শিকারি সাংবাদিকতা। এক বিশেষ ধারার সাংবাদিকতা। সাংবাদিকের ভূমিকাকে Watchdog roll বলা হয়। রক্ষী কুকুরের মতো বিশ্বস্ত ভূমিকা। জনগণের জন্যে ক্ষমতার ওপর নজরদারি। ক্ষমতাকে নজরদারি করে রাখা। যাতে মানুষের অধিকার রক্ষিত হয়। আর এই Dog যদি শিকার করা বা ধরা শুরু করে তখন যে ভূমিকা বা Roll দাঁড়ায় তাই শিকারি সাংবাদিকতা, Huntingdog বা Lapdog । অতিমাত্রায় শিকারি সাংবাদিকতার প্রচলন ঘটেছে গত কয়েক বছর থেকে। শিকারি সাংবাদিকতা হলো - এক বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সংবাদ পরিবেশন করা। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও একই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে লেখালেখি করেন- এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনের উদ্দেশ্য- প্রধানত রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণ করা।
পুঁজির বিকাশ ঘটেছে, প্রযুক্তি বদলে গেছে, মিডিয়াও বদলে গেছে, যাচ্ছে। মিডিয়া বা গণমাধ্যমের আরও নতুন নতুন বিপদ তৈরি হয়েছে। আরেকটু আগে, বিশেষ করে গত ১০ বছরে সরকারের সহায়তাকারী সাংবাদিকতার ধারা তৈরি হয়েছে। ক্ষমতার সঙ্গী সাংবাদিকতা। যাকে ঠিক কি নামে ডাকা হবে এ নিয়ে বেশ কিছু প্রচলন রয়েছে। এমবেডেড সাংবাদিকতা (Embedded)- একটি সশস্ত্র সংঘাতের সময় সাংবাদিকদের একপক্ষের সামরিক বাহিনীর মধ্যে এবং নিয়ন্ত্রণে রাখার অনুশীলন। এমবেডেড রিপোর্টার এবং ফটোগ্রাফারদের একটি নির্দিষ্ট সামরিক ইউনিটের সাথে সংযুক্ত করা হয় এবং সেনাদের সাথে যুদ্ধ অঞ্চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তারা ওই বাহিনীর ভূমিকায় সংবাদ পরিবেশ করেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রের সাংবাদিকতায় এমনটাই দেখা যায়। প্রায় একই ধারায় সাংবাদিকতা ক্ষমতারও সঙ্গী হয়। তখন তার ভদ্রোচিত নাম হয় উন্নয়ন সাংবাদিকতা, ধন্যবাদ সাংবাদিকতা- ক্ষমতার সঙ্গী সাংবাদিকতা। এরই একটি ধারা যাকে শিকারি সাংবাদিকতা বলা হচ্ছে। যেখানে ক্ষমতার সাথে সাংবাদিকতার চর্চা ও ভাষা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এই চর্চা পরিষ্কার ভাবে আক্রমণকারী রুপে হাজির হয়। এবং বেশ আক্রমণাত্মক। শিকারকে ঘায়েল করাই উদ্দেশ্য।
ওয়াচডগ (Watchdog) সাংবাদিকতা হল অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতার একটি রূপ যেখানে সাংবাদিক, লেখক বা প্রকাশকরা সংবাদ প্রকাশের সত্যতা যাচাই করেন এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা -সুশাসন বাড়াতে রাজনৈতিক পক্ষ ও জনসাধারণের যোগাযোগকারী মাধ্যম হয়ে ওঠে। আর বিপরীতে লেপডগ (Lapdog) সাংবাদিকতা হচ্ছে যে কেউ এমন কিছু করতে ইচ্ছুক যা একজন আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাদের করতে বলে, বিশেষ উদ্দেশ্যে - উদ্দেশ্যপ্রবন। আর এমবেডেড (Embedded) সাংবাদিকতা হচ্ছে- বিভিন্ন দেশে মিলিটারি অপারেশনে যাচ্ছে সাথে একদল সাংবাদিক এমবেডেড থাকছেন। ওদের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকেই তারাও সংবাদ প্রচার করছেন। কুয়েত, ইরাক ও আফগান আক্রমণে এমনটাই দেখা গেছে। শিকারি সাংবাদিকতা হচ্ছে সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা ও অন্যান্য ক্ষমতা কাঠামো পক্ষ বা Power stakeholder- দের সাথে একত্রে কাজ করে- শিকার করা। যাকে সরকার বা তারা পছন্দ করছেন না তাদের শিকার করে। এবং তারা একই সাথে সাধারণ মানুষকেও শিকার বানায়। সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টকে শিকার করে। এ ক্ষেত্রে মানুষের বড় তিনটি সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করা হয়। যার একটি জাতীয়তাবাদ, অন্যটি ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট আর জেন্ডার সেন্টিমেন্ট।
শিকারি সাংবাদিকতার প্রবণতা বাংলাদেশে কখন দেখা গেলো। অধিক প্রবণ হিসেবে দেখা গেলো ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালে, বাংলাদেশে যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হলো। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল জলিল ২৮ মে ২০০৭ গ্রেফতার হলেন। তখন মিডিয়াতে গোয়েন্দাদের দেওয়া ভাষ্যই রিপোর্ট হিসেবে আসতে শুরু করলো। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক অচলাবস্থা খালেদা- হাসিনা গ্রেফতার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে এর উত্থান- চর্চা জোরালো হয়েছে। থেমে যায় নি। কেয়ারটেকার সরকার চলে যাওয়ার পর শিকারি সাংবাদিকতার একটা ভিন্ন চর্চা- ভিন্ন চেহারায় দেখা দিল। তার আগেও এমন চর্চা ছিল না, তেমনটা নয়। কিন্তু ধারা হিসেবে কার্যকর হয়েছে তখন থেকেই জোরালো ভাবে, যা পরবর্তীতে প্রবণ হতে থাকলো।
যার সর্বোচ্চ চর্চা দেখা গেছে মুনিয়া হত্যাকাণ্ড ঘিরে। আত্মহত্যা না হত্যা, চরিত্র হনন, পরিবারের সদস্যরা আক্রমণের শিকারে পরিণত করা, সব চেষ্টাই হয়েছে। মুনিয়া কতটুকু খারাপ ছিল তার চেয়ে বড় কথা সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। কেন সে বেঁচে থাকার অধিকার হারালো, সেটাই সাংবাদিকতার নৈতিকতা (Morality) হিসাবে বিবেচিত হওয়ার কথা ছিল। মুনিয়ার অবস্থান থেকে রিপোর্ট হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু শুরুতে তা হয়নি। রিপোর্ট হলেও অপরাধীকে নানা কায়দায় আড়ালের চেষ্টা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ দাঁড়ালো, আস্তে আস্তে মূলধারার গণমাধ্যম বেশ সর্তকতায় এগুলো। আর বিপরীতে শিকারি সাংবাদিকতা তার সর্বোচ্চ দিয়ে ঘটনা রুখে দিতে পেরেছিল। এরপরের ঘটনা সবারই জানা।
গবেষনায় বাংলাদেশের বেগুনে ক্যান্সারের উপাদান পাওয়া বিজ্ঞানী অধ্যাপক জাকির হোসেনকে টিভি আলোচনায় ডেকে এনে তাচ্ছিল্য করাসহ সাধারণ শিষ্টাচার বহির্ভূত শিকারি সাংবাদিকতার সরকারপক্ষীয় টেলিভিশন টকশো আমাদেরকে বাধ্য হয়ে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। গবেষণার ফল প্রকাশ করে বিজ্ঞানী ফৌজদারি অপরাধ করেছেন এমন আক্রমণাত্মক সাংবাদিকতার শিকার হয়েছেন তিনি। পরিমনির বোট ক্লাবের ঘটনা পরবর্তী সাংবাদিকতাও বেশ আক্রমনাত্মক ছিল। কারণ ঘটনার অপরপক্ষ পুলিশ প্রধান বা ক্ষমতাবান গোষ্ঠী বা ব্যক্তি ছিলেন। এসব সবারই জানা।
হেফাজতের মামুনুল হক সরকারের সাথে সমঝোতা থেকে সরে যেতে শুরু করেছিলেন। তাকে ধরা হলো নারায়ণগঞ্জের রিসোর্ট থেকে। সাথে সাথে তার প্রাইভেট জীবনকে পাবলিক করা হলো। ব্যক্তিগত টেলিফোনে প্রথম স্ত্রীর সাথে কথোপকথন সাংবাদিকতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠলো। ব্যক্তিগত কথোপকথনও পাবলিক করে দেওয়া হলো। তার চরিত্রের নানা দিক- নারী কেলেংকারী নিয়ে সাথে সাথেই প্রপাগাণ্ডা সংবাদ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। ক্ষমতা লক্ষ্য সফল করলো। ঘটনা নিন্দনীয় ছিল নিসন্দেহে, কারণ তিনি ধর্মীয় গুরু।
গণমাধ্যম (Mass media) যাত্রা শুরু করেছে আধুনিক রাস্ট্রের (Modern estate) সাথে। আগের চার্চের ভূমিকায় এখন ওয়াচ ডগ ভূমিকা পালন করছে গণমাধ্যম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রেসের (Press) এমন ভূমিকা ক্রমাগত সংকুচিত হতে থাকে। অবশ্য এইসবই ইউরোপ- আমেরিকার আইডিয়া। এইসব আইডিয়াই আমরা বিভিন্ন দেশে চর্চা করতে শুরু করি। আস্তে আস্তে কিছু অল্প মানুষের আধিপত্য, কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে। যেমন ৮০ দশকে বিশ্বে ৫০ টি কর্পোরেশন সারা বিশ্বের সংবাদ নিয়ন্ত্রণ করতো। ৯০ দশকে তা নেমে এলো ২৭ টিতে। এর কয়েক বছরের মধ্যে এটা ৭ এখন ৫-৬ টা কর্পোরেশন গ্লোবাল নিউজ এজেন্সিকে ডমিনেট করে। আমেরিকায় ডেমোক্রেটিক সোসাইটি সেখানে সাংবাদিকরা খুব স্বাধীন ভাবে তাদের রোল প্লে করে। সেখানেও নানা ফিল্টারের কারনে সাংবাদিকতা বিশেষ গোষ্ঠীর প্রোপাগাণ্ডা চালায়। যখন ক্ষমতা কাঠামোর মধ্য দিয়ে সংবাদ ফিল্টার হয়ে আসে তখন তা আর গণমানুষের স্বার্থ রক্ষা করে না। পুঁজির বিকাশ ও রুপান্তর সাংবাদিকতা চরিত্রের গতিপথ নির্ধারণ নিয়ামক। কর্পোরেট পুঁজির আধিপত্য সাংবাদিকতায় এক ধরনের পরিবর্তন ঘটালো। ডিজিটালইজেশনও পরিবর্তন আনলো। ৯০ দশকে আরেকটা রুপান্তর লক্ষ্যনীয়। দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশ। এগ্রেসিভ ইকোনমিক পর্যায়ের সাথে ভায়োলেন্স ও ভীতির অতোপত সম্পর্ক। তাইতো প্রথমআলোর ভূমিদস্যুতার সংবাদের বিপরীতে নতুন কাগজ- কালেরকণ্ঠের জন্ম ও যাত্রা শুরু।
এবার আসা যাক প্রযুক্তি। ডিজিটাল যুগের সাংবাদিকতা। অসংখ্য পোর্টাল। অনুমোদিত অননুমোদিত মিলে। জাতীয় স্থানীয়। ছাপা কাগজ, টিভিরও পোর্টাল আছে। সাথে ইউটিউব। যেখানে ব্যক্তিগত কথোপকথন মুহূর্তে পাবলিক করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যক্তিগত স্ক্রিনশর্ট নিয়ে পাবলিক করে ভিউ বাড়ানোর একধরনের প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। যেখানে দায়িত্বশীলতা অসহায় হয়ে পড়ে প্রায়শই। এতে সংবাদ চরিত্র হারায়।
বাংলাদেশেও ইউরোপ আমেরিকা মডেলের সাংবাদিকতাকেই মানদণ্ড মনে করা হয়। অথচ এখানকার সমাজ কাঠামো, শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতি ভিন্ন চরিত্রের। এই সম্পর্কগুলো সম্পূরক। এসবই সাংবাদিকতার গতিপথ বা চরিত্র নির্ধারণ করে। তাই সেই অর্থে এখানকার সাংবাদিকতা কখনই মুক্তচর্চা হয়ে উঠতে পারে নি। যেমন গণমাধ্যম প্রেস হয়েছে প্রকৃত বিবেচনায় জনগণের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে নি কখনই।
৮০ দশক ও পরবর্তী বাংলাদেশ প্রেক্ষিত সাংবাদিকতায় মালিকানার ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। বিশেষ করে টিভি ও অন্যান্য। এখানে পারিবারিক মালিকানার ব্যাপারতো আছেই। সরকারের সাথে ওই মালিকানার ওতোপ্রোত সম্পর্ক। অবশ্য শিকারী সাংবাদিকতা ব্যাখ্যার জন্যে শুধু মালিকানার ধরনের বদল দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
শিকারী সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটে স্বৈরাচারী- একচেটিয়া - কর্তৃত্ববাদী সরকার যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে। তখন সে সাংবাদিকতাকে সঙ্গী করে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে চায়। পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশে শিকারী সাংবাদিকতার প্রকাশ ও বিস্তৃতি ঘটেছে মারাত্মক পর্যায়ে। এটি শুধু আক্রমনাত্মক ছিল না, একই সাথে নিপীড়নমূলকও হয়ে উঠেছিল। যেমন ডিজিটাল নিরাপত্ত আইন। আবার ব্যয় বা খরচ সামাল দিয়ে টিকে থাকতে গিয়েও শিকারী সাংবাদিকতার আশ্রয় নিতে হয়। সাংবাদিকদের শ্রমের অধিকার নিয়ে কার্যত এখনও তেমন কিছু হয় নি। মফস্বলের অবস্থা বেশ করুন।
প্রতিকারের উপায় কি। কেমন করে। সম্ভব কিনা। ব্যাপক আলোচনা দরকার। পুজিঁ, শাসন এসব প্রধানতম নিয়ামক। তাই ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন দরকার। সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন দরকার। সুশাসন প্রতিষ্ঠা দরকার। গণতন্ত্র বিকাশ ও চর্চার সুযোগ দরকার। এমন বেশ কিছু দরকার মিললে প্রতিকার ঘটে যাবে। না হলে ভারতের গদি মিডিয়া- মদি মিডিয়া আর আমাদের হাসিনা মিডিয়া- এর নানা রুপান্তর ঘটবে। চর্চা কিন্তু থেমে নেই।
পরিচিতি: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।