শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪
২ কার্তিক ১৪৩১
চাকরির বয়স বাড়ানোর ভালোমন্দ
মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৪, ১:১৯ এএম |

 চাকরির বয়স বাড়ানোর ভালোমন্দ
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো তথ্যটি উড়ছিল বাতাসে। এ সংক্রান্ত পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশ আনুষ্ঠানিক জানানো হয়েছে সোমবার। ছেলেদের জন্য ৩৫ আর মেয়েদের জন্য ৩৭ বছর করার সুপারিশের খবরে বেশ উল্লাস সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। তবে সুপারিশে অবসরের সময় বাড়ানোর কথা নেই। প্রায় এক যুগ ধরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে।
আন্দোলনটি ছিল অনেকটা শাহবাগকেন্দ্রিক। কখনো কখনো তা কিছুটা বেগবান হলেও তেমন তেজি হয়নি। তাদের মিছিল শাহবাগ ছাড়িয়ে বেশি দূর যেতে পারেনি। কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনে গিয়ে সাফল্যের পর চাকরিতে বয়স বাড়ানোর আন্দোলনকারীরা অনেকটা ভরসা খুঁজে পায়। সরকারের দিক থেকেও রেসপন্স মেলে।
এরই ধারাবাহিকতায় আন্দোলনকারীদের দাবির চেয়েও বেশি বয়স সুপারিশ করেছে। বয়স বাড়ানোর সুপারিশের বড় কারণ হিসেবে অন্তত তিনটি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। ১. করোনাভাইরাস মহামারিতে সরকারি চাকরির নিয়োগ বন্ধ ছিল। এই ক্ষতি পোষাতে গত সরকার বয়স ছাড় ঘোষণা করলেও আটকে থাকা নিয়োগে তেমন গতি ছিল না।
অন্যদিকে নতুন নিয়োগের উদ্যোগও ছিল কম। ২. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় গত সরকার দেশের অর্থনীতি নিয়ে সমস্যায় ছিল। ফলে সরকারি-বেসরকারি উভয় চাকরির সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছিল। ৩. গত সরকারের মামলা-হামলার কারণে অনেক ছাত্র সংগঠনের হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থী নিয়মিত নিয়মে তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারেনি। ফলে তারা চাকরি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি।
ভেতরের খবরে জানা গেছে, কমিটির এক সদস্য জানান, প্রথমে কমিটির পক্ষ থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছেলে-মেয়েদের জন্য যথাক্রমে ৩২ ও ৩৩ বছর করার চিন্তা ছিল। কিন্তু পরে একাধিক শিক্ষার্থী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর মত পরিবর্তন করে কমিটি। চূড়ান্ত বিচারে চাকরিতে প্রবেশের বয়স কত হবে তা নির্ভর করবে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। তবে উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, এই সুপারিশই চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
সাধারণভাবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ৩০ বছর, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য ৩২ বছর। কমিটির প্রস্তাবনায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতি-নাতনিদের জন্য আলাদাভাবে কিছু বলা হয়নি। মেয়েদের বয়স দুই বছর বেশি করার পেছনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মেয়েরা অনেক সময় স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ার পর আবার নতুন করে ভর্তি হতে হয়। পড়াশোনার মাঝে বিয়ে হওয়ায় কারও কারও পড়ালেখায় বিরতি পড়ে। বিয়ের পর সন্তান হওয়ার পর অনেক সময় চাকরির পরীক্ষা দিতে পারে না। এসব বিবেচনায় মেয়েদের বয়স দুই বছর বেশি রাখাকে কমিটি যৌক্তিক মনে করেছে।
অবসরের বয়স সম্পর্কে সুপারিশে কোনো কথা না থাকায় খটকা লাগছে অনেকের কাছে। এখানে একটি ফের আছে। সরকারি চাকরিতে স্বাভাবিকভাবে পেনশনযোগ্য হতে অন্তত ২৫ বছর চাকরির বয়স হতে হয়। তাই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করলে স্বাভাবিকভাবেই অবসরের বয়সসীমাও বাড়াতে হবে।
এছাড়া, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত কমিটিকে শুধু চাকরিতে প্রবেশের বয়স পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের কার্যপরিধিতে অবসরের বয়স বাড়ানোর সুপারিশ করার সুযোগ নেই। কিন্তু, বাস্তবতার নিরিখে অবসরের বয়সও বাড়াতে হবে। অথবা বিকল্প কিছু একটা করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল সরকার। গত সপ্তাহে এ কমিটি তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে। কমিটিতে সদস্যসচিব হিসেবে ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান। সদস্য হিসেবে ছিলেন সাবেক যুগ্ম সচিব কওছার জহুরা, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল এবং অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সাইফুল ইসলাম।
গত সরকার করোনার কারণে বয়স ছাড়ের কথা বললেও নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়নি। এটাও ছিল একটি কূটচাল ছিল। তাই শিক্ষার্থীদের চাওয়া বয়সের চেয়েও এখন বেশি সুপারিশ এসেছে। কমিটির প্রধান মুয়ীদ চৌধুরী চাকরির বয়স বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছেন। তার নেতৃত্বে কমিটি সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সরকারি চাকরি সংক্রান্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেছে। তারা দেখেছেন, আমেরিকায় কোনো বয়সসীমা নেই, নেপালে ৪৫ বছর, ভারতের কিছু প্রদেশে ৩৬ বছর রয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন দেশে বয়সসীমা আরও বেশি। তাই কমিটি বাংলাদেশেও বয়স বাড়ানোকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছে। প্রধান উপদেষ্টা প্রতিবেদন দেখে সন্তুষ্ট হলে কমিটির প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদে ওঠানোর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেবেন। এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ওঠাতে হবে। আইন ও বিধিবিধানে কিছু সংশোধন আনতে হবে।
আইনগত দিকগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিতে আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে। তাই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিষয়টি ওঠানোর আগে কিছু কাজ রয়ে গেছে। প্রশাসনকেন্দ্রিক ভাবনার কিছু বিষয়ও রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলতে চান, এতে ক্যাডার সার্ভিসগুলোতে চাকরির পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। সার্ভিস কমান্ডেও একটু গোলমাল হতে পারে। বা কেউ গোলমাল পাকানোর সুযোগ নিতে পারে।
বাংলাদেশে গত এক যুগের বেশি সময় ধরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বৃদ্ধির আলাপ থাকলেও, বয়সসীমা বাড়ানোর যৌক্তিকতা কতটা, সেটি নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। সেই সাথে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হলে সেটি কি রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সাথে মিলে দেশের জন্য বোঝা তৈরি করতে পারে - তেমন প্রশ্নও রয়েছে অনেকের মধ্যে। তাদের মতে কেউ ৩৫ বছরে আবেদন করলে তার লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, পুলিশ ভেরিফিকেশন ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে চাকরি হতে হতে আর তিন-চার বছর সময় চলে যাবে, যার অর্থ হলো তার কর্মজীবনই শুরু হচ্ছে প্রায় ৪০ বছর বয়সে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার ২০১৮ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “চাকরিতে প্রবেশের বয়স যদি ৩৫ করা হয় তাহলে তরুণদের মেধাকে কাজে লাগানো যাবে না। তরুণরা যে অনেক দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে সেটা কি কেউ অস্বীকার করতে পারবেন?" সেই মজুমদার এখন সরকারের একজন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। এরপরও ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার’ বলে বাংলায় একটি প্রবাদ-প্রবচন আছে। আমাদের উচিত হবে তরুণদের বেশি করে সুযোগ দেওয়া। কারণ সময় বদলেছে। সময়টা এখন তারুণ্যের।
স্মরণীয় ঘটনা, বাংলাদেশে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের সময় একবার ক্যাডার সার্ভিসের জন্য আবেদনের বয়স ৫০ বছর পর্যন্ত করা হয়েছিল। '৮২ ব্যাচের ওই কর্মকর্তারা ‘৬৫০ ক্যাডার’ হিসেবে প্রশাসনে পরিচিত। এসব কর্মকর্তার মধ্যে তখন ৪৫ বছরের বেশি বয়সে চাকরি পেয়েছিলেন ২০ জনের মতো। মূলত উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তনের কারণে প্রতিটি উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করতে হবে- এমন চাহিদা থেকে তখন একটি বিসিএসের জন্য বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখনকারটি আরেক অনিবার্যতা। বিশ্বের অনেক দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নেই। সেটা আরেক বাস্তবতা। ওইসব দেশে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন স্থানীয় সরকারের হাতে। তারা প্রয়োজন মতো নিয়োগ বা অব্যাহতি দেয়। আমাদের প্রেক্ষিত ও বাস্তবতা ভিন্ন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।












সর্বশেষ সংবাদ
বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধে বিপর্যস্ত জনজীবন
ডেভেলপমেন্ট ফর সোসাইটি’র উদ্যোগে দুস্থ পরিবারের মাঝে বিনামূল্যে গাভী বিতরণ
এইচএসসিতে শশীদল আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু তাহের কলেজের শতভাগ সাফল্য
শমসের মবিন চৌধুরী আটক
৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের আভাস
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন, কুমিল্লা জুড়ে গ্রাহকদের ভোগান্তি
কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে কর্মবিরতি পালন
কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা চন্দন কুমার
আমাকে নিয়ে খেলবেন না, ভিডিও বার্তায় সাকিব
কুমিল্লায় র‌্যাবের অভিযানে বাখরাবাদের আবুল খায়ের গ্রেফতার
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২