দেশের
সর্বত্র চলছে ব্যক্তিস্বার্থের জয়জয়কার। সামাজিক সম্পত্তি
ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। নদী, বিল, খাল, হাওর, পার্ক সব লুণ্ঠিত হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কলকারখানা প্রথমে দলীয় লোকদের দখলে চলে গিয়েছিল, পরে
অরুগ্ণ অবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানায় নামমাত্র দামে তুলে দেওয়া হয়েছে; এবং
ওই নতুন মালিকরা কারখানা চালায়নি, কারখানার জমি, ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি সব
বেচে দিয়েছে কিংবা অন্য কাজে লাগিয়েছে, ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে কী, আরও
সংকুচিত হয়েছে।
লুটপাটকারীরা নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করছে, বিশেষ
প্রাণীদের মতো থেকে থেকে ধ্বনি তুলছে, নানাবিধ। এই দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে
তাদের অনুসরণকারীরা যা শিখছে তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা লক্ষ্যের
বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। একাত্তরে এদের কেউ কেউ যে যুদ্ধে গিয়েছিল এটা
সত্য, কিন্তু যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল বলেই মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হয়েছিল তা নয়;
এবং পরবর্তী সময়ে তাদের কারও কারও অবস্থান হানাদারদের কাণ্ডকারখানা থেকে
পরিমাণগতভাবে দূরবর্তী হয়তো ছিল, কিন্তু গুণগত মানে অনেক দূরের ছিল না।
এখনো নেই।
মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তিগত মুনাফার প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠেনি;
কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা যাচ্ছে অবিকল তাই ঘটছে, ব্যক্তি নিজেকে কেবল
বিচ্ছিন্ন নয়, সর্বপ্রধান করে তুলেছে, সমষ্টিকে যতটা পারা যায় লাঞ্ছিত করে।
অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি যুদ্ধের ওপর বই লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, পড়লে মনে
হয় যুদ্ধটা ছিল তারই যুদ্ধ, ব্যক্তিগত; এবং যুদ্ধটা প্রমাণ করেছে তার মধ্যে
কতটুকু মহত্ত্ব, বীরত্ব ইত্যাদি লুক্কায়িত ছিল। প্রচণ্ড মুনাফা-লোভের
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তুমুল ভোগস্পৃহা। ভোগের এক অত্যাশ্চর্য প্লাবন বয়ে চলছে
দুর্দশাগ্রস্ত এই দেশের ওপর দিয়ে। সেখানেও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা একের
সঙ্গে অন্য সবার।
এই পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধূসর হতে বাধ্য।
স্মৃতি বিশেষভাবে তারাই ধরে রাখছে, যারা এ নিয়ে ব্যবসা করতে পারে। আর মনে
রাখতে বাধ্য হচ্ছে তারা, যারা আপনজনকে হারিয়েছে। যারা লাঞ্ছিত হয়েছে,
নানাভাবে। এদের মধ্যে সম্পন্ন মানুষও আছে, আছে বলেই তবু থেকে থেকে যুদ্ধের
উল্লেখ ঘটে; কেবল সাধারণ মানুষের দুঃখের ব্যাপার হলে চাপা পড়ে যেত
বিস্মৃতির আরও অনেক গভীরে।
মুক্তিযুদ্ধের ভেতরকার অঙ্গীকারটা তো অবশ্যই
ছিল সমষ্টিগতভাবে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর। এ যুদ্ধ তো অন্যে লড়ে দেবে না,
নিজেকেই লড়তে হয়, নিজের ওপর নির্ভর করে। অন্যরা সাহায্য করবে, অবশ্যই;
কিন্তু তাদের ওপর ভর করে লড়াই করা যাবে এ রকমের আশ্চর্য কথা কেউ কখনো
শুনেছে বলে মনে হয় না। অন্যে এসে যদি মুক্ত করে দেয় তবে তার অর্থ তো
