। তবু সত্য
শব্দটিকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। কেন?
তিনি নিজেই তার ব্যাখ্যা দিয়ে
গেছেন। মানুষের ভাষায় প্রেম শব্দটির অর্থের হেরফের বড় বেশি। ঈশ্বর এবং তাঁর
নিয়ম বলতে নিঃসংশয়ে এমন কিছু বোঝায় যা সঙ্কীর্ণ নয়, সীমাবদ্ধ নয়। সত্য
শব্দটিতে সেই দ্যেতনা আছে। সত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তবে প্রেম পরম মহত্ত্ব
লাভ করে। সত্য থেকে যে-প্রেম বিচ্ছিন্ন তাতে সেই বিশুদ্ধতা নেই, আছে বন্ধন।
গান্ধীর পছন্দ ছিল ‘অহিংসা’ শব্দটি। ঐ শব্দটিতে পরিস্কার হয়ে ওঠে যে, কারো
প্রতি বিদ্বেষ থাকা চলবে না। প্রেমে এই ভাবটা যতো না পরিস্ফুট, অহিংসায়
আরো বেশি। ঐতিহ্যের গুণেই হোক, অথবা যে-কারণেই হোক, অহিংসার তেমন অর্থবিকার
ঘটেনি, ভাব প্রকাশের বাহন হিসেবে ঐ শব্দটি আরো নিরাপদ। গান্ধীর এই রকম মনে
হয়েছিল। যাই হোক, সঠিক ভাবটি প্রকাশ করাই হল উদ্দেশ্য। একবার যদি অর্থ
পরিস্কার হয় তারপর প্রেম, অহিংসা, সত্য সব নামই সমান। এর পরও প্রশ্ন উঠতে
পারে, সত্যের সঙ্গে ঈম্বরকে সমার্থক করা হল কেন? গান্ধীর অন্বিষ্ট ছিল সেই
সত্য যাতে জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা যায় আর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য
রেখে উপায় উধ।ভাবন করা সম্ভব হয়। যাকে আমরা জড় জগৎ বলে জানি তার নিয়ম নিয়ে
জীবনের পরম লক্ষ স্থির করা যায় না। যে অনুভূতির গভীরে সেই লক্ষ্যকে
উপলদ্ধি করা যায় সেইখানে যোগ ঈশ্বরের সঙ্গে গান্ধী সত্যের।
নিরীশ্বরবাদীদের
সঙ্গে গান্ধীর পার্থক্য এখান থেকেই বোঝা সহজ। গান্ধী তো ঈশ্বরের দর্শনলাভ
করেননি; নিরীশ্বরবাদীরা বলবেন, তবে আর ঈশ্বরের কথা টেনে আনা কেন? ঈশ্বরকে
বাদ দিলে থাকে প্রকৃতি। যে প্রেম প্রকৃতি থেকে সঞ্জাত, প্রকৃতির ষ্পর্শে সে
বার বার মলিন হয়ে যায়। গান্ধী একটা আদর্শ প্রেমের কথা বলছিলেন। তাকে কখনও
আমরা সম্পূর্ণ করে পাব না। তবু তাকেই আমরা লক্ষ্য বলে মেনে নেব। এটা যেন
দেহী মানুষের দেহকে অতিক্রম করে যাবার সংগ্রাম। আমরা কখনও সম্পূর্ণ জয়ী হতে
পারব না। তবু এই সংগ্রামেই মহত্ত্ব। সেই বিশুদ্ধ প্রেম, সেই সত্যকে,
গান্ধী নাম দিয়েছিলেন ঈশ্বর। যাঁকে তিনি কখনও সম্পূর্ণ দেখেননি, কিন্তু
যাঁকে তিনি জীবনের চেয়েও মূল্যবান বলে জেনেছেন। দুটি কথা একসঙ্গে মনে রাখতে
হবে। ঈশ্বরকে প্রেম থেকে আলাদা করে ভাবলে ঈশ্বরও হয়ে পড়েন শীতল, কঠিন,
প্রেরণাহীন। আবার প্রেমকে ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন করলে প্রেম হারায় তার শুদ্ধ
দিব্যতা।
গান্ধী বলছেন, জ্যামিতিতে এমন কিছু ধারণা আছে, যেমন বিন্দু,
যাকে ছোঁওয়া যায় না কিন্তু যা কাজে লাগে; ঈশ্বরও সেই রকমই। গান্ধীর
