গণঅভ্যুত্থানে
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন ঘটেছে। ইতি হয়েছে সাড়ে পনেরো বছরের সরকারের ।
পরিবর্তন হয়েছে বাক স্বাধীনতা থেকে শুরু করে রাস্তার চলাচললের অটোরিক্সার
জিবি আদায় পর্যন্ত। যে পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে দেশের তরে বুক পেতে দিয়েছিল
বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা, সেই স্বপ্নের পথে কি এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ?
ছাত্র-জনতার
গণঅভ্যুত্থান একটি আন্দোলনের রূপ নেওয়ার আগে এটি ছিল নেহাত সরকারি চাকরির
কোটা সংস্কার আন্দোলন। এমন একটি আন্দোলন ২০১৮ সালেও একবার হয়েছিল। কারণ
একটাই সরকারি চাকরী নামক সোনার হরিণ তরুণদের চাই-ই চাই! আর তাই সেখানে ৫৪
শতাংশ কোটার জায়গা নেই। সেই বার সরকার ছাত্রদের কোনোমতে শান্ত করে। তবে
এবার কোটা একেবারে বিলুপ্তি হওয়ার পথে, যা ছিল প্রকৃতপক্ষে পরবর্তী আরেকটি
আন্দোলনের বীজ বপনের পথে। কারণ ছাত্ররা চেয়েছিল কোটার সংস্কার, কোটার
সম্পূর্ণ বিলোপ নয় ।
দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
এসব তরুণদের প্রথম আগ্রহ সরকারি চাকরির প্রতি। তাঁদের মধ্যে সরকারি চাকরি
যাঁরা পাচ্ছেন না, তাঁরা বেসরকারি চাকরির জন্যও নিজেকে প্রস্তুত করতে
পারছেন না। ফলে একপর্যায়ে গিয়ে- না সরকারি, না বেসরকারি-কোনো চাকরিই মিলছে
না। এতে এই তরুণেরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। এই পরিস্থিতি থেকে তরুণদের বের করে
আনতে হলে উদ্যোক্তা তৈরির বিকল্প নেই। এর জন্য তরুণদের পেশাগত মানসিকতা
পরিবর্তন করতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরির জন্য চিন্তা ভাবনা ও মানসিক পরিবর্তন
করতে হবে। উদ্যোক্তা হতে গেলে ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ হতে হয়। উদ্যোক্তা
হওয়ার জন্য লাগে সাহস, উদ্যম, জেদ ও লেগে থাকার মানসিকতা। এসব থাকলে
অর্থায়ন বর্তমান বাস্তবতায় খুব বেশি কঠিন বিষয় নয়। দেশের উদ্যোক্তাদের
ব্যাংকই অর্থায়নের প্রধান উৎস।
দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা চাকরি
খোঁজার মানসিকতা তৈরি করছে। উদ্যোক্তা হতে গেলে শিক্ষা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও
জ্ঞানের সংমিশ্রণ থাকতে হবে। আবার চাকরির ক্ষেত্রে শুধু দক্ষতা থাকলে চলবে
না, নিয়োগকর্তার চাহিদা পূরণের মানসিকতা থাকতে হবে। প্রথম আলোর যুব
কর্মসূচির সমন্বয়ক মুনির হাসান এক অনুষ্ঠানে বলেন, প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ
দেশের কর্মবাজারে আসছে। এর মধ্যে ৫ শতাংশ তরুণ উদ্যোক্তা হলে দেশের চিত্র
পাল্টে যেত।
উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব আমলাতান্ত্রিক বাধা আছে,
তিনি সেগুলো দূর করার আহ্বান জানান। দেশের ক্রমবর্ধনশীল চাকরিপ্রার্থী তরুণ
সমাজের বৃহদাংশ, যারা দেশে থাকতে চান, তারা সরকারি চাকরিকেই বেছে নেন। আর
প্রথম সারির সরকারি চাকরি মানেই হলো বিসিএস নামক সোনার হরিণ। যেন ঐ
প্রাপ্তিতেই জীবনের সব সমস্যার সমাধান হবে। তবে অন্তর্নিহিত কারণ হলো,
চাকরির সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবে প্রাপ্ত সরকারি ক্ষমতা ও সরকারি
সুযোগ-সুবিধা কিংবা দুর্নীতিবাজ হতে পারলে উপরি আয়ের সুযোগ! সেজন্যই
সাধারণত ক্যাডার চয়েজ লিস্টের সবচেয়ে উপরে থাকে পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডার।
কবি
জীবনানন্দ এ যুগে জন্ম নিলে মোটেও লিখতেন না যে ‘পৃথিবীতে নেই কোনো
বিশুদ্ধ চাকরি’ কারণ তিনি বিসিএস ক্যাডারের স্বাদটাই পাননি। বর্তমানে
প্রয়োজন আরো একটি নীরব অভ্যুত্থানের, যেটি চুরমার করে দেবে প্রচলিত রাষ্ট্র
কাঠামোর বেড়াজাল এবং জনগণ ও তরুণদের পুরোনো মনস্তত্ত্ব। এতে করে পরবর্তী
সরকারগুলো রাষ্ট্র যন্ত্রের ব্যবহার করে দানবে পরিণত হওয়ার সুযোগ পাবে না।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের বিকাশ কিংবা জবাবদিহিতার জন্যও এটা
অত্যাবশ্যক। আধুনিক বিশ্বে সরকারি চাকরি কখনোই তরুণদের প্রথম পছন্দ হওয়া
ইতিবাচক লক্ষণ নয়। এটা দেশের ভবিষ্যতের জন্যও তেমন মঙ্গলজনক নয়। তাই
সরকারকে বৃদ্ধি করতে হবে জ্ঞানভিত্তিক পেশার ক্ষেত্র।
সবাই মেধা ও
দক্ষতার ভিত্তিতে পছন্দের কাজ করবে, দেশে চাকরি ক্ষেত্রের হাহাকার কমবে,
সরকারি চাকরির উন্মাদনা কমবে, বেকার সমস্যা কমবে এবং সর্বোপরি যে যার
জায়গা থেকে দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ পাবে-এই হোক নতুন বাংলাদেশের কাছে
কামনা। সময়ের ব্যবধানে সরকারি চাকরি এমন এক মধুর মহামারিতে রূপ নিল যে,
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা লাইব্রেরিতে বসে পড়তে লাগল সরকারি চাকরির
বই। মেডিকেল থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া সবাই প্রশাসনিক পদে যাওয়ার
স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। বিয়ের বাজারেও বেড়ে গেল সরকারি চাকরির কদর!
মজার
ব্যাপার হলো এই সরকারি চাকরির উন্মাদনার অনিবার্য ফলাফলই হলো কোটার বিরোধে
তরুণদের ক্ষোভ। যেটা নিয়ে এক যুগ আগেও তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আর
যেই সরকার প্রশাসন যন্ত্র, সরকারি বেতনভোগী ও আমলাদের সরকার প্রেমী করতে
সরকারি চাকরির এত আড়ম্বরতা সাধন করল, সেই তরুণ সরকারি চাকরিপ্রার্থী কোটা
সংস্কার আন্দোলনকারীদের হাত ধরেই গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়ে পতন ঘটল বিগত
সরকারের!
যাহোক, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যা পরিবর্তন করা প্রয়োজন
তা হলো তরুণদের পেশাগত মানসিকতা। তাদেরকে আরো প্রচারে মাধ্যমে জানাতে হবে
উদ্যোক্তা হতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের
বর্তমানে সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়াও প্রশিক্ষণে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, ব্যবসায়িক
পরিকল্পনা, এবং উদ্যোক্তা মানসিকতার বিকাশের জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন।
বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক
প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করা
হচ্ছে। সরকার ডিজিটাল ই-কমার্স খাতের উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নিয়েছে, যা
উদ্যোক্তাদের অনলাইন ব্যবসার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে যুব উন্নয়ন
অধিদপ্তরও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন উদ্যোক্তা তৈরিতে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, এ পরিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে উদ্যোক্তা বাড়বেও
নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব
ফেলছে।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।