বাংলাদেশের
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উদ্বেগজনক বলতে হবে। এখনো আমাদের অর্থনীতি
শক্ত ভিত্তির ওপর পুরোপুরি দাঁড়াতে পারেনি। ফলে অর্থনীতি একটা বড় রকম
ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আছে। বর্তমান
বিশ্বায়নের যুগে যেকোনো দেশের অর্থনীতি বাইরের পৃথিবীর পরিস্থিতির দ্বারা
প্রভাবিত হয়। বহিঃখাত থেকে যে অভিঘাতগুলো আসছে তা অভ্যন্তরীণভাবে মোকাবিলার
চেষ্টা করতে হবে।...
দেশে খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের মূল্য
অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন খুবই কষ্টসাধ্য
হয়ে উঠেছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে মূল্যস্ফীতিকে আরও
অসহনীয় করে তুলছে। এর পেছনে বিগত সরকারের অব্যবস্থাপনা বহুলাংশে দায়ী।
কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী মেন্যুপুলেশন করে বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে
তুলেছে। এটা যেন করতে না পারে, সেদিকটা লক্ষ রাখা জরুরি।
সিন্ডিকেটকারীরা
বাজার পরিস্থিতি সব সময়ই অস্থির করে তোলে। সেখানে সঠিকভাবে মনিটরিং না
থাকার কারণেই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা দ্রুত সামাল দেওয়া সম্ভব হবে
বলে মনে হয় না। মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে বিগত কয়েক বছরে বহু লোক
দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। কতসংখ্যক তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান জানা
নেই। নিম্নমধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের মান ক্রমাগত
নিম্নমুখী হচ্ছে। এ পরিস্থিতিকে এখনই মোকাবিলা করতে হবে। তা না হলে এ
সমস্যা দিনে দিনে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। বর্তমানে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য
বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমান।
এমতাবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সুসংগঠিত করতে হবে। এটা ভেঙে পড়লে এই
অস্থিরতা আরও বাড়বে।
দেশে সরবরাহব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর
থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হারের অঙ্কটি অনেক বেড়ে
যাবে। সে ক্ষেত্রে আসন্ন মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন
বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। আগের বিভিন্ন সময়ের মন্দা আমাদের দেখিয়েছে,
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন লম্বা সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে
দেওয়া ঝুঁকির তৈরি করে।
নীতিনির্ধারকদের এমন সব মধ্যমেয়াদি রাজস্ব
পরিকল্পনা করতে হবে, যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে এবং দরিদ্র ও দারিদ্র্যের
ঝুঁকিতে আছে- এমন পরিবারকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের
যথেষ্ট ব্যর্থতা আছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি বা বাজার মেন্যুপুলেশন করার জন্য
সাধারণত কৃষক বা উৎপাদনকারী দায়ী নয়। দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়িক
শ্রেণি। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করে থাকে।
কৃষক উৎপাদন করে কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই কৃষক বা সাধারণ মানুষ
ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি।
দেশের সাধারণ মানুষ দিন আনে দিন খায়। হঠাৎ পণ্যের
দাম বেড়ে গেলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায়
মানুষের একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। এখন
ভোক্তাঋণের সুদ বাড়ানোর ফলে তারা হয়তো চাপে পড়বেন। তবে মূল্যস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ
সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে। দেরিতে হলেও আংশিকভাবে আমরা
সেই পথে গেছি। তবে বিদ্যমান নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা
যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
দেশে আমদানি খরচ অতিমাত্রায় বেড়ে
যাওয়া আরেকটা বড় রকম সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি কিছুটা
বাড়লেও আমদানির তুলনায় তা অনেক কম। এর ফলে বিশাল এক ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির
মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে
যাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। দেশ থেকে
প্রচুর অর্থ পাচার হয়েছে। যদি এটা হয়ে থাকে, তাহলে যে করে হোক তা বন্ধ করতে
হবে। পাচার অর্থ ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ডলারের দাম
বৃদ্ধি পেলে রপ্তানিকারকরা লাভবান হন। প্রবাসীরাও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে
উৎসাহিত হয়।
মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে করমুক্ত আয়ের সীমা কিছুটা
বাড়ানো যেতে পারে। আমাদের কর সীমা বাড়ানো উচিত। বিগত বছরগুলোতে করমুক্ত
আয়ের সীমা একই আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। আর সেটা
করতে হলে রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো আমাদের
ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। এই অনুপাত অবশ্যই বাড়াতে হবে। যাদের টিআইএন
(কর শনাক্তকরণ নম্বর) আছে, তাদের সবাই যাতে কর দেয়, সেটা নিশ্চিত করতে
হবে। করের হার কমিয়েও কিন্তু রাজস্ব আদায় বাড়নো যায়।
সে ক্ষেত্রে করের
আওতা বাড়াতে হবে। যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের সবার কাছ থেকে কর আদায় করতে
হবে। নতুন নতুন খাতকে করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
পরিস্থিতি কিছুটা উদ্বেগজনক বলতে হবে। এখনো আমাদের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির
ওপর পুরোপুরি দাঁড়াতে পারেনি। অর্থনীতি এখন একটা বেশ বড় সমস্যার মধ্য দিয়ে
যাচ্ছে বলা যায়। দেশ থেকে অনেক টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। সেগুলোর আইনি
প্রয়োগে যথেষ্ট অবহেলা আছে। আইনগুলো শক্তিশালী হওয়া দরকার ছিল কিন্তু তা
হয়নি। এসব বিষয় অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও দুর্বল করেছে। ফলে অর্থনীতি একটা বড়
রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আছে। অন্য
সূচকগুলোর দিকে তাকালে স্বস্তির ব্যাপারও আছে। রপ্তানি আয়ে ধারাবাহিকভাবে
বেশ কিছুদিন ধরে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। যে কারণে অযথা ভয় বা আতঙ্কিত হওয়ার
কিছু নেই।
মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি না হয়ে আরও ঝুঁকির মধ্যে আছে। যেটি মানুষের
জীবনযাত্রার মানকে অনেক বেশি নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। এমতাবস্থায়
সচেতন হয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি আরও বেশি
সমস্যাসংকুল হবে। মূল্যস্ফীতির ফলে আমাদের রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রমগুলো ও
বিনিয়োগ ব্যাহত হলে যেসব সমস্যা আছে সেগুলোর সমাধান কঠিন হয়ে যাবে।
অর্থনীতির সঙ্গে সমাজের অনেক মানুষ সম্পৃক্ত- নীতিনির্ধারক যারা আছে, যারা
ব্যবসা-বাণিজ্য করে, যারা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের অর্থনীতি
পুনর্গঠনে মনোযোগী হতে হবে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যেকোনো দেশের অর্থনীতি
বাইরের পৃথিবীর পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। বহিঃখাত থেকে যে
অভিঘাতগুলো আসছে তা অভ্যন্তরীণভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