অবসরপ্রাপ্ত
সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন
গঠন করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, যে কমিশনের ওপর থাকবে পরবর্তী
জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ভার। নতুন কমিশনে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে
থাকছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ
আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তহমিদা আহমদ এবং অবসরারপ্রাপ্ত
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
সার্চ কমিটির প্রস্তাব
করা নামের তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি এই পাঁচজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং
নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বেছে নেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বৃহস্পতিবার আলাদা
প্রজ্ঞাপনে তাদের নাম প্রকাশ করে।
দেশের চতুর্দশ সিইসি হিসেবে নিয়োগ
পাওয়া নাসির উদ্দীন এক সময় ছিলেন সচিব। অন্তর্র্বতী সরকার সম্প্রতি তাকে
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিল। এবার তাকে
দেওয়া হল নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।
নিয়োগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক
প্রতিক্রিয়ায় নাসির উদ্দীন বলেন, “অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের
জন্য যা যা করা দরকার, তা তা করব ইনশাআল্লাহ। এ দায়িত্ব যখন আসছে, আমাদের
সুষ্ঠুভাবে পালন করতে হবে সবার সহযোগিতা নিয়ে।”
দেড় মাস ধরে শূন্য থাকা নির্বাচন কমিশনের অধিকারীরা কবে শপথ নেবেন, সেই তারিখ এখনো জানানো হয়নি।
বিগত
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গঠিত কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন
কমিশন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে।
সেই
কমিশনে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল
আহসান হাবিব খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ রাশেদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত
জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান।
তাদের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ
নির্বাচন হয়েছিল। বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মধ্যে গত জানুয়ারিতে সেই
নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তার আট মাসের মাথায়
গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়।
নতুন যারা, কারা তারা:
সিইসির
শূন্য পদ পূরণ করতে যাওয়া নাসির উদ্দীনের বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়,
জন্ম ১৯৫৩ সালের ১ জুলাই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর
করার পর ১৯৭৭ সালে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষক হিসেবে।
দুই বছর পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। প্রশাসন ক্যাডারের এ ব্যাচটি বিসিএস ৭৯ ব্যাচ হিসেবে পরিচিত।
দীর্ঘ
কর্মজীবনে তথ্য সচিব, জ্বালানি সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও স্বাস্থ্য
মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অবসরে যান ২০০৯
সালের জানুয়ারিতে।
নতুন কশিনারদের মধ্যে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো.
আনোয়ারুল ইসলাম অবসরে যাওয়ার আগে দায়িত্ব পালন করেছেন সরকারের টেকসই ও
নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে।
২০১৬ সালে
ভারপ্রাপ্ত সচিব পদমর্যাদায় তাকে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা
কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। তার আগে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক
হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তাহমিদা আহমেদ
২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব
(আইন) হিসেবে দায়িত্ব পান। ওই বছরই তিনি প্রথমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের
যুগ্ম সচিব এবং পরে পাট অধিদপ্তরের পরিচালক হন।
অবসরারপ্রাপ্ত
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ পাকিস্তানের ইসলামাবাদে
বাংলাদেশ হাই কমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ছিলেন। বিগত সরকার ২০২০ সালে
তাকে মিনিস্টার পদের কূটনৈতিক পদমর্যাদায় এ পদে নিয়োগ দেন।
১৮তম বিএমএ লং কোর্সের এ সেনা কর্মকর্তা ৩৫ বছর মিলিটারি সার্ভিসে ছিলেন।
যেভাবে নিয়োগ:
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২ এর অধীনের নতুন ইসি গঠনে ৩১ অক্টোবর এ সার্চ কমিটি গঠন করা হয়।
আইনে
বেধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি
ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ১০
জনের নাম জমা দেয় এই কমিটি।
সার্চ কমিটি প্রস্তাবিত তালিকা থেকে একজনকে
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং চারজনকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেন
রাষ্ট্রপতি। তাদের মেয়াদ পাঁচ বছর।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন
অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ইতোমধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের
কাজে হাত দিয়েছে। সেই সংস্কার শেষে নতুন ইসির অধীনে হবে ত্রয়োদশ সংসদ
নির্বাচন।
অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের তরফে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ন্যূনতম ঐক্যমত্যের’ উপর নির্ভর করছে নির্বাচনের ‘টাইমলাইন’।
গত
৩ নভেম্বর সার্চ কমিটি চার দিন সময় দিয়ে (৭ নভেম্বরের মধ্যে) নতুন
নির্বাচন কমিশন গঠনে নাম চেয়েছিল। নির্ধারিত সময়ে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী
সংগঠনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়েও আগ্রহী ব্যক্তিরা নাম প্রস্তাব করেন।
ছয়
সদস্যের এই সার্চ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের
রহমান চৌধুরী। সদস্য হিসেবে ছিলেন হাই কোর্টের বিচারপতি এ কে এম
আসাদুজ্জামান, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান
অধ্যাপক জিন্নাতুন নেছা তাহমিদা বেগম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও
নিয়ন্ত্রক মো. নূরুল ইসলাম এবং পিএসসির চেয়ারম্যান মোবাশ্বের মোনেম।
সার্চ কমিটি কত জনের নাম পেয়েছে এবং কোন ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
যারা ছিলেন সিইসি:
দেশে
এর আগে ১৩ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং ৩১ জন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে
দায়িত্ব পালন করেন। তাদের অধিকাংশই নাসির উদ্দীনের মত অবসরপ্রাপ্ত আমলা।
এবার নিয়ে টানা পঞ্চমবার সিইসি পদে নিয়োগ পেলেন সাবেক সচিব, যার শুরু
হয়েছিল এ টি এম শামসুল হুদার মাধ্যমে। শামসুল হুদার আগের কমিশনে একজন
বিচারক থাকলেও তার আগে আবার ছিলেন আমলা।
১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতিরা। এরপর ইসিতে শুরু হয় সাবেক আমলাদের নেতৃত্ব।
মাঝখানে
২০০৫ সালে এক বছর সাত মাস একজন বিচারপতি ছাড়া গত প্রায় তিন দশক সাবেক
আমলারাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
কে এম নূরুল হুদা: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২
কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ: ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
এ টি এম শামসুল হুদা: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি
বিচারপতি এম এ আজিজ: ২৩ মে ২০০৫ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০০৭
এম এ সাইদ: ২৩ মে ২০০০ থেকে ২২ মে ২০০৫
মোহাম্মদ আবু হেনা: ৯ এপ্রিল ১৯৯৬ থেকে ৮ মে ২০০০
বিচারপতি এ কে এম সাদেক: ২৭ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে ৬ এপ্রিল ১৯৯৬
বিচারপতি আব্দুর রউফ: ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে ১৮ এপ্রিল ১৯৯৫
বিচারপতি সুলতান হোসেন খান: ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯০
বিচারপতি চৌধুরী এ টি এম মাসউদ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০
বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম: ৮ জুলাই ১৯৭৭ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫
বিচারপতি মো. ইদ্রিস: ৭ জুলাই ১৯৭২ থেকে ৭ জুলাই ১৯৭৭
সিইসির
দায়িত্বে বিচারপতিদের মধ্েয মো. ইদ্রিস ও এটিএম মাসউদ এবং সাবেক আমলাদের
মধ্েয এম এ সাঈদ, শামসুল হুদা, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ও নূরুল হুদা পাঁচ বছর
মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছেন।