দেশে
বিভিন্ন ধরনের যে বৈষম্য রয়েছে তা নিরসন করতে চাইলে সুচিন্তিতভাবে সরকারকে
নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র
আন্দোলনের নেতৃত্বকে আরও সচেতনভাবে ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিতর্কিত হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। দেশে আয়-ব্যয়বৈষম্য কীভাবে
দূর করে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর সাধারণ নাগরিকদের আস্থা ফেরানো যায়,
সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।...
প্রায় প্রতিদিনই সকালে জগিংয়ে বের
হই। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে এর চেয়ে ভালো বিকল্প নেই। জগিং থেকে ফিরেই এই
লেখাটি তৈরি করছি। জগিংয়ের সময় আমার বন্ধুরা আলাপকালে তাদের ব্যাংকের
ডিপোজিট ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছিলেন। আমাদের জগিংয়ের টিমে থাকা
চারজনের মধ্যে তিনজনই জানালেন দীর্ঘদিন থেকে ব্যাংকে গচ্ছিত ছোট ছোট অঙ্কের
টাকা যখন কিছুটা বড় হয়েছে, তখন তারা ঠিকভাবে ফেরত পাচ্ছেন না।
এই
মুহূর্তে কারও বুঝতে বাকি নেই যে, দেশের কোন ব্যাংকগুলো এমন তারল্যসংকটে
রয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক টাকা বিদেশে পাচার হওয়ায় এমন সংকট
হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এই সংকট কবে সমাধান হবে, তা এখনো
নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন থেকে অল্প অল্প করে জমানো টাকা যদি
ব্যাংক ফেরত দিতে না পারে- তাহলে দেশের মানুষের আস্থা অর্থনৈতিক অন্যান্য
প্রতিষ্ঠানের প্রতি কি মোটেও রাখা সম্ভব হবে?
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে কীভাবে এই সংকট দ্রুততম সময়ে মোকাবিলা করা যায়।
সরকারের পক্ষ থেকে সমাধানের চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে অন্যান্য অর্থনৈতিক সংকট
দেশে দানা বেঁধে উঠছে। এরই মধ্যে আমরা লক্ষ করেছি অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান
বন্ধ হয়েছে। এমনকি আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা
দিয়ে বাড়ছে আয়বৈষম্য। শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় বেকারত্বও বেড়ে চলেছে।
অভাব-অনটন এবং অন্যান্য বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক এবং
শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে।
গত জুলাই-আগস্টে
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল দেশে কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না।
মেধাবীদের চাকরিতে সুযোগ লাভের বিষয়টিতে বৈষম্যহীন অবস্থা প্রতিষ্ঠার
লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলনের যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে সব ধরনের বৈষম্য
নিরসনের আন্দোলনে পরিণত হয়। ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ করেছি যে, বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলন একটি সংগঠিত প্রতিষ্ঠানে রূপ লাভ করেছে। ফেসবুকে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে যে একটি পেজ রয়েছে সেটি ইতোমধ্যেই
অফিশিয়ালি ভেরিফায়েড করা হয়েছে।
এ অবস্থা থেকে অন্তত আমি সহজেই অনুমান
করছি যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি স্থায়ী সংগঠন হিসেবে রূপ লাভ
করতে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, এই সংগঠন দেশের সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে
সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘদিন থেকে যে বৈষম্যের সিস্টেম গড়ে উঠেছে, তা
ভেঙে দিতে সক্রিয় থাকবে। আর তা যদি না হয় তাহলে আমরা আর কোনো দিনও বৈষম্য
নিরসনের স্বপ্ন দেখতে পারব না। বরং অন্যায়ভাবে বৈষম্য বেড়ে যাবে
দ্রুতগতিতে।
গত ৫ আগস্টের পর আমরা প্রত্যাশা করেছি যে, খুব দ্রুতই দেশে
বৈষম্য নিরসন হবে। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা বাস্তবায়নের রাস্তা মোটেও
পরিষ্কার হচ্ছে কিনা- সেটি বলা মুশকিল।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, সত্যিই কি
দেশে বৈষম্য নিরসন হবে? নাকি নানা সংকটে বৈষম্য বেড়ে যেতে পারে। আমরা
জানি, নানা ধরনের বৈষম্যের মধ্যে ধনী-গরিব বৈষম্য প্রকট। আয়বৈষম্য তো
রয়েছেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে আয়বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায়
কার্যক্রম পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়।
বিভিন্ন প্রেক্ষিতেই দেশ এখনো নানাবিধ
কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একদিকে মানুষের জীবন বাঁচানো, অন্যদিকে
অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা। এই নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে সমাজে শিক্ষিত,
সম্মানীয় অথচ বেকার এমন শ্রেণির মানবেতর জীবনের দিকে লক্ষ রেখে সরকারের
উচিত প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যাতে তাদের জীবনটা সুন্দর
হয়। আসলে এমন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশের মোট
জনগোষ্ঠীর কোনো সুনির্দিষ্ট ডেটাবেইজ নেই। মোট জনসংখ্যার পেশা, বয়স, আয়,
পারিবারিক নির্ভরশীলতা প্রভৃতি বিবেচনায় নির্দিষ্ট একটি ডেটাবেইজ দেশের
যেকোনো সংকট মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশেষ করে কতসংখ্যক
জনসাধারণ চাকরিজীবী (পেশাভিত্তিক আলাদা), ব্যবসায়ী, গাড়িচালক, রিকশাচালক,
চায়ের দোকানদার, ফুটপাতের হকার, কৃষক-শ্রমিক, কুলি, মজুর, পোশাক কারখানার
কর্মী, মিল-কারখানার কর্মী, ব্যবসায়ী (ধরন অনুযায়ী) প্রভৃতির যথাযথ তালিকা
কিংবা ডেটাবেইজ আজ পর্যন্তও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। হয়তো এ বিষয়ে পরিসংখ্যান
আছে। কিন্তু পরিসংখ্যান আর ডেটাবেইজ এক নয়। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কোনো
কিছু অনুমান করা যায়। তবে ডেটাবেইজের ভিত্তিতে যেভাবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ
গ্রহণ করা সম্ভব সেটি তথাকথিত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ
এমন একটি দেশ যেখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনসাধারণ যারা দিন এনে দিন খায়।
এদের সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে থাকা দরকার। একটি পরিবারে, একটি
মহল্লায়, একটি পাড়ায়, একটি গ্রামে, একটি ইউনিয়নে, একটি শহরে, একটি উপজেলায়,
একটি পৌরসভায়, একটি সিটি করপোরেশনে এবং একটি জেলায় আলাদা ইউনিটে কতসংখ্যক
মানুষ, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত রয়েছে তার সুনির্দিষ্ট
তথ্য কিংবা ডেটাবেইজ থাকলে যেকোনো বৈষম্য নিরসন করা সহজ হবে।
একটি
রাষ্ট্রে কত জনসংখ্যা বসবাস করে, কার নাম কী, কার মাসিক আয় কত, কার পেশা কী
এ বিষয়ে একটি ডেটাবেইজ করা কঠিন হলেও কাজটি একেবারে অসম্ভব নয়। দেশের
বিভিন্ন বাহিনীর সহযোগিতায় দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে এই কাজটি
একবার সম্পন্ন করতে পারলে নানা দুর্যোগের মুহূর্তে সরকারের যেকোনো উন্নয়ন
কার্যক্রম এবং দুর্যোগকালীন যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হবে। এমনকি এর
ভিত্তিতে দেশে আয়বৈষম্য কিছুটা হলেও কমানো যাবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা
যায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জাতীয় খানা জরিপ (এনএইচডি)
প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি তালিকা করার
উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। জরিপের কাজও শেষ। কিন্তু তালিকাটি এখন পর্যন্ত
তৈরি হয়নি। গোটা দেশের জনসংখ্যাকে একটি জাতীয় ডেটাবেইজের আওতায় আনতে পারলে
বহুমুখী সমস্যা সমাধানে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। বিশেষ করে
শিক্ষিত বেকার, অশিক্ষিত বেকার, উচ্চশিক্ষিতদের সংখ্যাসহ নানা ক্যাটাগরির
তথ্য সংকলন সম্ভবপর করা যেতে পারে এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
দেশে
বিভিন্ন ধরনের যে বৈষম্য রয়েছে তা নিরসন করতে চাইলে সুচিন্তিতভাবে সরকারকে
নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র
আন্দোলনের নেতৃত্বকে আরও সচেতনভাবে ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বিতর্কিত হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো অন্যায্যতাকে সহজে
প্রশ্রয় না দিয়ে সুশাসনের নিমিত্তে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। দেশে
আয়-ব্যয়বৈষম্য কীভাবে দূর করে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর সাধারণ নাগরিকদের
আস্থা ফেরানো যায়, সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। নানাবিধ বৈষম্য ও সংকট
উত্তরণে টেকসই ও স্থায়ী প্রস্তুতি হিসেবে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি সেসব
বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়