আগের উপনিবেশবাদ এখন আর নেই, বিদেশিরা এসে স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস করছে, এমন ঘটনা ঘটবে না, সাম্রাজ্যবাদের জন্য তেমন ব্যবস্থার প্রয়োজনও নেই। এখন রয়েছে বাজার দখল, রয়েছে ক্রেতা সৃষ্টি, আছে লগ্নি পুঁজির তৎপরতা, যে পুঁজি ঋণ হিসেবেও কাজ করবে। ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েল একসময়ে সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন, আরও অনেক তরুণের মতো; পরে আবিষ্কার করেছিলেন যে, সমাজতন্ত্র মানুষকে ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’ দেয় না। ১৯৪৪-এ লেখা তার অ্যানিমেল ফার্ম বইতে অরওয়েল স্ট্যালিনের রাশিয়ায় স্বাধীনতা হারিয়ে অনেক মানুষই শুয়োরে পরিণত হচ্ছে, এমনটা দেখিয়েছেন। পাঁচ বছর পরের উপন্যাস নাইনটিন এইটটি ফোরে তিনি আর রুশ দেশে যাননি, নিজের দেশ ইংল্যান্ডেই সমাজতন্ত্র এসে গেছে বলে কল্পনা করেছেন। তখন মানুষের যে কী দুর্দশা হবে তার ছবি আঁকা আছে ওই বইতে। সেখানে বাইরে থাকবে আউটার পার্টি, ভেতরে ইনার পার্টি এবং ইনার পার্টির ভেতরে বিগ ব্রাদার। সব মিলিয়ে একটি পুলিশি রাষ্ট্র, যেখানে ব্যক্তির স্বাধীনতা থাকার প্রশ্ন তো ওঠেই না, কোনো প্রকার আড়ালও নেই। টেলিভিশন সম্পর্কে লোকে তখন তেমন জানতই না। অরওয়েল কল্পনা করেছেন যে, ওই রাষ্ট্রে সর্বত্র পাতা রয়েছে টেলিভিশনের পর্দা, এমনকি গোসলখানাতেও; ওই পর্দার সাহায্যে বিগ ব্রাদার সবকিছু দেখছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেখানে ভিন্নমত সহ্য করা হয় না, ভিন্নমতাবলম্বীকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। ভালোবাসা, চিন্তা, ভাষা- সবকিছু নিয়ন্ত্রণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় রয়েছে। ভাষাও বদলে গেছে, ভাষা থেকে ‘ঈশ্বর’ নির্বাসিত হয়েছেন।
ঈশ্বরের আশীর্বাদে তেমন ঘটনা ঘটেনি, ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডে সমাজতন্ত্র আসেনি, এমনকি ২০০১ সালেও নয়। বিশ্বময় আজ পুঁজিবাদের আধিপত্য। অরওয়েল জীবিত থাকলে স্বীকার করতেন কি না জানি না, পুঁজিবাদ নিজেই আজ ঈশ্বর হয়ে বসেছে। পৃথিবীব্যাপী সে ঢল নামিয়ে দিয়েছে প্রমোদ ও লালসার। ভোগের পীড়নে তপ্ত হয়ে উঠেছে ধরিত্রী, ফুলে উঠছে পানির উচ্চতা, বাড়ছে ঝড় ও বন্যা। ব্যক্তি তার চিন্তার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা হারিয়েছে। পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে সর্বস্তরে। না, সশস্ত্র পুলিশের দরকার নেই। পুলিশের কাজ করছে টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে তথাকথিত বিপ্লব। এসব অবশ্য বিড়ম্বনা ধনীর জন্যই শুধু, গরিব মানুষ এসব থেকে অনেক দূরে। তাদের ওপর চেপে বসে আছে পুঁজিবাদী শোষণ, যার দরুন তাদের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মিটছে না। ওদিকে ভোগভিক্ষা সব মানুষের সৃষ্টিশীলতাকেই স্তিমিত করছে, নৈতিকতা পরিণত হচ্ছে স্থূল আত্মসুখসন্ধানে। অরওয়েলের নরক এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।