ঈশ্বর-ভাবনার একটা বৈশিষ্ট্য এই থেকে ভালোভাবে বোঝা যায়। গান্ধীর আগ্রহ ছিল
মূলত তত্ত্বে নয়, প্রয়োগে। ঈশ্বর অথবা ঈম্ভরের নিয়মকে গান্ধী জানতে
চেয়েছিলেন কোনো দার্শনিক সমস্যার সমাধানের জন্য নয়, বরং আমৃত্যু অনুশীলনের
ভিত্তি হিসেবে। দার্শনিকরা ব্যাখ্যা খুঁজেছেন; গান্ধী চেয়েছেন প্রয়োগ।
গান্ধী
জোর দিয়েছিলেন তত্ত্বকথার ওপর নয়, কর্মের ওপর। তিনি যে ঈশ্বরজ্ঞান
চেয়েছিলেন তাকে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে প্রয়োগ করতে আগ্রহী ছিলেন
নিজের জীবনে এবং সামাজিক ক্ষেত্রে। জ্ঞানই শক্তি, এই রকম যাঁরা বিশ্বাস
করে তাঁদের কাছে জ্ঞানের সার্থকতা তার নিজেরই ভিতর। অন্য একটা সুর ষ্পষ্ট
করে শোনা গেল আধুনিক যুগের শুরু থেকে। ফ্রান্সিস বেকন বললেন, জ্ঞানই শক্তি।
বিজ্ঞানের ফল প্রযুক্তি। বিজ্ঞান মানুষকে দেয় সেই ক্ষমতা যার দ্বারা
প্রকৃতিকে সে ইচ্ছামতো কাজে লাগাতে পারে গান্ধীর কাছেও জ্ঞান অথবা সত্যই
শক্তি। কিন্তু এ হল অন্য এক জ্ঞান, অন্য এক শক্তি। অবশ্য দেশের আধ্যাত্মিক
ক্ষেত্রে শক্তির কল্পনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর নির্ভর নতুন কথা নয় যোগ
এবং তন্ত্রে সেটা মুল কথা। কিন্তু যোগীরা অনেকেই চেয়েছেন ব্যক্তিগত মুক্তি।
গান্ধী তাঁর বোধিলদ্ধ শক্তিকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন মানুষের বৃহত্তর
সমাজে। বুদ্ধের সঙ্গে তাঁর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে গান্ধী যে যুগে কাজ
করেছেন, যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন, সে সবই
অন্যজাতীয়। কোনো পুবৃসুরীর সঙ্গে তাঁকে তুলনা করা কঠিন। যাকে তিনি সত্যের
নিয়ম বলেছেন, সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক সময়েই তাঁকে নতুন
পথ তৈরি করে নিতে হয়েছে। এজন্য নিজের জীবন নিয়ে তিনি করেছেন
পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এটা কিছু আকস্মিক নয়, যে তাঁর আত্মজীবনীর নামকরণ হল,
“সত্য নিয়ে আমার পরীক্ষা”। নিজে পরীক্ষা না করে আপ্তবাক্য গহ্রণ করবার
মানসিকতা গান্ধী ছিল না।
সব মানুষের ভিতরই একটা তেজ থাকে, শক্তি থাকে।
সাধারণত তাকে আমরা শুদ্ধরূপে পাই না, বহু অশুদ্ধ উপাদানের সঙ্গে মিশ্রিত
হয়ে প্রবাহিত হয় সেই শক্তি। কিন্তু তাকে অনুশীলনের ভিতর দিয়ে ক্রমে শুদ্ধ
করে নেওয়া যায়। এই শুদ্ধ তেজকেই গান্ধী বলছেন আত্মার শক্তি অথবা সত্যের
শক্তি। আবার একেই বলা যায় প্রেমের শক্তি। এটাই সঙ্কল্পের শক্তি হয়ে আমাদের
নিযুক্ত করতে পারে নানা কাজে। গান্ধী একে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন প্রধানত দুই
ধারায়; এক, গঠনমূলক কাজে; দ্বিতীয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে। গঠনমূলক
কাজের উদাহরণ পাওয়া যাবে শিক্ষায় এবং গ্রামসেবায়। এর উদ্দেশ্য সহযোগিতা এবং
আত্মনির্ভরতার ভিত্তি নির্মাণ। গঠনমূলক কাজ আর অন্যায়ের প্রতিরোধ, এ দুয়ের
ভিতর গান্ধীর দৃষ্টিতে একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। একটিকে বলা যেতে পারে অন্যটির
জন্য প্রস্তুতি। কিন্তু সে আলোচনায় এখন আমরা যাব না। অন্যায়ের প্রতিরোধের
জন্য গান্ধী যে পদ্ধতি সৃষ্টি করেন, সেটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। এই পদ্ধতির
নাম দেওয়া হয়েছে, সত্যাগ্রহ। অন্যায়ের প্রতিরোধের জন্য আত্মার শক্তিকে
সংগ্রহ ও প্রয়োগ করার করার পদ্ধতি সত্যাগ্রহ।
সত্যাগ্রহের একটি মূল কথা
হল অন্যায়ের সঙ্গে অসহযোগ। যদিও অন্যায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করাও অন্যায়, তবু
অন্যায়কারীর প্রতিও আমাদের ভালোবাসা রক্ষা করতে হবে। অহিংসার নিয়ম এই যে,
কারো প্রতি হিংসা করা চলবে না, অন্যায়কারীর প্রতিও নয়। এটা হঠাৎ অসম্ভব মনে
হতে পারে, আমরা সবাই কিন্তু এটা ছোটো সীমার ভিতর করে থাকি। মা যখন ছেলের
অন্যায়ের পথ রোধ খলৈ দাঁড়ান তখনও ভালোবাসা রক্ষা করেই প্রকাশ পায় তাঁর সেই
বিরোধিতা। আমরা যাদের যথার্থ ভালোবাসি তাদের প্রতি এই রকম আচরণই করে থাকি।
এটা মনুষ্যত্বের নীতি। ক্রোধকে অক্রোধের দ্বারা জয় করবার কথা যুদ্ধ বলেছেন।
খ্রীষ্টের প্রেমের বাণীর সঙ্গে আমরা পরিচিত। গান্ধীর বৈশিষ্ট্য এইখানে যে,
পরিবারের অথবা সম্প্রদায়ের ছোটো সীমা থেকে উদ্ধার করে তিনি সমাজের বৃহৎ
ক্ষেত্রে সেই নীতি প্রয়োগ করতে চেয়েছেন।
সত্যাগ্রহীর দৃষ্টিভঙ্গীতে
তিনটি মূল ধারণাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এক, অন্যায় আত্মনির্ভর নয়, সে
পরজীবী। দ্বিতীয়, কোনো মানুষই মানবতাশূন্য নয়। তৃতীয়, মানুষের নির্জীব
মানবতাকে জাগিয়ে তোলা যায় ত্যাগের ভিতর দিয়ে, স্বেচ্ছায় আঘাত গ্রহণের ভিতর
দিয়ে। এই কথাগুলির সামান্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
গান্ধী বলেছেন, ইচ্ছায়
অথবা অনিচছায় আমরা অন্যায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করি বলেই অন্যায় সম্ভব হয়। শোষণ
সম্ভব হয় না যদি শোষিত সবাই শোষণকারীর আজ্ঞা পালন করতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃত
হয়। এই অর্থেই বলা হয়েছে যে, অন্যায় পরজীবী। সত্যাগ্রহীর প্রথম কর্তব্য
অন্যায় শর্ত গ্রহণ না করা, অন্যায় পরজীবী। সত্যাগ্রহীর প্রথম কর্তব্য
অন্যায় শর্ত গ্রহণ না করা, অন্যায় নিয়ম অমান্য করা, তাতে যত আঘাতই আসুক না
কেন। অসহযোগ অনেক ক্ষেত্রে কঠিন কাজ। কিন্তু অসহযোগ যদি সম্পূর্ণ হয় তবে
