বুধবার ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
২৩ মাঘ ১৪৩১
ইন্টারনেটে শিশুর ছবি শেয়ারে সাবাধান!
শ্যামল আতিক
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:০১ এএম |

 ইন্টারনেটে শিশুর ছবি শেয়ারে সাবাধান!
কয়েক বছর আগে আমাদের দেশের একজন বিখ্যাত তারকা তার শিশুকন্যার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছিলেন। তিনি হয়ত সরল মনে, নিজের আনন্দটুকু অন্যের সাথে শেয়ার করার জন্য ছবিটি পোস্ট করেছেন। কিন্তু তারপরে শুরু হয় কুরুচিপূর্ণ, আপত্তিকর বাজে মন্তব্য এবং নানা তর্ক বিতর্ক। ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে এত বেশি মাতামাতি ও বিতর্ক হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত এই উত্তাপ পত্রিকার পাতায় গিয়ে গড়িয়েছে। 
আমরা প্রায়শ শুনতে পাই, সেলিব্রেটিরা তাদের শিশুর ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এই ঘটনাগুলো শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই ঘটছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে তারপরেও আমরা সচেতন হই না, প্রায়শই শিশুদের স্পর্শকাতর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দেই। শিশু জন্মের পর থেকে প্রতিনিয়ত আমরা এ ধরনের ভুল করছি।  
পরিবারে নতুন শিশুর আগমন, নিঃসন্দেহে আনন্দের বিষয়। মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পরিবাবের মানুষজন ছবি তোলা, শিশুকে নিয়ে মাতামাতি, আনন্দ-ফূর্তি-উৎসব, সোশ্যাল মিডিয়ায় নবজাতকের ছবি শেয়ার করা ইত্যাদি আরো অনেক কিছু করছেন।  
প্রিয়জনরা জন্মের পর নবজাতকের ছবি তোলেন সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেয়ার জন্য। কিন্তু আপনি কি জানেন- এর মাধ্যমে শিশুর কী ধরনের সর্বনাশ করছেন? ছবি তোলার সময় ব্যবহৃত ফ্ল্যাশের আলোতে নবজাতকের চোখ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আসলে নবজাতকের নাজুক চোখ এখনো তীব্র আলো সহ্য করার মতো অবস্থায় যায় নি। এক্ষেত্রে আপনার সামান্য ভুল শিশুকে ভোগাতে পারে সারা জীবন। 
আপনি হয়ত অন্যকে জানানো অথবা শুধু লাইক পাওয়ার আশায় সোশ্যাল মিডিয়ায় শিশুর ছবি পোস্ট দিচ্ছেন। অথবা শিশুর প্রতিটি স্মরণীয় ঘটনার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেয়ার মাধ্যমে আনন্দটুকু সবার সাথে শেয়ার করতে চাচ্ছেন। শিশুদের ছবি বা ভিডিও এভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করাকে বলে ঝযধৎবহঃরহম. কিন্তু আমরা কি জানি, এভাবে ছবি শেয়ার করার ফলে শিশুর ভবিষ্যতে জীবন কতটা ঝুঁকির মধ্যে পরতে পারে, এর নেতিবাচক পরিণতি বা প্রতিক্রিয়ার রেশ কতটা ভয়ংকর হতে পারে। হয়তবা এই ছবির নেতিবাচক রেশ শিশুকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে ইন্টারনেটে শেয়ার করা কোনো ছবিই হারিয়ে যায় না, ডাটাবেজে থেকে যায়। এমনকি ছবি পোস্ট দেয়ার কিছুক্ষণ পরে ডিলিট করে দিলেও। যখনই শিশুর কোনো ছবি  ইন্টারনেটে পোস্ট দিলেন সেটি আর ব্যক্তিগত বা প্রাইভেট রইল না, মুহূর্তেই পাবলিক হয়ে গেলো। পরবর্তীতে এই ছবিগুলো যে যার মতো করে দেখতে পারবে, ব্যবহার করতে পারবে। 
প্রতিনিয়ত ছবি শেয়ার করার ফলে অনলাইন জগতে শিশুর ডিজিটাল ফুট প্রিন্ট তৈরি হয়ে যায়। প্রতিনিয়ত সার্চ টুলগুলো উন্নত ও শক্তশালী হচ্ছে। ভবিষ্যতে আপনার শিশুর নাম, জন্ম তারিখ, জিওট্যাগ লোকেশান এবং ফেসিয়াল রিকগনিশনের মাধ্যমে যে-কেউই এসব ছবি দেখার সুযোগ পাবে। আপনার অজান্তেই শিশুদের এসব ছবি পণ্যের বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার হতে পারে।
আশংকা এখানে নয়। ভবিষ্যতে এসব ছবি কীভাবে ব্যবহার হবে এটাই মূল আতংক। আসলে সোশ্যাল মিডিয়ার পরতে পরতে ওতঁ পেতে আছে বিপদ। আপনার একটু অসতর্কতা বা হেয়ালীপনা ধ্বংস করে দিতে পারে শিশুর ভবিষ্যত। লাগামহীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার ও ডিফফেক প্রযুক্তি এখন একটি মূর্তিমান আতঙ্ক। আপনার শিশুও এর শিকার হতে পারে। ভবিষ্যতে এই শিশু যদি বিখ্যাত বা সেলিব্রেটি কেউ হয়, তখন এই ছবির জন্য সে বিব্রত কিম্বা অসম্মানিতও হতে পারে।
মা-বাবারা না বুঝেই শিশুর স্পর্শকাতর ছবি পোস্ট দেন। বিশেষ করে শিশুর বস্ত্রহীন ছবি সবচেয়ে বেশি বিপদজনক। তাই শিশু যত ছোটই হোক শিশুর পোশাকহীন ছবি অথবা পোশাক পরিবর্তন করার ছবি ইন্টারনেটে শেয়ার করবেন না। গোসল করানোর মুহূর্ত বা খালি গায়ে ঘুরাঘুরির ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবেন না। শিশুকে বুকের দুধ পানের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেবেন না। এ ধরনের ছবির জন্য ভবিষ্যতে আপনি  ও আপনার শিশু দুজনই বিড়ম্বনার শিকার হতে পারেন।  
