কিশোর
গ্যাংয়ের খবরগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে চায়। আসলে কৈশোর তো পরের ব্যাপার,
শৈশবই তো অপহৃত হয়ে যাচ্ছে। গত বছর শতকরা ৪৬ জন শিশু স্কুলের বাইরে ছিল,
সংখ্যাটা ছিল শতকরা ২৯। ওদিকে এটাও দেখা যাচ্ছে যে, স্কুল ছেড়ে
শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছে মাদ্রাসায়, যেখান থেকে তারা শিক্ষার অভিমান নিয়ে
ফিরবে, কিন্তু যে শিক্ষাটা পাবে তার কোনো ব্যবহারিক মূল্য থাকবে না। অনেক
বছর ধরেই এটা ঘটছে। এর কারণ মাদ্রাসায় শিক্ষা স্বল্পমূল্যে, অনেক ক্ষেত্রে
বিনামূল্যেই পাওয়া যায়।...
কিশোর গ্যাংয়ের অভ্যুদয়ের সূত্রপাত ঘটে দেশ
স্বাধীন হওয়ার পরপরই। গুন্ডা-বদমাশ আগেও ছিল; তাদের একসময়ে মস্তান বলা হতো।
কিন্তু সংঘবদ্ধ কিশোর অপরাধী দল আগে ছিল না। স্বাধীনতার পর সুযোগ-সুবিধা
অনেক দিক দিয়েই প্রসারিত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে, অপরাধের বেলাতেও একই ঘটনা।
তরুণরা যখন সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজি ও জবরদখল শুরু করল, তখন তাদের বলা হতো
সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীরা নিজেদের ‘বীর’ মনে করত এবং অপরাধের মাধ্যমে
বীরত্বের প্রকাশ ঘটাত। তারা বেপরোয়াও ছিল। খুন-জখম করত, কলহ বাধিয়ে নিজেরা
যে মারা পড়ত না, এমনও নয়। প্রথম দিককার সন্ত্রাসী কেউ কেউ মারা গেছে, কেউ
চলে গেছে বিদেশে, কারাগারেও রয়েছে কিছুসংখ্যক। প্রকাশ্যে না এলেও জীবিতদের
কয়েকজন এখনো তাদের অনুসারীদের মাধ্যমে চাঁদাবাজি অক্ষুণ্ন রেখেছে। আবার এও
জানা যাচ্ছে যে, সন্ত্রাসীদের বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, তারা
ভাড়াটে লোক দিয়ে কাজ সারে। নিম্ন আয়ের লোকেরা ভয়ংকর ভয়ংকর সব কাজে ভাড়া
খাটে।
পেশাদার সাবেক সন্ত্রাসীদের একজনের জীবন-ইতিহাসের দিকে তাকালেই
বোঝা যাবে তারুণ্যের কী নিদারুণ অপচয় ঘটেছে। বলা যায়, ঘটাতে বাধ্য হয়েছে।
এই খবরটা সব কাগজেই বেরিয়েছে যে, তানভীর ইসলাম জয় নামে একজন সাবেক
সন্ত্রাসী কুয়ালালামপুরে মারা গেছে। সে অসুস্থ ছিল। একাকীই থাকত, একটি ঘরে।
কিডনির অসুস্থতার জন্য নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাত। মালয়েশিয়ায় সে বাংলাদেশি
পরিচয়ে যায়নি, গেছে ভারতীয় পরিচয়ে, সে দেশের পাসপোর্ট নিয়ে। তানভীর ছিল এক
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, ছাত্র ছিল মিশনারিদের স্কুলের। মেধাবী ছাত্র
হিসেবে জানত সবাই। সেই কিশোর আশপাশের অন্য কিছু বিপথগামী তরুণের পাল্লায়
পড়ে সন্ত্রাসী দলে নাম লেখায়। একসময়ে নিজেকেই সে একটি ‘দুর্র্ধষ’ দলের
প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ২০০১ সালে তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে ১ লাখ টাকা
পুরস্কার দেওয়া হবে বলে সরকারি ঘোষণা জারি করা হয়েছিল। সে সময়ে ১ লাখ টাকা
অনেক টাকা।
তানভীর ধরাও পড়েছিল। কারামুক্ত হয়ে সে চলে যায় কানাডায়।
বদলে ফেলে নিজের নাম। তার নতুন নাম হয় রানা অ্যাজাক্স। টরন্টোয় একটা ভালো
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিল। এরপর যায় ভারতে। পরে ঘুরে ঘুরে মালয়েশিয়া,
অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে বসবাস শুরু করে। তার দুই বিয়ে।
প্রথমবার বিয়ে যাকে করেছিল, সম্পর্কে তিনি তানভীরের আপন মামি। দ্বিতীয়