স্বাধীনতা হতে পারে না, পরাধীনতাই হওয়ার কথা। আমাদের যুদ্ধে যে মধ্যবিত্ত
শ্রেণি নেতৃত্ব দিয়েছে তার ভিত্তিটাই ছিল পরাশ্রয়ী; এই শ্রেণি স্বাধীনভাবে
গড়ে ওঠেনি, অন্যকে জড়িয়ে ধরে কোনোমতে বিকশিত হয়েছে। সে প্রভু বদল করতে
পারে, কিন্তু স্বাধীন হতে ভয় পায়।
একাত্তরের যুদ্ধে তাই আমরা,
নেতৃত্বদানকারী মধ্যবিত্তরা কান পেতে থেকেছি কোথায় কার সমর্থন পাওয়া গেল
সেটা শোনার জন্য। অনুমোদনের সামান্য শব্দ শোনামাত্র উৎফুল্ল হয়েছি, যেমন
মুহ্যমান হয়েছি বিরোধিতার ধ্বনি কানে এলে। ভারত কেন স্বীকৃতি দিচ্ছে না, এ
ছিল সার্বক্ষণিক গুনগুন; ভারতীয় বাহিনী কেন ত্বরায় প্রবেশ করছে না সীমান্ত
পার হয়ে, এ নিয়ে কেবল জিজ্ঞাসা ছিল না, ছিল গভীর উদ্বেগ। পাকিস্তান খুশি
হতো যুদ্ধটাকে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলে;
প্রকারান্তে আমরাও যেন তেমনটাই চাইছিলাম। শ্রেণিগতভাবে মধ্যবিত্তের আস্থা
ছিল না সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত একটি দুর্র্ধষ বাহিনীকে ভীরু বাঙালি পর্যুদস্ত
করতে পারবে বলে।
নিজের পরাশ্রয় প্রবণতার কারণে ওই আস্থাটা তৈরি হতে
পারেনি, কঠিন ছিল তৈরি হওয়া। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা যখন আত্মসমর্পণ করল
তখন তারা ভারতীয় সেনাপতির কাছেই মাথা ও গোঁফ নোয়ালো; আমাদের সেনাপ্রধানের
পক্ষে সেখানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হলো না। ঘটনাটি তাৎক্ষণিক বটে, কিন্তু এর
মনস্তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য মোটেই ছোট নয়। বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের
পক্ষে যতটা বড় হওয়ার কথা ছিল আমরা হতে পারলাম না।
তবু আত্মমর্যাদা
বেড়েছিল বৈকি। আমরা জিতেছি, আমাদের ভূমিতেই হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছে,
প্রবাসী সরকার দেশে ফিরে এসেছে, এসে দেশ শাসনের দায়িত্বভার হাতে নিয়েছে।
নতুন সংবিধান তৈরি হলো। বিশ্ব আমাদের দেখল, খুশি হলো। বাংলা ভাষা
রাষ্ট্রভাষা হলো, বাংলাদেশের পতাকা দেশে-বিদেশে উড্ডীন হতে দেখলাম। আমরা
বললাম আমরা একটি গর্বিত জাতি।
কিন্তু তার পর? তার পরের ইতিহাসটা তো
ক্রমাগত পিছু হটার। আদর্শবাদটা চলে গেছে, যার কথা ওপরে উল্লেখ করেছি। ওই
আদর্শবাদের অন্তর্ধানের ফলে মুক্তিযুদ্ধ অনেকের চোখেই নিছক ‘গোলমাল’ ভিন্ন
বড় কিছু নয়। তাদের দৃষ্টিতে একাত্তরে একটা গোলমাল বেঁধেছিল, আমরা কষ্টে
পড়েছিলাম, কপাল ভালো, সেটা চলে গেছে, এখন মোটামুটি ভালোই আছি, যতটা থাকা
যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শবাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল
আত্মনির্ভরশীল হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটাও।
পাকিস্তানিদের হটিয়ে দিয়ে আমরা অন্য
কাউকে ডেকে আনব, এমন কোনো কথা ছিল না, থাকলে ওই যুদ্ধ মুক্তির যুদ্ধ বলে
কিছুতেই দাবি করতে পারব না। কিন্তু দেখা গেল, ডাকাডাকি ঠিকই শুরু হয়ে গেছে।
ভারতীয়রা তো আসবেই, তারা আমাদের ঘনিষ্ঠতম মিত্র। কিন্তু পাকিস্তানিরাও চলে
এল। আমরাই ডেকে আনলাম। ভুট্টো এসে ঢাকা ঘুরে গেল, সসম্মানে। ১৯৪ জন
পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলো না, পাকিস্তান ক্ষমা চাইল না, আটকে পড়া
পাকিস্তানিদের তারা ফিরিয়েও নিল না।
ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে আমরা ছুটলাম
দ্বারে দ্বারে। দান, অনুদান, ঋণ আসতে শুরু করল। যত এল ততই আমরা নত হলাম।
কিন্তু স্ফীত হলো শাসকশ্রেণি। এখন ঋণ নিতে নিতে দেশের এমন দশা হয়েছে যে, ঋণ
ছাড়া আমরা যে চলতে পারব, এটা কল্পনা করাও কঠিন মনে হয়। দেশের যারা শাসক
তারা আসলে ভক্ষক, যদিও তাদের ছদ্মবেশটা রক্ষকের। এরা দেশকে বন্ধক রাখতে চায়
পুঁজিবাদী বিশ্বের কাছে, জনগণের মঙ্গল হবে বলে নয়, নিজেদের পকেট ভারী হবে,
এই আশায়। দারিদ্র্য বেচা শেষ হয়েছে, এখন সম্পদ যা আছে তা বেচার তাল
তুলেছে, এরা এমনই আপসবিহীন জাতীয়তাবাদী। আসলে হানাদারই, নতুন নামে।
আমরা
আদর্শ ভুলেছি এবং আমাদের আদর্শ ভুলতে প্ররোচনাও দেওয়া হয়েছে। দিয়েছে ওই
পুঁজিবাদী বিশ্বই। ওই বিশ্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না। যুদ্ধের
সময় সরাসরি বিরোধিতা এবং ক্ষেত্রবিশেষ শত্রুতা করেছে। তার পরেও শত্রুতা
অব্যাহত রেখেছে। আমরা বলি শত্রুতা, ওরা বলে নিজেদের অধীনে রাখা। এই ক্ষমতার
একটা দিক হচ্ছে অর্থনৈতিক, অন্যটি আদর্শিক।
আদর্শিক দিকটাও সামান্য
নয়। যে নামেই ডাকি, স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে অধিকার ও সুযোগের বৈষম্য
থাকবে না। মানুষের সমষ্টিগত স্বার্থ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ একসঙ্গে প্রথিত
হয়ে যাবে; সমষ্টি ব্যক্তিকে সাহায্য করবে, ব্যক্তি পুষ্ট করবে সমষ্টিকে, যে
পুষ্টি আবার ব্যক্তির কাছেই ফিরে আসবে সম্পদ হয়ে, মৈত্রীর ভেতর দিয়ে,
সম্মান বয়ে নিয়ে। ওটা যেমন ছিল আদর্শ, তেমনি ছিল লক্ষ্য; ওই লক্ষ্য ভুলবার
প্ররোচনাও পুঁজিবাদী বিশ্বই আমাদের অবিরাম দিচ্ছে। বলছে স্বার্থপর হতে,
নিজেরটা দেখতে। পরামর্শ দিচ্ছে বড় হও, নিজের চরকায় তেল দিতে থাকো, অন্যরা
অন্যদেরটা দেখবে। শেখাচ্ছে তাদেরও নির্ভরশীল হতে। বিচ্ছিন্ন করছে সমষ্টি
থেকে এবং আপনজন থেকেও। এটাও একটা আদর্শ বটে, তবে এ ততটা মানবিক নয়, যতটা
জংলি। জঙ্গলে সেই টেকে যার শক্তি আছে; আধুনিক সমাজের সব আভা ও আবরণ
সত্ত্বেও পুঁজিবাদী বাস্তবটা ওই রকমই।
আত্মসুখ ও মুনাফা সন্ধানের এই
আদর্শবাদ যত প্রচার পাচ্ছে ও গৃহীত হচ্ছে ততই আমরা আমাদের সমষ্টিগত
অগ্রগতির লক্ষ্যটাকে ভুলে যাচ্ছি। প্রচারমাধ্যমগুলো তথ্য এবং আনন্দ বিতরণের
ভেতর দিয়ে ওই আদর্শবাদ অহর্নিশ প্রচার করছে। প্রচার নয়, সংক্রমিত করে
দিচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতরে। আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণহীন আত্মসচেতন অর্থাৎ
ভোগ-সচেতন প্রাণিতে পরিণত হচ্ছি।
বাঁচার উপায় হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা আমাদের পরিচালিত করেছিল সেই আদর্শবাদকে নিজেদের মধ্যে
পুনরুজ্জীবিত করা। এ কাজে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য হওয়ার
কথা।
আবশ্যকতাটি তারা বুঝবেন এবং বুঝে জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলবেন,
এটা প্রত্যাশিত। ওই সচেতনতা নতুন ঐক্যের জন্ম দেবে, অথবা বলা যায় পুরোনো
ঐক্যকেই ফিরিয়ে আনবে। আমরা ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে ছিটকে পড়ব না, মুক্তির
সংগ্রামটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব। নিজের স্বার্থেই সবার স্বার্থকে দেখতে
হবে, দাঁড়ানোর জায়গা না থাকলে আমরা কেউ দাঁড়াতে পারব না, সম্মান ও সমৃদ্ধি
অর্জনের তো প্রশ্নই ওঠে না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়