কারণ এসব ছবি খারাপ লোকের হাতে পড়লে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে পারে। অনাবৃত শরীরের ভিডিও দিয়ে বর্তমান এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্ণো ভিডিও তৈরি করা যায়। এসব ছবি দিয়ে সাইবার অপরাধীরা পর্নো ফিল্ম তৈরি করে বিক্রি করছে পর্ণোগ্রাফি সাইটে। 
অনেকে শিশুর অসুস্থ হওয়ার ছবি পোস্ট করেন। স্বাভাবিকভাবেই এই ছবিগুলো দেখতে মলিন, ফ্যাকাশে, রোগা টাইপের হয় অর্থাৎ দেখতে এত সুন্দর হয় না। কিন্তু পরবর্তীতে এই ছবির জন্য সহপাঠী বা বন্ধুরা তার সাথে উপহাস বা মজা করতে পারে।
শিশুর আচরণগত বা মানসিক বা শারীরিক কোনো সমস্যা থাকলে, তা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে অন্যের কাছে সমাধান চাইবেন না। এর ফলে শিশু শেমিং বা বুলিং এর শিকার হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া। 
শিশুর রাগারাগি বা কান্নাকাটি করার ভিডিও পোস্ট করবেন না। পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়েছে বলে শিশু কান্নাকাটি বা মন খারাপ করেছে, এ ধরনের বিষয়ও সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করবেন না। কারণ আবেগীয় অবস্থা অন্যের কাছে প্রকাশিত হয়ে গেলে শিশু মানসিকভাবে আঘাত পেতে পারে। শিশু ছোট হলে তারও যে একটি সত্ত্বা আছে, তার মধ্যেও যে মান-অভিমান-অপমান বোধ আছে- এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। 
শিশুর জন্মদিন, জন্ম নিবন্ধন সনদ, পাসপোর্ট, মেডিকেল রিপোর্ট, বাসার ঠিকানা ইত্যাদি কখনোই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবেন না। কারণ শিশুর নাম পরিচয় ও ছবি ব্যবহার করে অন্য কোথাও নিজের সন্তান বলে মিথ্যা তথ্য দিতে পারে। কোন স্কুলে পড়ে, কোন শিক্ষকের কাছে পড়তে যায়, কখন কোথায় যায়, কী করে- ইত্যাদি তথ্য মিডিয়ায় শেয়ার দিলে অপরাধীরা আপনার অবস্থান শনাক্ত করতে পারবে। পেশাদার কিডন্যাপারা এই তথ্য ব্যবহার করতে পারে। 
আপনার শিশুর সহপাঠী বা বন্ধুদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করবেন না। কারণ অন্য শিশুর অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া ছবি পোস্ট দেয়া এক ধরনের অন্যায়। আপনি বলতে পারেন, অন্য শিশুর ছবি বাদ দিলাম কিন্তু আমার সন্তানের ছবি আমি পোস্ট দিবো তাতে আপত্তি থাকবে কেন? আপনি সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলে- সন্তানের মালিক হয়ে গেছেন ব্যাপারটি তা নয় 
শিশুর ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করাকে ফ্রান্সে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ইতোমধ্যেই তাদের পার্লামেন্টে এ বিষয়ে আইন পাশ হয়েছে। আইন না মেনে শিশুর ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলে মা-বাবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে। এমন কি, মা-বাবা যদি একই ভুল বারবার করে তাহলে তাদের ছবি তোলার অধিকারও নিষিদ্ধ হতে পারে। ফ্রান্সের এই আইনকে শিশু মনোবিজ্ঞানীরা সাধুবাদ জানিয়েছেন। 
আমাদের দেশেও এ ধরনের আইন করার সময় এসেছে। শাস্তির ভয়ে বহু অভিভাবক অন্তত শিশুর বস্ত্রহীন বা স্পর্শকাতর ছবি পোস্ট দেয়া থেকে বিরত থাকবে। পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কেও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।   
লেখক-গবেষক এবং “প্যারেন্টিং কলাম” বইয়ের লেখক
ই-মেইল- [email protected]












সর্বশেষ সংবাদ
অর্ধলক্ষাধিক বইয়ের সমাহার কুমিল্লার গণগ্রন্থাগারে
চৌদ্দগ্রামে যুবককে পিটিয়ে হত্যা
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ফোন নাম্বার হ্যাক
জামায়াত নেতা মাহবুবর রহমানের মায়ের ইন্তেকাল
ব্রাহ্মণপাড়ায় বিজিবি অভিযানে গাঁজাসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় কুমিল্লার এক যুবক নিহত
কুমিল্লায় একদিনে তিন লাশ উদ্ধার
যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম স্মরণে শোক সভা
কাউকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না
চৌদ্দগ্রামে যুবককে পিটিয়ে হত্যা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২