একবার
১৪০০ বছর আগের পৃথিবীর দিকে দৃষ্টি দিন। এ ক্ষেত্রে উঁচু উঁচু ভবন,
স্বর্ণ-রৌপ্যের স্তূপ ও চাকচিক্যপূর্ণ পোশাকের বিষয়াদি বাদ দিন। এগুলো তো
পুরনো ছবির অ্যালবাম ও প্রাণহীন জাদুঘরেও দেখা যায়, বরং এটা দেখুন যে তখন
মনুষ্যত্ব জাগ্রত ছিল কি না? পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত, উত্তর থেকে দক্ষিণ
পর্যন্ত লক্ষ করে দেখুন, কোথাও মনুষ্যত্বের স্পন্দন পাওয়া যায় কি না এবং
তাতে প্রাণের সাড়া ছিল কি না?
জীবনের সমুদ্রে বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে
ফেলত। মনুষ্যত্বের বনে বাঘ, চিতা, বকরি ও হরিণকে নির্বিচারে খেয়ে ফেলত,
মন্দ লোকেরা ভালো মানুষের ওপর এবং নিম্ন প্রকৃতির লোকেরা সম্মানিত মানুষের
ওপর, প্রবৃত্তি বিবেক-বুদ্ধির ওপর, পেটের তাড়না আত্মার দাবির ওপর প্রাধান্য
লাভ করেছিল।
কিন্তু এই অরাজক অবস্থার বিরুদ্ধে সমগ্র পৃথিবীতে কোনো
প্রতিবাদ ছিল না, কোনো ক্ষোভ ছিল না। পুরো পৃথিবী যেন এক অচলায়তন শিলাখণ্ডে
পরিণত হয়েছিল। বাদশাহ, উজির, ধনী-দরিদ্র্য সবাই স্থবির হয়ে পড়েছিল। সবাই
অর্থমূল্যে বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল।
এমন কেউ ছিল না যে মনুষ্যত্বের
খরিদদারকে উৎসাহিত করবে। যে মানুষকে ডেকে বলবে, এই পরিবেশ আমাদের মুক্তির
জন্য যথেষ্ট নয়, এই পুরো পৃথিবী ও তার জীবন আমাদের উচ্চাশার তুলনায়
সামান্য। কেননা আমাদের একটি অনন্ত জীবনের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা এই
ক্ষণস্থায়ী জীবন এবং সীমাবদ্ধ পৃথিবীর ছোট অট্টালিকার জন্য নিজের আত্মাকে
কিভাবে বিক্রি করতে পারি?
জাতি ও রাষ্ট্র, এর থেকে এগিয়ে সম্প্রদায় ও গোত্র, এর থেকে বেড়ে মহল্লা ও পরিবার; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে মানুষ বিভক্ত হয়ে যায়।
বড়
বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষাসম্পন্ন মানুষ, যারা নিজেদের যোগ্যতা ও মর্যাদার ব্যাপারে
বড় বড় দাবি জানাত তারাও বৃত্তবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এতে কারো
ভেতরে কোনো গ্লানি বা কুণ্ঠা ছিল না। কেউ এর থেকে বিস্তৃত পরিসরে
মনুষ্যত্বের কল্পনা করতে পারত না। জীবনের সব সুরা ও সুধা ধোঁকা ও
প্রতারণার জালে আটকে যায়। মনুষ্যত্ব এক প্রাণহীন লাশে পরিণত হয়েছিল।
যাতে
ছিল না প্রাণের সজীবতা, অন্তরের বোধ ও ভালোবাসার উষ্ণতা। মনুষ্যত্বের ছাদ
আগাছা ও পরগাছায় ছেয়ে গিয়েছিল। যা রক্তপিয়াসি পাখি, বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত গাছ
ও ভয়ানক পশু দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। শুধু দেখা মিলত না মানুষের। যারা তখনো
মানুষ ছিল, তারা খোঁয়াড়ের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল, পাহাড়ের চূড়া, খানকা ও
ইবাদতখানায় আত্মগোপন করেছিল। তারা জীবনজগৎ থেকে চোখ বন্ধ করে নিজেদের
কল্যাণ চিন্তায় মগ্ন ছিল। আর তখনই মনুষ্যত্বের এই শীতল দেহে উষ্ণ রক্তের
প্রবাহ সৃষ্টি হলো, শিরা-উপশিরায় চাঞ্চল্য এবং দেহে প্রাণের স্পন্দন দেখা
দিল। যে পাখি এই দেহকে মৃত ভেবে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল, এর ছাদে বংশ বিস্তার
করেছিল, তাদের সেই ঘর নড়ে উঠল। প্রাচীন সিরাত গবেষকরা বর্ণনা করেছেন,
পারস্য সম্রাট কিসরার প্রাসাদের গম্বুজ ধসে যায় এবং অগ্নিকুণ্ডের আগুন নিভে
যায়। নতুন যুগের ঐতিহাসিকরা লেখেন, মনুষ্যত্বের অভ্যন্তরীণ কম্পনে তার
বহিরাঙ্গনে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। মানবসভ্যতার দেহে নবপ্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল
মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের ফলে। যিনি সভ্য পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড, পবিত্র মক্কায়
আগমন করেছিলেন।
তিনি পৃথিবীকে যে বার্তা দিয়েছিলেন তা মানবজীবনে সব
ধরনের প্রশস্ততা ও প্রশান্তি এনেছিল। ইতিহাস সাক্ষী মানবজাতির শেখর ও
ভিত্তিতে মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি সংক্ষিপ্ত বার্তা যেভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল,
তা তাঁর পূর্বাপরের কেউ কখনো পারেনি। তাঁর সেই বার্তাটি ছিল ‘লা ইলাহা
ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর
কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল)।
পৃথিবীর স্থবির
চিন্তার জগতে এত বড় আঘাত আর কোনো বাক্য দিতে পারেনি। ফলে তা ক্রোধান্বিত
হলো এবং বলল, ‘সে কি বহু উপাস্যকে এক উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? এটা তো এক অতি
আশ্চর্য ব্যাপার!’ (সুরা : সোয়াদ, আয়াত : ৫)
ফলে তারা ভাবতে লাগল, এটা
তাদের চলমান জীবনধারার বিরুদ্ধে এক গভীর ও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। সুতরাং তা
প্রতিহত করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের প্রধানরা সরে পড়ে এ কথা বলে, তোমরা
চলে যাও এবং তোমাদের দেবতাগুলোর পূজায় তোমরা অবিচল থাকো। নিশ্চয়ই এই
ব্যাপারটি উদ্দেশ্যমূলক।’ (সুরা : সোয়াদ, আয়াত : ৬)
একত্ববাদের এই
আহ্বান জীবন ও মনুষ্যত্বের চিত্রকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়, যা চিন্তার পুরো
কাঠামো এবং জীবনের পুরো ধাঁচকে প্রভাবিত করে। এই আহ্বানের মূলকথা ছিল,
পৃথিবী নিজ থেকে জন্মানো কোনো আগাছা ও পরগাছার জঙ্গল নয়, এটা মালির যত্নে
গড়া বাগান। মানুষ এই বাগানের সবচেয়ে মূল্যবান ফুল। এই ফুল হাজারো বাগানের
মূলধন। এটা কোনো উদ্দেশ্যহীন বস্তু নয়, যা অযত্নে মলিন অবস্থায় পড়ে থাকবে।
মানুষের
মনুষ্যত্বের মূল্য কেবল তার স্রষ্টাই দিতে পারেন। মানুষের ভেতর আছে
সীমাহীন প্রার্থনা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সাহসী অন্তর, অস্থির হৃদয়; পুরো পৃথিবী
মিলে যাকে শান্ত করা সম্ভব নয়। এই গতিহীন পৃথিবী তার সঙ্গে পথ চলে পারবে
না। তার জন্য প্রয়োজন চিরন্তন জীবন ও অনন্ত এক জগৎ। যে জীবনের সামনে এই
পার্থিব জীবন একটি ফোঁটা এবং পৃথিবী শিশুতুল্য। সেখানের সুখ-সমৃদ্ধির
তুলনায় এখানকার সুখ-সমৃদ্ধি এবং সেখানকার কষ্টের তুলনায় এখানকার কষ্ট কিছুই
না।
পৃথিবীর বুদ্ধি-বিবেক এতটাই নিষ্কর্ম হয়ে গিয়েছিল যে তা বস্তু,
অনুভূতি, শরীর ও পেটের বাইরে কোনো কিছু ভাবতে পারত না। তারা এগুলোর
ভিত্তিতে কিছু মাপকাঠি বানিয়ে রেখেছিল এবং তার আলোকেই সব কিছু পরিমাপ করত।
তাদের পরিমাপের বিষয় ছিল সহায়-সম্পদ, নেতৃত্ব, রাজত্ব, নারী ও বিলাসিতা।
তারা তাদের এই মাপকাঠি দিয়ে মুহাম্মদ (সা.)-কে মেপে দেখতে চাইল।
কিন্তু
তারা বুঝতে পারল এসবের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তিনি যা চান তা এসবের
চেয়ে আরো বড় কিছু। তাহলো মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি। তিনি তাঁর
জন্য এই পৃথিবীতে কোনো কৃত্রিম জান্নাত তৈরি করতে চান না। তিনি জান্নাত
থেকে আসা মানবজাতিকে চিরস্থায়ী জান্নাতে চিরদিনের জন্য প্রবেশ করাতে চান।
তিনি কোনো নেতৃত্ব ও রাজত্ব চান না, তিনি মানুষকে পৃথিবীর দাসত্ব থেকে
মুক্ত করে রাজাধিরাজের অনুগত করতে চান। এর মাধ্যমে তিনি মানবজাতির সামনে
পৃথিবীর অসারতা ও চিরস্থায়ী জীবনের সন্ধান দান করেন।