১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার,
দুপুরে খাবার শেষে ভাত ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় প্রবালের ফোন -ভাই
আব্বার অবস্থা খারাপ, ট্রমা সেন্টারে আসেন। ছুটে গেলাম। ততক্ষণে স্যার লাইফ
সাপোর্টে চলে গেছেন। সারারাত কাটালাম মিরাকলের আশায়। কিন্তু সব চেষ্টাকে
বৃথা করে স্যার চলে গেলেন সকাল ১১ টা ৩৫ মিনিটে। বার বার মনে হচ্ছিল
কয়েকমাস আগে যেমন লড়াই করে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছিলেন এবারও বোধ-হয় তেমনি
হবে। বিধি বাম হলোনা। কয়েকমাস আগেও গ্রীণ লাইফ হাসপাতাল থেকে স্যার আমাকে
ফোন করতেন। আমি ভাবতাম প্রবাল। বলতাম প্রবাল কোন সমস্যা? তিনি তখন বলতেন
না আমি তোমার স্যার। নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করলে আমাকে ফোন করতেন। আহা
আর কোনদিন ফোন আসবেনা! আমাদের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য থেকে শুরু করে পরিণত
সময় পর্যন্ত আমরা স্যারকে একই রকম পেয়েছি। আমীর আলী চৌধুরী কুমিল্লা শহরে
একটি সম্ভ্রান্ত সংস্কৃতিবান্ধব মুসলিম পরিবারের সন্তান।
কুমিল্লা শহরের
আদি ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবাররগুলোর মধ্যে মৌলভী বাড়ি অন্যতম। মূলত
মৌলভী বাড়ি থেকে আজকের এই মৌলভিপাড়া। অসংখ্য গুণীজনের স্মৃতিধন্য এই
মৌলভবাড়ী। এই বাড়ির প্রথম প্রজন্ম ধর্মপ্রচারে কুমিল্লা আসেন এবং বসতি
স্থাপন করেন। আজকে মুরাদপুর জানুমিয়া মসজিদ সংলগ্ন যে বাড়িটিকে আমরা মৌলভী
বাড়ী হিসেবে চিনি তার গোড়াপত্তন করেন খান বাহাদুর মৌলভী আশরাফ আলী। মৌলভী
খান বাহাদুর আশরাফ আলীর পুত্র আরেফের রহমান অসংখ্য জনহিতকর কাজে সম্পৃক্ত
ছিলেন। বজ্রপুর মৌলভী বাড়ির বংশধরেরা বিগত ২০০ বছর ধরে কুমিল্লার শিল্প
সাহিত্য সংস্কৃতি ক্রীড়া ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন।
উপমহাদেশ খ্যাত সংগীতজ্ঞ ও তবলাবাদক ওস্তাদ জানে আলম চৌধুরী ছিলেন এই
পরিবারেরই কীর্তিমান তৃতীয় পুরুষ। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শচীন দেব বর্মন ও
ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু সহ অসংখ্য শিল্পীকে দিক্ষা দিয়েছেন তিনি। এই
পরিবারের চতুর্থ পুরুষ সুলতান আলম চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সায়েকা খানম
চৌধুরানীর জেষ্ঠ্যপুত্র আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমীর আলী চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৭
সনের ১৫ ই মার্চ।
তাঁদের সুযোগ্য সন্তানেরা হলেন নাসিম বানু, চৌধুরী
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মোহাম্মদ সাদেক আজম চৌধুরী, শামীম আরা ফেরদৌস,
চৌধুরী আজফার ইনতিহা ও শাহীন নিগার। উল্লেখ্য যে তখন সম্ভ্রান্ত মুসলিম
পরিবার গুলোর মধ্যে আন্ত বৈবাহিক সম্পর্কের প্রচলন ছিল। যেমন হোমনাবাদ
পরগনার জমিদার নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরীর বড়ভাই ইয়াকুব আলী চৌধুরীর কন্যা
আশরাফুন্নেসার সাথে আমীর আলী চৌধুরীর প্রোপিতামহ আরেফের রহমান বৈবাহিক
সম্পর্কে আবদ্ধ হোন। একইভাবে আমীর আলী চৌধুরী শুয়াগাজী সাহেব বাড়ীর
প্রতাপশালী জমিদার ওমর আহমদ চৌধুরীর মেঝ কন্যা শামসুন্নেসা চৌধুরীর সাথে
১৯৬৪ সালে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের প্রথম কন্যা সানজিদা চৌধুরী পিউ,
বড় ছেলে চৌধুরী আশরাফ আলী পাভেল ও ছোট ছেলে চৌধুরী ওয়াসিফ আলী প্রবাল। বিগত
৮ এপ্রিল ২০২২ তারিখে তাঁর সহধর্মিণী শামসুন্নেসা চৌধুরী ইন্তেকাল করেন।
এই
অগ্রজ ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানসহ দেশের সকল ক্রান্তিকালীন ও
দুর্যোগ মুহূর্তে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে ইউসুফ স্কুলের
ছাত্র হিসেবে ৫২’র ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল একটি স্মরণীয় ঘটনা।
জনাব
আমীর আলী চৌধুরী কুমিল্লা ইউসুফ স্কুল থেকে ১৯৫৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন,
ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই.এ. ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর বাংলা বিভাগ থেকে বি.এ
(অনার্স), এম.এ পাশ করেন।
শিক্ষকতা জীবনে তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া
সরকারি কলেজ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ, ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ,
দিনাজপুর সরকারি কলেজ, সিলেট এম.সি. কলেজে শিক্ষকতা করেন। চাকুরী জীবনের
প্রান্তভাগে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ পদে
দ্বায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯৫ সনে অবসর নেন। অতঃপর অধুনালুপ্ত বেসরকারি
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে আট বৎসর খন্ডকালীন অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য
ছিলেন।
কুমিল্লা ডায়াবেটিক সমিতি, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ,
কুমিল্লা, দুঃস্থ মা ও শিশু কল্যাণ ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল
প্রভৃতির সদস্য। তদুপরি বাংলাদেশ এক্স ক্যাডেট এসোসিয়েশন, কুমিল্লা ইউনিটের
প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং শিশু বিদ্যালয় কুমিল্লা নজরুল মেমোরিয়াল একাডেমির
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানরূপে এবং কুমিল্লার এথনিকা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের
প্রধান উপদেষ্টারূপে দায়িত্ব পালনরত। বিশিষ্ট এনজিও সংস্থা কুমিল্লা পেইজ
ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রাক্তন চেয়ারম্যান।
তিনি মহামান্য রাষ্ট্রপতি
কর্তৃক কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, পরিচালনা পরিষদ,
কুমিল্লা আইন কলেজ পরিচালনা পরিষদ, কুমিল্লা অজিতগুহ কলেজ পরিচালনা পরিষদের
মনোনিত সদস্য। কুমিল্লা বজ্রপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ ও
বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন, কুমিল্লা জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি,
কুমিল্লা জেলা কমিউনিটি পুলিশিং-এর মনোনীত সভাপতি।
সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে
কুমিল্লা পূর্বাশা কচি-কাঁচা মেলার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এক যুগব্যাপি
কুমিল্লা-কালচারাল কমপ্লেক্স-এর প্রাক্তন উপদেষ্টা, নজরুল পরিষদ, জাতীয়
শিল্পকলা একাডেমির পরিচালনা পর্ষদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রতিনিধি হিসাবে তিন
বৎসর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯২ সনে শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক হিসাবে জাতীয়
পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৫ সনে স্কাউট আন্দোলনের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে জাতীয়
সনদপত্র লাভ করেন। স্থানীয় পর্যায়ে রোটারী, কুমিল্লা গণিত ক্লাব, সাহিত্য ও
সাংস্কৃতিক সংগঠন যাত্রী, বাংলাদেশ শিক্ষক পর্যবেক্ষক সোসাইটি, কুমিল্লা
কর্তৃক সম্মাননা স্মারক পেয়েছেন। কমিউনিটি পুলিশ কর্তৃক, জেলা প্রশাসক
গোল্ডকাপ ২০০৮ সনে বিশেষ অতিথিরূপে সম্মাননা স্মারক, ২০০৮ সনে মাধ্যমিক ও
উচ্চ মাধ্যমিকে জি.পি.এ-৫ প্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা সম্মাননা প্রদান
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিরূপে মাষ্টার মিশন কর্তৃক সম্মাননা স্মারক, ২০১২ সনে
কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন
উপলক্ষে সম্মাননা স্মারক, কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের রোগী কল্যাণ পরিষদ
কর্তৃক আজীবন সম্মাননা স্মারক, কুমিল্লাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি কর্তৃক ২০১৫
সনে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য সম্মাননা স্মারক, রূপসী বাংলা
কলেজ কর্তৃক ২০১৫ সনে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিরূপে সম্মাননা
স্মারক, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কুমিল্লা
রবীন্দ্র উৎসব উদযাপন কমিটি কর্তৃক সম্মাননা স্মারক, ২০০৮ সনে সাপ্তাহিক
অভিবাদন কর্তৃক সম্মাননা স্মারক, বাংলাদেশ বেতার কুমিল্লা অঞ্চল কর্তৃক
সম্মাননা স্মারক, ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন কুমিল্লা কর্তৃক ২০০৯ সনে সম্মাননা
স্মারক তাছাড়াও এই বর্ণাঢ্য শিক্ষাবিদ আরো নানা সম্মানে ভূষিত হন।
নিয়মানুবর্তিতা
আর সময়ানুবর্তিতার এক অনন্য নিদর্শন আমীর আলী চৌধুরী। নিয়মের বাইরে কিংবা
শৃংখলার বাইরে তাকে কোন কাজ করতে দেখিনি কখনো। সৌখিন পরিপাটি জীবনে অভ্যস্ত
ছিলেন। গান, আবৃত্তি, সেতার বাদনের পাশাপাশি ক্রিকেট খেলাতেও পারঙ্গম
ছিলেন আমাদের স্যার। অসম্ভব আমুদে মেজাজের মানুষ ছিলেন তিনি। ওস্তাদ
আলাউদ্দিন আলী খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর
পরিবেশনা উপভোগ করার বিরল সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। তিনি আমাদেরকে এমন ভাবে
পড়াতেন বাসায় আর আলাদা করে পড়া লাগতোনা। বিশেষ করে সমুদ্রের প্রতি রাবন
কবিতা টি স্যারের মতো এতো সুন্দর করে কেউ পড়িয়েছেন কিনা আমার জানা নেই।
স্যারের সাথে ছাত্র হিসাবে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে অসংখ্য স্মৃতি। আমীর
আলী চৌধুরী স্যারের ৮৬তম জন্মজয়ন্তী আমরা আলোকিত বজ্রপুর থেকে ঘটা করে
করেছিলাম সেজন্য আমরা গর্বিত। তিনি প্রায়ই বলতেন আমি বজ্রপুরের সন্তান।
এখনো মনে পড়ে আমার বই এর পাঠ প্রতিক্রিয়া অনুষ্ঠানে তিনি টানা সারে পাঁচ
ঘন্টা বসে ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ করে সবার শেষে বাসায় গিয়েছেন। ভিক্টোরিয়া
কলেজ কে তিনি নিজের পরিবার মনে করতেন। আমীর আলী চৌধুরীর জানাজায় ভিক্টোরিয়া
কলেজের অধ্যক্ষের অনুপস্থিতি বেদনাদায়ক। এমনকি স্যারের স্মরণে কলেজ
কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোন আয়োজন করেছে বলে আমার জানা নেই। ভিক্টোরিয়া
কলেজের কোন একটি স্থাপনা আমীর আলী চৌধুরীর নামে করা যেতে পারে। যাই হোক
তিনি এখন এসবের উর্ধ্বে। আমীর আলী স্যার আমাদের নিকট বেঁচে থাকবেন আমাদের
আলোকশিখা হয়ে। নম্রতা, সৌজন্যতা, সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে তিনি
প্রাসঙ্গিক থাকবেন আরো অনেক দিন। পরিশেষে রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়-‘নয়ন
তোমারে পায়না দেখিতে / রয়েছো নয়নে নয়নে।’
লেখক পরিচিতিঃ ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয়ক লেখক, গবেষক ও সংগঠক।