৮১ বছর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নিহত ২৪ জন জাপানি সেনার দেহাবশেষ কুমিল্লা ময়নামতি ওয়ারসিমেট্রি থেকে ফিরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম চালাচ্ছে টোকিও। কবর খনন করে যাচাই-বাছাই করে দেহাবশেষ ফিরিয়ে নিতে কাজ করছে জাপানের একটি বিশেষজ্ঞ দল। ১৩ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে কাজ করবে জাপান ও কমনওয়েলথ গ্র্যাভইয়ার্ড কমিশন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি (যুদ্ধসমাধি) থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ২৪ জন জাপানি সৈনিকের দেহাবশেষ সমাহিত করার ৮১ বছর পর সরিয়ে সনজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে জাপান। তাঁদের দেহাবশেষ সহ এসব সমাধিতে স্মৃতিচিহ্ন যা পাবে তাই নিয়ে যাওয়া হবে। এরই মধ্যে জাপান থেকে ৭ সদস্যের একটি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল ওই ২৪ জাপানি সৈনিকের দেহাবশেষ সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছেন। বিশেষজ্ঞ দলটির সাতজনের মধ্যে ছয়জনই জাপানের নাগরিক। তাঁদের সহায়তা করছে বাংলাদেশ সরকার। সমাধিস্থলের মাটি খুঁড়তেই মিলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত জাপানি সৈনিকদের মাথার খুলিসহ শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়। সেগুলো অত্যন্ত যত্নসহকারে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
জাপানিজ টীম লিডার মি. ইনোওয়ে তাতসুকায়ি জানান, আপাতত সমাধিগুলো খুঁড়ে কি পাওয়া যায় তা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তারপর সেগুলোর ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করা হবে। যেসব সৈনিকদের মরদেহ এসব সমাধিতে আছে তাদের পরিবার স্বান্তনা হিসেবে হলেও দেহাবশেষগুলো চায়- তাই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন এ যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে। দেহাবশেষ স্থানান্তরে তারা জাপানিজ দলকে সহযোগিতা করছে। ২৪ নভেম্বরের মধ্যে এই কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা আছে। সৈনিকদের দেহাবশেষ নিয়ে যাওয়ার কাজের চীফ আর্কোলজিস্ট ফ্রান্সিস মাইকেল জানান, খুব সাবধানতার সাথে এখন মাটি খুঁড়ে স্মৃতিচিহ্ন গুলো সংরক্ষণ করছি আমরা।যতটুকু সময় আমরা চেয়েছি তার চেয়ে বেশি সময়ও লাগতে পারে। আসলে পুরো কাজ শেষ হবার পর আমরা বলতে পারবো-এখান থেকে আমরা কি পেলাম।
কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন বাংলাদেশের কুমিল্লা ওয়ার সিমেট্রির মুখপাত্র লে. কর্নেল (অব) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক জানান, জাপান সরকার ২০১৩ সালে আমাকে তাদের দূতাবাসে ডেকেছিল এই ২৪ জাপানি সৈনিকের দেহাবশেষ সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ওই সময়ে সেটি সম্ভব হয়নি। গত বছর থেকে তারা বিষয়টি নিয়ে আবারও যোগাযোগ করে। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে জাপান সরকার আমাদের সরকারের কাছে চিঠি লেখে এবং কমনওয়েলথের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এই কাজ শুরু করেছে। এখানে জাপানের পক্ষ থেকে সাতজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন, যাঁরা এ কাজে অত্যন্ত দক্ষ। তাঁদের ছয়জন জাপানি ও একজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এই সমাধিগুলো ৮১ বছরের পুরোনো। এরই মধ্যে আমরা ১০ জনের দেহাবশেষ সমাধি থেকে উত্তোলন করতে পেরেছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বিশ্বের ১৩টি দেশের ৭৩৭ জন সৈনিককে এখানে সমাহিত করা হয়। ১৯৬২ সালে একজন সৈনিকের দেহাবশেষসহ সমাধির মাটি তাঁর স্বজনেরা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান।
কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭৩৮ জন সেনাকে সমাহিত করা হয়। ১৩টি দেশের ৭৩৭ জন যোদ্ধার মধ্যে ইসলাম ধর্মের ১৭২ জন, বৌদ্ধধর্মের ২৪ জন, হিন্দুধর্মের ২ জন ও বাকিরা খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৫৭ জন, কানাডার ১২, অস্ট্রেলিয়ার ১২, নিউজিল্যান্ডের ৪, দক্ষিণ আফ্রিকার ১, অবিভক্ত ভারতের ১৭১, রোডেশিয়ার ৩, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬, বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) ১, বেলজিয়ামের ১, জাপানের ২৪ জন এবং পোল্যান্ডের ১ জনের সমাধি আছে। প্রতি বছরের নভেম্বর মাসে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের হাইকমিশনারসহ তাঁদের প্রতিনিধিরা এই সমাধিস্থলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহতদের স্মরণ করেন। সে ধারাবাহিকতায় এ বছরের ৯ নভেম্বর ১৩ দেশের কূটনীতিকেরা সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।