সাফল্য সুনিশ্চিত। অন্যায়কারীর ইচ্ছা সেখানে ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ সেই
ইচ্ছাকে কার্যকরী করবার উপায় আর তখন থাকে না।
সব মানুষের ভিতরই মানবতা,
অর্থাৎ মানবিক প্রেম ও সহানুভূতির বর্তমান। এ বিষয়টা একটু আগেই একবার
আলোচনা করা হয়েছে। মানুষ মানুষের দুঃখ বেদনায় সহানুভুতি বোধ করে এটাই
স্বাভাবিক, এটাই মানুষের ধর্ম। সত্যাগ্রহী দুঃখ বরণের দ্বারা অন্যায়কারীর
ভিতরও সেই মানবতাকে উজ্জীবিত করেন। সত্যাগ্রহীর মনে যদি হিংসা থাকে তবে
স্বভাবতই তিনি একাজে সফল হবেন না। ভয়ে নয় নির্ভয়ে, হিংসায় নয় অহিংসভাবে,
সত্যাগ্রহী সংগ্রাম চালিয়ে যান। অন্যায়ের সঙ্গে অসহযোগ ও দুঃখবরণই হল তাঁর
অস্ত্র। এটাও একরুকম যুদ্ধ, তবে এ যুদ্ধ ত্যাগ এবং অহিংসার শক্তি নিয়ে।
গান্ধী
বলেছেন, তাঁর জীবনই তাঁর বাণী। ভাষা দিয়ে বাণী রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন
না এমন নয়। বস্তুত তাঁর ভাষায় এমন পরিচ্ছন্নতা, এমন দার্ঢ্য এবং মাধুর্যের
সমন্বয় ছিল যে, অনেকের কাছেই সেটা বিস্ময়ের বস্তু। তবু তিনিই বলবার
অধিকারী ছিলেন যে, বাষ্য নয়, তাঁর জীবন দিয়েই তিনি বাণী রচনা করেছেন। অহিংস
যুদ্ধের তিনি শুধু তাত্ত্বিক অথবা ব্যাখ্যাতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন অন্তত
অর্ধশতাব্দীকালব্যপী তার অক্লান্ত প্রয়োগকর্তা। সেই অহিংস যুদ্ধেই তিনি
প্রাণদান করেছিলেন। এমন নির্ভীক যোদ্ধা বড় দেখা যায় না। কিন্তু সেটাও
প্রধান কথা নয়। প্রধান কথাটা বুঝতে হয় আমাদের যুগের পরিপ্রেক্ষিতে।
হিংসার
যুদ্ধে মানুষ বহু শতাব্দী ধরে অভ্যস্ত। যতদিন মানুষের হাতে অস্ত্র ছিল
সামান্য, ততদিন সেই যুদ্ধ ভয়াবহ হলেও মানুষের পক্ষে মারাত্মক হয়ে ওঠেনি।
ক্রমে মানুষের হাতে এল হিংসার এমন অস্ত্র যে, তার ব্যবহারে যদি সংযম না
আসে, যদি শতাব্দীব্যাপী হিংসায় অভ্যস্ত মনের সঙ্গে সংযোগ ঘটে নব আয়ত্ত
ধ্বংসের শক্তির, তবে মানুষের সভ্যতা আয়ু শেষ হয়ে এসেছে বলা ছাড়া উপায় থাকে
না। এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এলেন গান্ধী। হিংসার পথ ছাড়া কি অন্য পথ আছে?
গান্ধী বললেন, আছে। তাঁর জীবন দিয়ে তিনি পরীক্ষা করে দেখালেন যে, হিংসাই
একমাত্র পথ নয়। আণবিক বোমা যখন ধ্বসের মুর্তি নিয়ে দেখা দিল ইতিহাসের
ভয়ার্ত রঙ্গমঞ্চে, গান্ধী তখন মানুষের কাছে তুলে ধরলেন বহু কষ্টে অর্জিত
তাঁর এই মৃত্যুঞ্জয়ী আশার বার্তা, অন্য পথ আছে। ভিন্ন দেশের ভিন্ন ধর্মের
নেতারা বলেছেন, এ যেন ঈশ্বরের বাণী। তাঁর জীবন মানুষের কাছে দৈব আশীর্বাদ।
গান্ধী ঈশ্বরকে দেখেননি। কিন্তু বহু মানুষের এই বিশ্বাস, ঈশ্বরই তাঁর ভিতর
দিয়ে মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন।