আঠারো শতকে যখন ইংল্যান্ডে মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন সেটি ছিল একটি বেসামরিক পুলিশ বাহিনী যা বেসামরিক নয় এবং বেসামরিক কমান্ড দুটোর অধীনেই কাজ করতো। ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপনকারী দেশগুলো সাধারণ মানুষকে শোষণ করা শুরু করে।
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকে সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে পুলিশকে তারা ব্যবহার করা শুরু করে এবং পরবর্তীতে তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার পর অনেক দেশই পুলিশকে জনগণের নিরাপত্তার কাজে ব্যবহার না করে মিলিটারাইজশনের মাধ্যমে এই সংগঠনকে জনগণের বিরুদ্ধে কিংবা কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক স্বার্থ অর্জনের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।
জুলাই-আগস্ট বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পুলিশকে অস্ত্রায়ন ও সামরিকীকরণের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের দাবি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
যেহেতু বাংলাদেশ পুলিশ দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তাই এই আইনগুলো বাংলাদেশে একটি আধুনিক জনবান্ধব পুলিশিং গড়ে তুলতে সক্ষম কিনা তা নিয়ে অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ পুলিশ মূলত ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন দ্বারা পরিচালিত, এর সাথে সাথে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি; সাক্ষ্য আইন ১৮৭২; পুলিশ রেগুলেশন অফ বেঙ্গল ১৯৮৩ এবং অন্যান্য বিশেষ আইন দ্বারাও নিয়ন্ত্রিত হয়।
১৯৭৬ সালে সরকারি বিভিন্ন কমিটিতে পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়োগ ব্যবস্থা পৃথকীকরণ, পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং ট্রেনিং ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়। এরপর ১৯৮৮ সালের কমিশন পুলিশের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছিল, যার মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত পুলিশের অভাব, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অপসংস্কৃতি, জনগণের আস্থার অভাব, ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ নীতি, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং দুর্নীতি।
পরবর্তীতে জাতীয়ভাবে পুলিশ সংস্কার প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেখানে কমিউনিটি ব্যবহারের পাশাপাশি পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আইসিটি অবকাঠামোর উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। একইসাথে একটি পুলিশ অর্ডিন্যান্স খসড়া নীতি ২০০৭ চূড়ান্ত করা হয়, যেটি বাংলাদেশে পুলিশের সাংগঠনিক এবং সাংস্কৃতিক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত, জনগণের কাছে জবাবদিহিতামূলক করতে এবং বাহিনীর পরিবর্তিত মানসিক কাঠামোর সাথে, পেশাগত দায়িত্বের দিক থেকে আরও দক্ষ করে তুলতে পারে।
পুলিশ অধ্যাদেশে যদিও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবিধান যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু এই আইনটি কার্যকর না হওয়ায় পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা এবং পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণকে নিপীড়ন করা বাহিনীর মৌলিক নীতিগুলোর অংশ হয়ে রয়েছে।
সম্প্রতি জনবান্ধব ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। যেহেতু বাংলাদেশে পুলিশের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে সাধারণ মানুষ এবং পুলিশের মধ্যে বিশ্বাসহীনতার সুযোগ এবং অনাস্থা তৈরি হয়েছে সেহেতু এই সংস্কার কমিটি জনগণের সাথে পুলিশের সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের ক্ষেত্রে কার্যকর নীতি সুপারিশ করবেন বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি।
যদিও বাংলাদেশের পুলিশের অনেক সাফল্য রয়েছে, জাতিসংঘ মিশনে দায়িত্ব পালন কিংবা করোনাকালীন সময়ে দায়িত্ব পালন কিংবা সন্ত্রাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের পুলিশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পুলিশের বর্তমান অবস্থা একদিকে যেমন রাজনৈতিক শোষণ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার ফল, তেমনি অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ অফিসার আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর জনগণের অধিকারহরণ (কখনো অসদাচরণ, গুম, অকারণে মামলার আসামি) করেছে। কিছু মৌলিক সংস্কার প্রয়োজনীয় এবং আবশ্যক বলে মনে করি-
স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা:
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী কখনো কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতের অসংখ্য অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে। স্বাধীন তদারকির অভাব, পুলিশ সাব কালচারের প্রভাব এবং দায়মুক্তির এই প্র্যাকটিসগুলো সাংগঠনিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ও তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পুলিশের বিরুদ্ধে অসদাচরণ তদন্ত ও অনুসন্ধানের জন্য বেসামরিক রিভিউ বোর্ড বা স্বাধীন সংস্থা স্থাপন করেছে যা পুলিশ কার্যক্রমের তদারকি প্রদান করে। এই ধরনের ব্যবস্থা পুলিশের জনসাধারণের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে যার ফলে সাংগঠনিক স্বচ্ছতা এবং জনগণের আস্থা বজায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই বাংলাদেশে স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে পুলিশের অসদাচরণের তদন্ত পর্যবেক্ষণ এবং তার নিয়মিত প্রতিবেদনসহ প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হওয়া উচিত।
প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন:
বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী প্রায়শই তার পেশাদারিত্বের অভাবের জন্য সমালোচিত হয়, অনেক কর্মকর্তা মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা বা ডি-এস্কেলেশন কৌশলগুলোয় অপ্রশিক্ষিত। যেহেতু অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে পুলিশ নিয়োগ ও প্রমোশন দেওয়া হয়ে থাকে, অনেক অফিসারই আধুনিক পুলিশিং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষ নয়।
পুলিশ নিয়োগের পর বিশ্বের অনেক দেশে তিন থেকে ছয় মাসের পুলিশ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। শারীরিক তৎপরতা, শক্তি, ফিটনেস এবং এর পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক বা অন্যান্য পরীক্ষারও প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে দক্ষ করে তুলতে হলে অবশ্যই বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ যেমন-উত্তপ্ত পরিস্থিতি কমাতে এবং শক্তির ব্যবহার রোধ করার কৌশলগুলোর প্রশিক্ষণ, নিরাপদ থাকার কৌশলগুলোর প্রশিক্ষণ, অন্তর্নিহিত পক্ষপাত দূরীকরণ এবং জাতিগত সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ, ট্রমাজনিত পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়, মানবাধিকার, নৈতিক আচরণ, বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
মেধার ভিত্তিতে পুলিশ নিয়োগীকরণ :
শুধুমাত্র যোগ্য এবং সক্ষম ব্যক্তিদের একটি স্বচ্ছ নিয়োগ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই পেশায় নিযুক্ত করতে হবে। নির্বাচনের মানদণ্ড হতে হবে কঠোর এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত। নতুন নিয়োগকারীদের অপরাধমূলক ইতিহাস, আর্থিক রেকর্ড এবং মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়নসহ ব্যাপক পটভূমি পরীক্ষা করে উপযুক্ত এবং দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিদের পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।
কার্যকর কমিউনিটি পুলিশিং বা নেবারহুড ওয়াচ ব্যবস্থা:
বাংলাদেশের পুলিশ এবং জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি না হলে কখনোই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কমিউনিটি পুলিশিং, যার মধ্যে পুলিশ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করা, এই বিশ্বাসকে পুনঃনির্মাণ করতে, আইন প্রয়োগকারী এবং জনসাধারণের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। জননিরাপত্তামূলক যেকোনো কার্যক্রমে কমিউনিটি পুলিশিং-এ স্থানীয় সংস্থা, নারী, যুবক শ্রেণি এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের সাথে অংশীদারিত্ব গঠন করা উচিত।
পেশাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি:
যেহেতু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২৪ ঘণ্টা নিযুক্ত একটা পেশা এবং অপরাধ দমন, তদন্তসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে পুলিশের সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হয়, তাই কাজের কর্মঘণ্টা কমিয়ে কিংবা বেতন বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে এবং এই পেশাকে রাষ্ট্রের যতটুকু সম্ভব সম্মান দিতে হবে।
একই সাথে পুলিশ স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট উন্নত করার জন্য সাংগঠনিকভাবে কিছু কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যেমন মননশীলতা অনুশীলন, পিয়ার সাপোর্ট গ্রুপ মিথস্ক্রিয়া, রিলাক্সেশন ট্রেনিং, প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা বা থেরাপি নেওয়া, সহকর্মীদের এবং নেতৃত্বের সাথে খোলা যোগাযোগ প্রভৃতি। তাহলে পুলিশ পেশার জটিল প্রকৃতির সাথে অফিসাররা আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার কিন্তু প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী কাজ। দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জর্জরিত বর্তমান ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং পুলিশ যাতে সততার সাথে জনসাধারণের সেবা করে তা নিশ্চিত করার জন্য টেকসই সংস্কারের প্রয়োজন।
একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে, প্রশিক্ষণ ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে, নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার করে, কমিউনিটি পুলিশিং প্রয়োগ করে, বাংলাদেশ একটি সৎ ও দক্ষ পুলিশ বাহিনী তৈরি করতে পারে যা ভবিষ্যতে তার নাগরিকদের চাহিদার প্রতি স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক। তাই পুলিশ সংস্কার কমিশন উপরের বিষয়গুলো মাথায় রেখে তাদের গঠনমূলক সুপারিশের মাধ্যমে বাংলাদেশে শক্তিশালী ও জনমুখী পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশা প্রকাশ করি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও এক্স চেয়ার, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডিরত)