দশম পর্ব
স্কুলজীবনে ৭ম
শ্রেণি থেকে হিন্দু ছেলেরা সংস্কৃত ও মুসলমান ছেলেরা আরবী বিষয় পড়া শুরু
করতে হতো। এ দুটি ভাষাই দু’সম্প্রদায়ের ছাত্রদের কাছে নতুন ভাষা শিক্ষা
গ্রহণে প্রথমপাঠ বা সূচনা। তবে এ দু’ভাষাই দু’সম্প্রদায়ের প্রধান
ধর্মগ্রন্থের পবিত্র ভাষা হিসেবে গণ্য-মান্য-পূজ্য। তাই পারিবারিকভাবে স্ব
স্ব ধর্মগ্রন্থের ভাষার সঙ্গে জন্মের পর কথা শুরুর পরবর্তী ধাপে মৌখিকভাবে
সংস্কৃত ও আরবী উভয়ই সম্প্রদায়ের শিশু বা ছাত্রদের কাছে পরিচিত। পরিচয়
পর্বটি প্রতিপালনে দু’সম্প্রদায়ের বিশ^াসের বিষয়টি ধর্মীয় শুদ্ধতায় প্রলেপ
দেয়া হতো। দেখেছি- বাড়িতে কোনো সংস্কৃতিগ্রন্থ বা সংস্কৃতভাষায় লিখিত কাগজ
পেলেই ভক্তিসহকারে মাথায় ঠেকিয়ে যত্নসহকারে তথাকথিত পবিত্র স্থানে রেখে
দেয়া হতো। অনেকেই জানত না, তাতে কী লেখা আছে। শুধু শোনাকথা- এ ভাষা
ধর্মভাষা, পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলো শুধুমাত্র এ ভাষাতেই লিখিত। সুতরাং এ
ভাষার প্রতিটিঅক্ষর পবিত্র, মহামূল্যবান। মনে হয় সকল ধর্মাবলম্বীদের
ক্ষেত্রে প্রায় একই চিন্তা-ভাবনা এবং সংগ্রহণে সচেতনতা। এজন্য তাও লক্ষ্য
করতাম- এ ভাষায় লিখিত বই (গ্রন্থ বলাই শ্রেয়) বহন করার সময় সবসময় বুকের
মধ্যে অথবা মাথার উপর রেখে যথাযথ নিয়ম পালন করতে হতো।
কেন ৭ম শ্রেণি
থেকে এই দু’ধর্মীয় ভাষা পড়া শুরু করতে হতো ? তখন জানি নাই বা জানতাম না।
এখন সহজভাবেই বুঝে গেছি- যেহেতু ধর্মীয় বইগুলো এ ভাষায় লিখিত, তাই এ ভাষা
শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে সহজেই স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থগুলো পড়তে পারা যেত,
অর্থও বুঝা যেত। ধর্মীয় মূল্যবোধ যাপন ছাড়াও সুন্দর সুন্দর কাহিনি সমৃদ্ধ
নীতিশিক্ষামূলক গল্প বা উপদেশগুলো আত্মস্থ করা সহজ হতো। ‘আত্মস্থ’ কথাটি
অত্যন্ত ভারি। অর্থাৎ বুঝতে পারা। সহজ করে বুঝাই-ইদানিং কোনো কোনো হিন্দু
পরিবার তাঁদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার জন্য অক্লান্ত
এমন কি ধর্মীয় বই পড়ানোর সময় ধর্মীয় পোশাক (ধুতি), কোটায় তিলক, নামাবলি,
আরও অনেককিছু দিয়ে সাজিয়ে সংস্কৃত ভাষায় ধর্মীয় বই মুখস্থ করার প্রয়াস নেয়।
একসময় দেখা যায়- শিশুটি অল্প বয়সেই কোনো না কোনো ধর্মগ্রন্থ আগাগোড়া
মুখস্থ বলতে পারে। কিন্তু গ্রন্থটি বা বইটির মধ্যে কীসব মূল্যবান কথা রয়েছে
এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। বিষয়টি এমন সারাজীবন পায়েস খেলো, পায়েসের
উপকারিতা কি তা জানল না। কিন্তু পিতামাতা বা গুরুজন মহাখুশি। এমন কি- এরূপ
একজন গুণধর সন্তানের জন্য গোটা পরিবার নয়, গোষ্ঠীই স্বর্গবাসী হয়ে যাবে-
দৃঢ় বিশ^াস। এ ক্ষেত্রে মন্তব্য নিস্প্রয়োজন। এ নিয়ে বহু কথা বলা যেতে
পারে, আমার নিজ সম্প্রদায় ‘মাইর’ দিলেও অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা হত্যা করতে
দ্বিধা করবে না। বরং হত্যা করতে পারলে পূন্যার্জন করার দাবিদার হয়ে বাহবা
পাবেই। আমি যেহেতু হিন্দুসম্প্রদায়ের ছাত্র ছিলাম, আমাকে সংস্কৃত ভাষা পড়তে
হয়েছে। এখানে একটি কথা বলে রাখি বিদ্যালয়ে সংস্কৃতি পাঠের জন্য
পন্ডিতনামীয় শিক্ষক পাওয়া গেলেও মৌলভী শিক্ষক পাওয়া কঠিন ছিল। এসব ক্ষেত্রে
মুসলমান ছাত্ররা অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে আরবী ভাষা পড়তে হতো। শুনেছি
কুমিল্লা ঈশ^রপাঠশালায় কোন আরবী শিক্ষক ছিল না। মন্ত্রী কর্ণেল আকবর হোসেন ও
বড় ভাই ইমাম হোসেন হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে সংস্কৃত ভাষাই পড়ে ম্যাট্রিক পাশ
করেছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন কলিকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত
অনার্স পাশ করা ছাত্র। পরের ইতিহাস ভিন্ন। প্রবাদ আছে ভিন্ন সম্প্রদায়ের
ছাত্র অন্য ভাষায় পরীক্ষা দিলে ৫ নম্বর বেশি দেয়া হতো। এখন তো পন্ডিত নেই,
মৌলভীদের সয়লাব, সেজন্য কুমিল্লা শহরে অনেকগুলো হিন্দু ছেলেরা নিজেদের
উদ্যোগেই ধর্মীয় বিষয়টি পাঠপাঠন করে থাকেন। না, বিষয়টি ভিন্ন রূপ। এখন আর
ভাষা শিক্ষা দেয়া হয় না, ধর্ম শিক্ষা দেয়া হয়, কাজেই বাংলায় লিখিত ধর্ম
শিক্ষা বিষয়ক বই যে কেউ পড়াতে পারে। এতে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে কতটুকু লাভ
হয়েছে, কতটুকু হয়নি তা নিয় মাথা ঘামায় এবং মাথার চুলও পড়ে সাফ হয়ে যায়।
আক্রান্ত হতে চাই না বলে কথা বাড়াব না। যে কথাটি বলতে চাইছি। সংস্কৃত বই- এ
দেবনাগরী অক্ষরে যে পাঠ থাকত, তন্মধ্যে নীতিকথামূলক ছোট ছোট গল্পও থাকত।
একটি গল্প পড়েছিলাম, নাম ‘নীলবর্ণ- শৃগালকথা’। একবার একটি শৃগাল গৃহস্থবাড়ি
থেকে হাঁস চুরি করতে এসে তাড়া খেয়ে একটি নীলরং ভর্তি গামলায় পড়ে যায়।
বাড়িটি ছিল রজকের (ধোপার)। কাপড়ে নীল রং দেয়ার জন্য গামলা ভর্তি ছিল।
মুহূর্তে শৃগালটির গায়ের রং নীল হয়ে যায়। প্রাণভয়ে পালিয়ে বনের ভিতর চলে
যায়। বনের অন্যান্য পশুরা দেখল- এ এক অদ্ভুত রং-এর জীব। এমনটি তো পশুকূলে
নেই। তাহলে সে কে ? কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করার সাহাসও নেই। এমনিতে তো পশুদের
রাজা হলো সিংহ। বাঘ সেনাপতি ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে পদবীধারী পশুরা রয়েছে।
কথায় আছে-
নরানাং নাপিত ধূর্ত
পক্ষীনাং ধূর্ত বায়স
এবং পশুনাং শৃগাল ধূর্ত।
অর্থাৎ
মানুষের মধ্যে নাপিত ধূর্ত (চালাক নয়), পাখিদের মধ্যে বায়স অর্থাৎ কাক।
নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করে, জিনিসচুরি করে একচক্ষু মুদ্রিত করে খাবার লুকিয়ে
রাখে, ভাবে কেউ দেখতে পায়নি। অন্যদিকে কোকিল কাকের বাসায় গোপনে ডিম পেড়ে
রেখে যায়, কোকিল ডিম ফুটাতে পারে না। একসময় ডিম ফুটলে নিজের বাচ্চা নিয়ে
উধাও। কাক খাদ্য লুকায়, শেষ পর্যন্ত মল খেয়েই উদর পূর্তি করে। অন্যদিকে
পশুকুলে শৃগাল হলো ধূর্ত। তার বুদ্ধি বেশি। তাই সে পশুকূলের মন্ত্রী।
কিন্তু ভাগ্য তার এমনই, সকলেই তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
এই শৃঘালকুলের একটি
শৃগাল প্রাণভয়ে পালাতে গিয়ে রজকের নীলের গামলায় পড়ে এখন নীলবর্ণ নতুন জীব
পশুকুলে আবির্ভূত হয়েছে। বুদ্ধিমান শৃগাল ঘোষণা দিল- পশুকুলের দুর্দিন,
চারদিকে অনাচার-অত্যাচার-মারামারি-হানাহানি। কোনো পশুই ঠিকমত স্ব স্ব ধর্ম
রক্ষা করছে না। পশুরাজ্য রসাতলে চলে যাচ্ছে। মানুষ পশুদের হত্যা করছে,
তাড়াচ্ছে।
তাই সৃষ্টিকর্তা স্পেশালভাবে আমাকে সৃষ্টি করে পশুকুলকে
রক্ষা করতে পাঠিয়েছেন। আমি তোমাদের মনোনীতি বা নির্বাচিত নই। স্বয়ম্ভূ।
আমি যা বলব, যা করব, যেভাবে নির্দেশ দিব- তা তোমাদের মানতে হবে। পশুদের
পুরাতন অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। আমি সিংহাসনে বসব, আমার ধারে কাছে কেউ আসবে
না। আমার রং যেমন আলাদা, পোশাকও আলাদা। কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন- কোনো শৃগাল
যেন রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে। তাদের মন্ত্রীত্ব শেষ। তাদেরকে কঠোর
হস্তে দমন করতে হবে, তাদের জিনিসপত্র-আস্তানা সব প্রথমে অপহরণ অর্থাৎ চুরি,
পরে ভাঙচুর এবং শেষে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে হবে। আমি যে বনে আছি, এ বনে
তারা কেউ থাকতে পারবে না। ইত্যাদি।
সব পশুদের মুখে কুলুপ, দায়িত্ব পালনে
ভয়ে ভয়ে যাতায়াত, অর্থাৎ পুরনো সব নিয়মকানুন বাদ, দরকার বোধে নতুন করে
হাঁকডাক, নতুন করে পোশাক পরিধান ইত্যাদি প্রচলনের ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নেওয়া
হচ্ছে।
অবহেলিত শৃগালরা তো কোথায় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে টিকে আছে, কেউ
জানল না। কী তাদের দোষ। মাঝে মাঝে ২/৩টি শৃগাল দেখা গেলেও ভয়ে অস্থির। এ
প্রজাতি তাহলে বাঁচবে কী করে। তাদের ধূর্তামিতেও বুদ্ধি জোগান দিচ্ছে না।
এভাবে তো চলে না। তাই গোপনে গোপনে যোগাযোগ ও সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করতে
লাগল। অতি সাবধানে।
দূরে নদীর পাড়, যাতায়াতে দুর্গম বনে বঞ্চিত প্রবীন
শৃগালেরা মিটিং-এ বসল। অনেক আলাপ-আলোচনা হলো। কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে
না, সাহস করে সামনাসামনি হবে- তাও যেন সম্ভব নয়। তখন একটি বৃদ্ধ শৃগাল
চীৎকার করে বলছে- শক্তি প্রয়োগ করে হবে না। কারণ নীলবর্ণ জীবটির সঙ্গে
সিংহ-বাঘ-ভালুক-হায়না ইত্যাদি সব রয়ছে। তাদের শক্তি আছে, বুদ্ধি নাই।
আমাদের বুদ্ধি আছে শক্তি নাই। সুতরাং বুদ্ধি দিয়েই নিজেদের অবস্থান
প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সকল শৃগাল যেন হালে জল পেলো। কিন্তু বুদ্ধিটা কি ?
বৃদ্ধ শৃগাল বলতে শুরু করল- আমার মনে হয়- নীলবর্ণ জীবটি স্পেশাল কোনো জীব
নয়। ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখেছি- এটির আকৃতি আমাদের সমতুল্য। কাজেই তা
পরীক্ষা করতে হবে। কী পরীক্ষা।
বলল, ‘আগামীদিন তোমরা সবায় এখানে জমায়েত
হবে। যখন সন্ধ্যা হবে, তখন আমার সমস্বরে হুক্কা হুয়া করে চীৎকার করতে থাকব,
যদি আমাদের সমগোত্রীয় হয়, তখন সেও আর চুপ থাকতে পারবে না। এ নিয়ে
পক্ষে-বিপক্ষে কথা হলেও সিদ্ধান্ত হলো আগামীদিন পরিকল্পনামত কর্মসূচি পালন
করা হবে। হয়ত মরণ, নচেৎ জয়লাভ।
ঠিক পরের দিন সন্ধ্যায় শৃগালেরা একত্রিত
হলো এবং মাহেন্দ্রক্ষণে সকল শৃগাল একযোগে হুক্কা হুয়া ধ্বনি তারস্বরে
নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ঘোষণা দিল। হায়রে নীলবর্ণ জীব। দীর্ঘদিন
আত্মীয়-স্বজন দেখে না, প্রাণ খুলে হুক্কা হুয়া ধ্বনি দিয়ে জাতীয় সঙ্গীতও
গাইতে পারে না। তাই নিমিষে নিজের মেকিপনা ভুলে গিয়ে চরম-পরমানন্দে নদীর
পাড়ের শৃগালগুলোর জয়ধ্বনির সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রাণভরে হুক্কা হুয়া ধ্বনি
দিয়ে ডাক ধরল। এ কি ?
সিংহ-বাঘ-ভালুক-হায়না সব অবাক হয়ে শুনছে, দেখছে।
এতদিন তারা কাকে রাজা ভাবছে। ও যে শৃগাল। হায় হায়- সবায় মিলে তখন বিদ্রোহ
ঘোষণা করে নীলবর্ণ শৃগাল রাজাকে তাড়া করল। সে শৃগাল উপায়-বুদ্ধি না দেখে
দৌড়ে নদীর পাড়ের শৃগালদের কাছে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিল। যখন নদী থেকে ডাঙ্গায়
উঠল- তখন আর শরীরে একফোঁটা নীল রং অবশিষ্ট রইল না। আসল শৃগাল হয়ে গেলো।
আমরা গল্পটি পড়েছি। কিন্তু তার শেষাংশে ছিল নীতিকথা। এই নীতিকথাই আসল কথা।
নীতিকথা তাহলে কি ? সংক্ষেপে ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট। আর স্বভাব নষ্ট বা ধ্বংস
হয় আচরণে।’ স্বধর্ম পরিত্যাগ করাই মৃত্যু। শুধু প্রশ্ন- ‘তুমি কোন কাননের
ফুল ?’