শুক্রবার ১০ জানুয়ারি ২০২৫
২৭ পৌষ ১৪৩১
নতুন আলো আর পুরোনো ছায়া
রাজেকুজ্জামান রতন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:৩০ এএম আপডেট: ০৯.০১.২০২৫ ২:০২ এএম |

  নতুন আলো আর পুরোনো ছায়া
নতুন বছর এল। পুরোনো বছরে রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে গেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। জনমনে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে প্রবল কিন্তু পূরণ করার দায় যে সরকারের তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পুরোনোর ছায়া কি নতুনকে গ্রাস করবে, এই আশঙ্কা জনমনে এখন প্রবল।   
বাংলাদেশের ষড়ঋতুর মতো ছয়টি পর্বে ২০২৪ সালকে ভাগ করা যায়। জানুয়ারির অবিশ্বাস্য আমি-ডামির নির্বাচনের পর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছিল পর্যালোচনা, কীভাবে এই নির্বাচনের পক্ষে সাফাই গাইছে আওয়ামী লীগ। মার্চ-এপ্রিল ছিল হতাশার কাল। জনগণ ভাবতে শুরু করল, কোনোভাবেই প্রশাসন, পুলিশ আর দলীয় মাস্তানদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না আর সরকার ক্ষমতা ভোগ ও প্রয়োগ করতেই থাকবে যতদিন তারা চায়। মে-জুন ছিল অবাধ দুর্নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধতার কাল। দ্রব্যমূল্য অসহনীয়, লুটপাট লাগাম ছাড়া, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাবেক পিওনের হাতে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ দুর্নীতির ব্যাপকতা সম্পর্কে মানুষের ধারণাকে পাল্টে দিয়েছিল। জুলাই-আগস্ট ছিল স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টির কাল। সাঈদের মৃত্যু যেন বাঁধ ভেঙে দিল সাহসের। কারফিউ উপেক্ষা করা, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে মরতে মরতে মানুষের মরার ভয় দূর হয়ে গিয়েছিল।
 বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর ছাত্রদের নয়, সারা দেশের মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়ে গেল। সরকার পতন ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। নতুন ইতিহাস রচিত হলো, বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তকমা পাওয়া প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ ও পলায়নের নতুন নজির স্থাপন করলেন। জনগণের ক্রোধের আগুনে পুড়ল সরকারি স্থাপনা, লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল গণভবন, পুড়ল ৩২ নম্বর, ভাঙল মুজিবের ভাস্কর্য। পালিয়ে গেল সব মন্ত্রী, এমপি এমনকি বায়তুল মোকাররমের খতিব পর্যন্ত। এ এক অবিশ্বাস্য পতন ও পলায়ন। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নতুনভাবে দেশ গড়ার স্বপ্নের পাশাপাশি একদিকে অস্থিরতা, উত্তেজনা, দখল আর অন্যদিকে অতীত সরকারের দুর্নীতির নতুন নতুন দৃষ্টান্ত উন্মোচন করার কাল। নভেম্বর-ডিসেম্বরে মানুষ আবার সংশয়ে পড়ে গেল। নানা বিতর্ক আমদানি হতে থাকল, ভারতের নানা পদক্ষেপ আর দেশের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টির প্রচেষ্টা লক্ষ করে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল, আসলে হচ্ছেটা কী?       
বছরের শেষে ঘোষণা করা হলো, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন হবে ৩১ ডিসেম্বর শহিদ মিনারে। শুরু হলো উত্তেজনা, কী লেখা হবে, কে লিখবে এবং কখন লিখবে এই প্রোক্লেমেশন? অভ্যুত্থানের আগের দাবি কী ছিল আর পরে কী কী দাবি উত্থাপিত হচ্ছে তার মধ্যে সমন্বয় করবে কারা? ফ্যাসিস্ট শাসন উৎখাতের সংগ্রামে যত ঐক্য ছিল পরবর্তী সময়ে দেশ পরিচালিত হবে কোন পথে তা নিয়ে বিরোধও ততটাই যেন বেশি। সংবিধান নতুন হবে না সংশোধন হবে সেই বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, নির্বাচনের লক্ষ্যে সংস্কার নাকি সংস্কার করে নির্বাচন, ৫২ বছর রাজনৈতিক দলগুলো কী করেছে- এই বিতর্ক তোলার চেষ্টা রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা তৈরি করেছে। আবার সংবিধান ছুড়ে ফেলা কিংবা মুজিববাদী সংবিধান কবরস্থ করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে অভ্যুত্থানের  ঘোষণা প্রকাশ করা হবে বলে জানানোর পর রাজনৈতিক মহলে আলোচনা এখন ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।   রাজনৈতিক আলোচনা, বিতর্ক, উত্তেজনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনের সংকটগুলো তীব্র হচ্ছে। সরকার দ্রব্যমূল্যের লাগাম ধরতে পারছে না, ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে, শীতকালীন সবজি বাজারে উঠতে না উঠতে কৃষক সেই পুরোনো চক্রে আটকে গেছে। সবজি উৎপাদকরা দাম পাচ্ছে না, রংপুরে, গাইবান্ধায় ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ২ টাকা কেজি, কৃষকের মাথায় হাত। সার নিয়ে সংকটের আশঙ্কা, দাম বৃদ্ধি, বীজ কীটনাশকের দাম এবং মান নিয়ে সেই পুরোনো খেলা কৃষকের জীবনকে জেরবার করে দিচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি আর চাকরি নিয়ে ক্ষোভ প্রশমিত হচ্ছে না। মানুষ ভাবছে একদিকে সংবিধান কবরস্থ করার ঘোষণা, অন্যদিকে জনগণের সম্পদ পকেটস্থ করার কাজ চলছে। এর সঙ্গে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সংগতি কোথায়? শ্রমিকের বাড়বে না আয়, কৃষক পাবে না ফসলের ন্যায্য দাম, সেই পুরোনো বৃত্ত কি ভাঙবে না এবারও। 
অন্যদিকে দেশের রপ্তানি বেড়েছে বেশ ভালো পরিমাণেই। যদিও বেতন না পাওয়া, চাকরি হারানো শ্রমিকদের আন্দোলনে আশুলিয়া, গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের শ্রম অসন্তোষ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। গার্মেন্টস ধ্বংস হয়ে যাবে এ রকম প্রচারণার মধ্যেই দেখা গেল, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। একক মাসের হিসাবে ডিসেম্বরে রপ্তানির হারটা আরও বেশি। এই মাসে রপ্তানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। 
ইপিবির হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, একক মাস ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪৬৩ কোটি ডলারের। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৫৫ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে মোট রপ্তানির পরিমাণ ২ হাজার ৪৫৩ কোটি ৩৫ লাখ ডলার বা প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৭৪ কোটি ডলার।  
তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ১৮ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ৭৫৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ টানা পাঁচ মাসের শ্রম অসন্তোষের মধ্যেও পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে ২২৩ কোটি ডলার বা ২৭ হাজার কোটি টাকার মতো। 
দেশের রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স এসেছে সর্বোচ্চ পরিমাণে। ডিসেম্বর মাসে ২.৬৪ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীরা। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ২০২৪ সালে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণে। ২৬.৮৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি। বছরের হিসাবে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২২ সালে, প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার। দেশের প্রতি প্রবাসীদের দায়িত্বের আবারও প্রমাণ পাওয়া গেল। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ায় বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়ে এখন ২১.৩৬ বিলিয়ন ডলার, যা ১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।   
অর্থনীতির এসব ইতিবাচক খবরের মধ্যেই আবার জানা গেল ভ্যাটের আওতা বাড়ছে। আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে যোগ হচ্ছে পরোক্ষ করের বাড়তি বোঝা।  বাড়তি করের তালিকায় রয়েছে ওষুধ, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, জুস, ফলমূল, সাবান, মিষ্টি, মোবাইল ফোনে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার, হোটেল-রেস্তোরাঁ, এলপিজি গ্যাস, বিমানের টিকিটসহ ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবা। এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে জনজীবন বিপর্যস্ত, এই সময়কালে অন্তর্র্বতী সরকারের এ সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দেবে। বর্তমানে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের বেশি। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ, যা পার্শ্ববর্তী যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। এরপর নতুন করে ৪৩ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ হলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। জনগণ চায় দুর্নীতি, কর ফাঁকি বন্ধ করা হোক, কিন্তু ভ্যাটের আওতা বাড়লে ব্যয়ের বোঝা তো সাধারণ মানুষের কাঁধেই চাপবে। 
উৎপাদন বাড়লে, রপ্তানি বাড়লে সরকার বলে অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের ঘোষণা আর বাস্তবতার মধ্যে একটা ফারাক অতীতেও ছিল বর্তমানেও তা দৃশ্যমান। সরকার যা-ই বলুক না কেন, জনগণের ভাবনা হলো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে কি না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হবে কি না? সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা তৈরি হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট প্রকাশ, নির্বাচনের পদক্ষেপ কীভাবে নেওয়া হবে, পরাজিত এবং পলাতক অতীত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও নেতাদের বিচার কীভাবে হবে, কতদিনে হবে, ক্ষমতায় যারা আছেন তারা কি ক্ষমতা ছাড়বেন না প্রলম্বিত করবেন? এসব প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি আশঙ্কা আছে, দমন-পীড়নের যে সরকার তারা উচ্ছেদ করেছেন, নতুন সরকার নতুন বছরে তা থেকে মুক্ত হতে পারছে কি? দাম বৃদ্ধি, দমন-পীড়ন আর দুর্নীতির যে চক্র তৈরি হয়েছিল পুরোনো সরকারের সময়কালে তার ছায়া যেন ভর না করে নতুন সরকারের ওপরে, এই চাওয়া সবার।   
লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)













সর্বশেষ সংবাদ
শহরজুড়ে ছিনতাই আতঙ্ক
পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ৭ ছিনতাইকারী
কুমিল্লা ক্লাবের নির্বাচনে ৩১ জনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ
কুমিল্লা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালকের অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন
গণ-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরতে মানুষের কাছে ছুটছি: হাসনাত আব্দুল্লাহ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় টাস্কফোর্সের অভিযান ও জরিমানা
১৫ জানুয়ারির মধ্যে গণঅভ্যুত্থানের স্বীকৃতির ঘোষণাপত্র দিতে হবে
কুমিল্লা মহানগর ৪নং ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি
সংসদের পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচনেরও প্রস্তুতি চলছে
কুমিল্লায় ভোক্তা অধিকারের অভিযান ৩ প্রতিষ্ঠানকে ১০হাজার টাকা জরিমানা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২