আমাদের বাড়িতে ছয়টি হিস্যা ছিল। মাস্টার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। সে সময় ৫/৬জন মাস্টার (শিক্ষক) ছিলেন। তাঁরা ২/৩টি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।
বাড়িতে বসতঘর, রান্নাঘর, ঢেকিঘর, লাকরি ঘর, গরুঘর, কাচারি ঘর ইত্যাদি প্রায় প্রয়োজনীয় ঘর সকলেরই পৃথক পৃথক ছিল। কিন্তু বাড়িতে কোনো ঠাকুর বা দেবতার জন্য ঘর ছিল না। এমনকি কারও ঘরে ঠাকুর বা দেবতার আসনও ছিল না। ২/১ জনের ঘরে ধর্মীয় বই হিসেবে ‘শ্রীগীতা’ বইটি ছিল হয়ত বা। কাউকে পড়তে দেখিনি। তবে সকলের ঘরে স্কুলের পাঠ্য বই ছিল অঢেল। বলে রাখি- আমার বাবা তাঁর পঠিত প্রথম শ্রেণি- থেকে বি,এ ক্লাশের সব বই সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। এজন্য আমরা বাল্যকালে আদর্শলিপি-বাল্য শিক্ষা-বিদ্যালয়ের বর্ণ পরিচয় থেকে বাংলা ও ইংররেজি বই ছাড়াও অংক-ভূগোল-ইতিহাস ইত্যাদি বই-এর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম।
বাড়িতে বছরে প্রতি ঘরে দু’টি পুজো হতো-লক্ষ্মীপূজা ও সরস্বতী পূজা। লক্ষ্মী ধন বা ঐশ^র্যের দেবী, সরস্বতী হলেন বিদ্যাদেবী। এ উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়া পর্বটি ছিল উল্লেখ করার মতো। লক্ষ্মীপূজার পরের দিন বাড়ির সবায় একত্রে হাঁসের মাংসের ভোজ উপভোগ করতাম। এছাড়া মা-কাকী-জেঠী-ঠাকুরমা’রা কয়েকটি মেয়েলি ব্রত করত। যেমন কার্তিকব্রত-পরমেশ^র ব্রত-চৈত্রসংক্রান্তিতে নাড়ু তৈরির ব্রত, পুকুরের ঘাটে তেলদান ব্রত ইত্যাদি। এসব নিয়েই আমরা হিন্দু হিসেবে নিজেদের দাবী করতাম বা করেছি। মূলত জন্মসূত্রে ‘হিন্দু’ এটুকু বলা যেতে পারে। ধর্মীয়ভাবে সম্প্রদায় হিসেবে দাবী করাটা পরম্পরা, যার কোনা যৌক্তিক ভিত্তি নেই।
আমাদের পাড়ার ৪২ ঘরের বাস। তবে একত্রে নয়। বিচ্ছিন্নভাবে ২/৪টি হিস্যা নিয়ে একটি বাড়ি। প্রতিটি বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির কিছুটা দূরত্ব ছিল। সকল বাড়ির একই বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ একটি করে পুকুর, একবাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাতায়াত করতে হতো জংলা (জঙ্গল)-এর মধ্য দিয়ে। দিনের বেলায় অসুবিধা না হলেও রাতে অবশ্যই আলো সাথে রাখতে হতো। জঙ্গলে শিয়াল-সজাঁড়ু-বাঘদাস-সাপ ইত্যাদি ছিল। রাস্তাগুলো শুধু পায়ে চলার মতো। আমাদের গ্রামের ঘনজঙ্গলে বানর ছিল প্রচুর। তা ভিন্ন ইতিহাস।
আমাদের বাড়ির কিছুটা পশ্চিমে অর্থাৎ দুটি পুকুর ও জমির পর নাপিত বাড়ি। এ বাড়িতে একটি ঠাকুর ঘর ছিল। দু’বেলা পুজো দেয়ার পর ঘন্টা বাজত। প্রতি বছর মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে পৌষ মাসব্যাপী নগর কীর্তন হতো। পড়া ফাঁকি দেওয়ার উছিলায় ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ গাইতে নাপিত বাড়ি চলে যেতাম। সেখান থেকে কীর্তন শুরু হতো, ৪২ বাড়ি প্রদক্ষিণ করে আবার নাপিত বাড়ি এসে শেষ হতো। মাসের শেষে বাড়ি বাড়ি ঘুরে যুবকেরা ধান-চাউল-টাকা সংগ্রহ করত এবং পৌষমাসের শেষ দিন মাঠে খড়ের ঘর বানিয়ে উল্লাস করে পুড়িয়ে বাতাসা বিলি হতো। এতে আনন্দটাই মুখ্য, ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয় কেউ চিন্তা-ভাবনা করত না। তারপরও এগুলো হিন্দুসম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব বা অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হতো। বলতে দ্বিধা নেই-অধকাংশ হিন্দু জানেই না তাদের ধর্মের মূল বক্তব্য কি, করণীয় কি, পালন করার মধ্যে সার্থকতা কি, জীবনের তাৎপর্য কি বা কর্তব্য কর্ম কি- মোটকথা ধর্ম বলতে কি বুঝায় এবং কেন ধর্ম পালন করতে হয় বা হবে এ নিয়ে গভীর কোনো অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া ছোটবেলা দেখিনি। তখন মানুষ সরল ছিল, মানবিক ছিল, হৃদয়বান ছিল, সহমর্মিতা ছিল, বন্ধুতা ছিল, সহানুভূতি ছিল, আপদে-বিপদে একে অপরের পাশে গিয়ে দাঁড়াত, সাহায্য-সহযোগিতা করতো, অলিখিত মধুর সম্পর্ক ছিল। এভাবটি শুধু নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত ছিল না, পাড়া-প্রতিবেশী-গ্রামবাসীসহ অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গেও একটি নিবিড় মেলবন্ধন ছিল। সম্পর্ক সৃষ্টি করে কেউ ভাই, কেউ কাকা-চাচা, দাদী-নানী, দাদা-নানা-মামা ইত্যাদি সম্বোধনে একধরনের প্রশান্তিমূলক আত্মীয়তার বন্ধনে সকলে মিলেমিশে বাসবাস করত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দূরত্ব সৃষ্টি ছিল সংকীর্ণতা।
এখন এসব কথা কেন ? আমি নিজেকে অনুসন্ধান করছি। এ স্রোতে আমার পরিচয় কি। সম্প্রদায়গত শব্দগুলো ছোটবেলায় শুনেছি, সকলের আচরণও দেখেছি, তা দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছি। কে হিন্দু, কে মুসলমান নামেই চিনেছি। কিন্তু প্রাত্যহিক মেলামেশায় বর্তমানের মতো সংকীর্ণতা মনকে ছোট করেনি। লৌকিকতা ছিল না, ছিল অকৃত্রিম বন্ধুত্ব।
যখন বাড়ি ছেড়ে কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তে গেছি, লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর জীবিকার জন্য চাকরি করা শুরু করেছি, অর্থাৎ যতই তথাকথিত উপরের দিকে অগ্রসর হয়েছি, ততই মনের দিক দিয়ে, ব্যবহারিক আচরণের দিক থেকে সংকীর্ণ হতে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়েছি। কারণ ঐ পর্যায় সকলেই স্বার্থাবেশে অন্ধ হতে শুরু করেছি। লেখাপড়া যখন শুরু করেছি গ্রামে ছিলাম, স্কুলে পড়েছি, উচ্চশিক্ষা লাভের আগে অনেকটাই উদার-স্বচ্ছ-মানবিক-হৃদয়বান ছিলাম। লৌকিকতা ছিল না, কৃত্রিমতা ছিল না। এখন যেখানে এসে পৌঁছেছি তার একটি পোশাকি ধরণ আছে, ভেতরের কংকালটা নিষ্ঠুর ও মেকি। তাকে যেভাবে চিনি, এটা আসল চেহারা নয় মুখে যে কথা বলি তা মনের কথা নয়, যে পোশাক পরি তা উলঙ্গের চেয়েও বিসদৃশ, হাসিটা আন্তরিক নয়, কান্নাটাও আসল নয়। তার একটি নাম আছে- বলব না।
ভাবি- এ নিয়ে এতদিন কীভাবে বেঁচে আছি। আমার কথা বলতে পারি। আমার পেশা অর্থাৎ শিক্ষকতাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এখানে কোনো সম্প্রদায়ের বিভেদ নেই, যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি, তাকে ধর্মীয় পীঠস্থান বা পবিত্র স্থান হিসেবে জেনেছি, মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি, ব্রতটা ছিল মানুষ হওয়া, মানুষ তৈরি করা। এক বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে ৬৫ বছর উদযাপন করে নিজেকে একটা উপকন্ঠে দাঁড়া করাতে সক্ষম হয়েছি। পারিপাশির্^ক ঘটনাপ্রবাহ মাঝে মাঝে মনকে যন্ত্রণাদিলেও কাবু করতে পারে না। কারণ, বিবেক বলে এক অদৃশ্য অনুভূতি আছে, সে সবসময় পাহারা দিচ্ছে। তাই বলতে পারছি- ‘ভালো আছি’। ভালো থাকার এ এক মহৌষধ। তাকে সাহায্য করে সততা ও সাহস। মলিনতা থেকে মুক্ত রাখে উপেক্ষা, অবহেলা নয়।
কিছুটা পড়াশুনা করেছি। সাহিত্য-ইতিহাস-জীবনী-ধর্মীয় পুস্তক (যে কোনো ধর্মগ্রন্থ), দর্শন ইত্যাদি। সকল স্থানে একটি জিনিসই খুঁজে পেয়েছি- তাহলো সৃষ্টি-স্রষ্টা এবং মানুষ। লালনের বাণী হচ্ছে- মানুষ ভজলে স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। স্রষ্টাকে পাওয়া গেলে সৃষ্টিকে উপলব্ধি করা যায়।
মানব আকৃতিতে জন্ম। কিন্তু পরে বহু সাধনায় চেষ্টায় মানুষ হতে হয়। মানুষ হওয়া কি চাট্টি কথা ? এজন্য সাধনা ও চেষ্টা। আমি ৩৫ বছর শিক্ষকতা করতে গিয়ে মানুষ অনুসন্ধান করেছি, মানুষ বানাতে চেষ্টা করেছি। তারাই ছিল আমার দ্বিতীয় প্রাণ। এ নিয়ে কিছুকথা।
‘হাড়কিপটে’ একটি নাটকের সংলাপ। ছেলে বাপকে বলছে- ‘আব্বা, মাকে বিয়ে করাটাই আপনার ভুল হয়েছে।’ এ সূত্র ধরে বলতে পারি- ‘মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েই যেন ভুল করেছি।’ না হয় মানবতার এত অধ:পতন কেন ? মানুষ হয়ে মানুষকে এতটা নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার-অবহেলা কেন ?
সামনে ৩ ফেব্রুয়ারি শ্রীসরস্বতী পূজা। প্রতিদিন দলে দলে ছেলেরা পূজার চাঁদা চাইতে আসে। বলি- সরস্বতী পূজা কেন ? বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান অর্জনের জন্য। তাহলে সাম্প্রতিক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করছে কারা ? যে দেশে শিক্ষক অপমানিত হয়, মনগড়া পাঠ্যবই লিখে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের বিপথগামী শিক্ষা দেয়া হয়, শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য হয় সেখানে সরস্বতী পূজা কেন ? যে দেশে সরস্বতী নেই, সেদেশে জ্ঞানচর্চায় এতটা উচ্চতা কেন ? লক্ষ্মীদেবীর পূজা না করেও তো অনেক ধনসম্পদের মালিক হয়ে যাচ্ছে। তবে লক্ষ্মীপূজা কেন ? আমি প্রশ্ন করলেই স্বজাতিরা বলে তিনি হিন্দুধর্ম বুঝেন না, চর্চা করেন না। অন্য সম্প্রদায় আখ্যা দেন মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক হিসেবে। তাই এ নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমার কাছে মানুষই শেষ কথা। মানুষই আমার দেবতা। যিনি মানুষের সেবা করেন, ভালোবাসেন, মনেপ্রাণে গ্রহণ করেন- তাঁকেই শ্রদ্ধা করি।
জন্মের পর থেকে পারিবারিক পরিবেশ কিছু সংস্কার ও আচরণ শিক্ষা দিয়েছে, তা নিতান্তই পরম্পরা। যখন নিজেকে পৃথকভাবে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছি, তখন যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধির ক্ষেত্রটা প্রসারিত করতে চেষ্টা করেছি। বুঝেছি মানুষ হওয়া খুবই কঠিন অভিযাত্রা। শেষ কথা- যাঁরা মানুষ হয়েছেন, হচ্ছেন, হতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তাঁরাই টিকে আছেন, থাকবেন। তাই প্রার্থনা-
‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু।
এই-যে হিয়া থরোথরো কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু।।’