স্ত্রী বিদেশি। উভয় স্ত্রীরই একটি করে সন্তান রয়েছে। মৃত্যুর পরে তার
একমাত্র বোন অস্ট্রেলিয়া থেকে গিয়ে তার লাশ গ্রহণ করেন। বোঝা যায় অত্যন্ত
সাহসী, উদ্ভাবনশীল ও কর্মক্ষম ছিল এই তরুণ। তার কাজকর্ম রোমহর্ষক। যে পথে
তার গমন ও পরিণতি সে দিকে তার যাওয়ার কথা ছিল না। কেন সে সমগোত্রীয় হলো
সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, মুর্গি মিলনের মতো পেশাদার সন্ত্রাসীদের? তার
নাম কেন উঠেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীদের
তালিকায়? হ্যাঁ, ব্যক্তির নাম করা যাবে, যারা তাকে নষ্ট হওয়ার পথে টেনে
নামিয়েছে; বলা যাবে বন্ধুদের সংসর্গে নষ্ট হয়েছে; কিন্তু আসল কাজটা তো তার
বন্ধুরা করেনি, বন্ধুদের সে রকমের ক্ষমতা ছিল না, করেছে পুঁজিবাদী
ব্যবস্থা। যার শিকার তার নষ্ট হয়ে যাওয়া বন্ধুরা নিজেরাও।
বাংলাদেশ
স্বাধীন হওয়ায় তরুণদের একাংশ ভেবেছিল বিপ্লবের জন্য দুয়ার খুলেছে। তারা
এগিয়ে গেছে। কিন্তু বিপ্লব ঘটেনি; কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গিয়েছিল যাদের
হাতে, তারা মুখে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও ভেতরে ছিলেন পুঁজিবাদেরই অনুরাগী।
রাষ্ট্র তাই এগিয়ে চলল পুরোনো পুঁজিবাদী পথ ধরেই এবং ওই ব্যবস্থার অধীনে
থেকে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তৎপর হয়ে উঠল তানভীরের মতো দুঃসাহসী তরুণদেরই
একাংশ। ব্যক্তির দায়িত্ব যে ছিল না তা নয়। অবশ্যই ছিল। কিন্তু মূল কাজটা
করেছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নবজাগরণ; সেখানে লুণ্ঠন চলেছে নানা পন্থায়।
আইনি-বেআইনি নীরব সশস্ত্র কোনো পন্থাই বাদ থাকেনি। অপরাধে লিপ্ত
সন্ত্রাসীরাও ছিল লুণ্ঠনকারী ওই দলেরই সদস্য। স্বাধীনতার পরে সমাজ
পরিবর্তনের কাজটা যে প্রধান হয়ে উঠতে পারল না সেটা ওই লুণ্ঠনলিপ্সার
কারণেই।
তানভীর ইসলাম জয়ের কাহিনি শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের
সব্যসাচীর কাহিনির মতোই রোমাঞ্চকর। পার্থক্যটা অবশ্য একেবারেই মৌলিক। সেটা
এখানে যে সব্যসাচী লড়ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে; আর তরুণ
তানভীর পরিণত হয়েছিল পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের অভিশপ্ত এক ক্রীতদাসে।
বিদ্যমান
এই ব্যবস্থার অধীনে যে বাস্তবতাটা তৈরি হচ্ছে তাতে গল্প আছে, ভয়ংকর সব
গল্প; কিন্তু ওই সব গল্পে কোনো আকর্ষণ নেই, নেই কোনো উপসংহার। একই গল্প
ঘুরে ফিরে আসে। যে কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম; বাস্তবতাটা সুখবর বহন
করে না। সেখানে তাকালে দেখি নানা রকমের দৃশ্য, যেগুলোই এখনকার গল্প। এসবের
কথা ইতোমধ্যেই বলা হয়ে গেছে। তবু তাদের কিছু কিছু ঘটনা দেখে রাখবার মতো,
যাতে বুঝতে পারি কী ঘটছে এবং জিজ্ঞেস করতে পারি- কেন ঘটছে।
কিশোর
গ্যাংয়ের খবরগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ধরতে চায়। আসলে কৈশোর তো পরের ব্যাপার,
শৈশবই তো অপহৃত হয়ে যাচ্ছে। গত বছর শতকরা ৪৬ জন শিশু স্কুলের বাইরে ছিল,
সংখ্যাটা ছিল শতকরা ২৯। ওদিকে এটাও দেখা যাচ্ছে যে, স্কুল ছেড়ে
শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছে মাদ্রাসায়, যেখান থেকে তারা শিক্ষার অভিমান নিয়ে
ফিরবে, কিন্তু যে শিক্ষাটা পাবে তার কোনো ব্যবহারিক মূল্য থাকবে না। অনেক
বছর ধরেই এটা ঘটছে। এর কারণ মাদ্রাসায় শিক্ষা স্বল্পমূল্যে, অনেক ক্ষেত্রে
বিনামূল্যেই পাওয়া যায়। ওদিকে যারা স্কুল-কলেজে পড়ছে, পাস করছে, ভর্তি হতে
আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের দশাটা কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভর্তি
পরীক্ষায় ফেল করেছিল শতকরা ৮৯ জন।
পত্রিকার খবর দেশে এখন নাকি কিশোর
গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা ২ হাজার ৩৭২। চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের হামলা থেকে
ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হন দন্ত্যচিকিৎসক কুরবান আলী। পরে হাসপাতালে তার
মৃত্যু হয়। ১২ জনের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন চিকিৎসকের স্ত্রী। পুলিশ
তিনজনকে গ্রেপ্তার করে, বাকিদের নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, ওই
তিনজনও জামিন নিয়ে বের হয়ে এসে হুমকি দিচ্ছে পরিবারকে। বাবার মৃত্যুর পর
এখন শঙ্কায় রয়েছেন ছেলেটির মা।
নাটোরে চার বন্ধু মিলে এক বন্ধুকে
পরিত্যক্ত একটি ভবনে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। এরা সবাই মাদক কারবারের সঙ্গে
যুক্ত ছিল। পুলিশের ধারণা, উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিপণ আদায় করা। সাভারে কিশোর
গ্যাংয়ের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারিয়েছে এক যুবক। ঈশ্বরদীতে যুবলীগ নেতাকে
পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে; সন্দেহ গ্যাংকেই। টাঙ্গাইলের নাগরপুরে ডেকে নিয়ে
গিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে, এ খবর শুনে কাজটা বিএনপিপন্থি
ছাত্রদলের ছেলেরা করেছে- এমন সন্দেহ কেউ করবে না। ধরেই নেবে, যে নামেই হোক
মব জাস্টিস গ্যাং-স্বভাবের তরুণদেরই ওটি কাজ।
গ্যাং যে শুধু গ্যাং নামে
আবির্ভূত হয় তা নয়, তারা নানা নামে চলে। যেমন- বান্দরবানে ব্যাংক ডাকাতি
করেছে রাষ্ট্রদ্রোহী কেএনএফ বাহিনী; অপরাধী হিসেবে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে
তাদের মধ্যে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতিও রয়েছে। তাকে গ্যাংবাদী ছাড়া
অন্যকিছু ভাবা কী সম্ভবপর?
কিশোররা যাবে কোথায়? সুস্থ বিনোদনের জন্য
মিলবে তারা কোনখানে? বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময়ে ছাত্র সংসদ ছিল, এখন নেই।
পাড়া-মহল্লায় খোলা জায়গার খোঁজ পাওয়া যায় না। ঢাকা শহরে থাকার কথা কমপক্ষে
৬১০টি পার্ক, আছে মাত্র ২৩৬টি। গত আট বছরে হারিয়ে গেছে ১২৬টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ুয়া শতকরা ৭৬ জন ছাত্রী জানিয়েছে যে, তারা কোনো না কোনো সময়ে যৌন
হয়রানির শিকার। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল
এবং প্রশ্নের সমাধান ‘বৈজ্ঞানিক’ উপায়ে ক্রেতাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল; এ
কাজে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র এবং কাজটি তারা করেছে অন্য কোনো
স্থান থেকে নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শহিদ ড. জ্যোতির্ময়
গুহঠাকুরতা ভবনের একটি কক্ষ থেকে। কেউ কি কখনো ভেবেছিল যে, স্বাধীনতার জন্য
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে প্রাণ দিতে হবে? এবং স্বাধীনতার পরে তার স্মৃতিকে
ধারণ করবে যে আবাসিক হল তার ব্যবহার হবে ওই ধরনের কর্মে? এবং কাজটা করবে
ছাত্ররাই?
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়