পুঁজিবাদী ঈশ্বর অন্য যেকোনো ঈশ্বরের তুলনায় অধিক ক্ষমতা রাখে। তার প্রধান কারণ সারা পৃথিবীকে সে পদানত করার আয়োজন করে ফেলেছে। বিশ্ব এখন একটাই, কেননা সর্বত্রই পুঁজিবাদের দীর্ঘবাহু প্রসারিত। এর ফলে পৃথিবী একাধারে ছোট ও খাটো হয়ে এসেছে। ছোট হচ্ছে বৈচিত্র্যহীনতা ও ঐতিহ্য-বিযুক্তির দিক থেকে খাটো হচ্ছে নৈতিকতা। পুঁজিবাদ সবকিছুতেই মুনাফা খোঁজে, দাম জানে, মূল্য জানে না। লাভ-লোকসানের হিসাবের বাইরে কোনো অর্জন ও পেশাকেই সম্মান করে না। এর বস্তুতান্ত্রিক হাত যাকে স্পর্শ করে তাকেই পরিণত করে পণ্যে, যেমন সংগীতকে করেছে, করেছে খেলাধুলাকে।
এই ব্যবস্থা বৈষম্য বৃদ্ধি করে। নারীকে মর্যাদা দেওয়ার কথা বলে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাকে শিকারে পরিণত করে বৈষম্যের। মেয়েদের নিরাপত্তা দেয় না, মজুরির ক্ষেত্রে নর-নারীতে বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার নাম করে অসম্মান ঘটায় নারীর ব্যক্তিত্বের। পুঁজিবাদের দাঁত ও নখর রঞ্জিত শ্রমজীবী মানুষের রক্তে। এখন যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে চেষ্টা চলছে শ্রমের মূল্য যতটা পারা যায় কমিয়ে আনার।
তথ্যবিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে। এই বিপ্লব নাকি পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। তা পৃথিবী তো আগেও বদলেছে, একাধিকবার; বাষ্পযান, বেতার, বিদ্যুৎ- এরা প্রত্যেকেই প্রায়োগিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, কিন্তু তাতে মানবিক সমস্যাগুলো বেড়েছে বৈকি, কমার পরিবর্তে। মানবিক সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে নিজের এবং অপরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, যেমন- ভালোবাসা, স্নেহ, মৈত্রী, শোষণ। অবাধ তথ্যপ্রবাহ ধনবৈষম্য হ্রাস করবে এমন সম্ভাবনা একবারেই নেই; এই প্রবাহ নিজেই বরঞ্চ বৈষম্য বৃদ্ধির একটি নতুন উপাদান হয়ে দাঁড়াবে, পার্থক্য দাঁড়াবে প্রবাহের সুযোগভোগকারী ও সুযোগবঞ্চিতদের মধ্যে। ওদিকে মুক্তবাজার অর্থনীতি দুর্বল ও স্থানীয় উৎপাদন উদ্যমগুলোকে একেবারে পথে বসিয়ে দিচ্ছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব দরিদ্র বিশ্বে ভোগ্যপণ্য তো বটেই, সমরাস্ত্র ও প্রকৌশল বিক্রি করছে, লগ্নি পুঁজি পাঠাচ্ছে, যেমন বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে, তেমনি ঋণের সাহায্যে।
এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ জমে উঠছে, খোদ পুঁজিবাদী দেশগুলোতেই পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। মূল যে সমস্যা, সেটি শোষণের, তাকে অস্পষ্ট করার জন্য নানা প্রকার তাত্ত্বিক ও দার্শনিক বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ১৯৮৯-তে ফুকুয়ামা নামে এক ভদ্রলোক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘দ্য অ্যান্ড অব হিস্ট্রি’ নাম দিয়ে; প্রবন্ধের শিরোনামে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছিল, পরে প্রবন্ধটির বক্তব্য যেভাবে প্রচার পেয়েছে তাতে কোনো প্রশ্ন নেই, যেন গোটা পুঁজিবাদী বিশ্বেরই প্রশ্নহীন বক্তব্য এটি। সেটি এই যে, ইতিহাস তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে; এখন অতীতের স্মৃতি অনাবশ্যক, প্রত্নতত্ত্ব তবু পাঠ করা যাবে, ইতিহাস পাঠ করে লাভ নেই, কেননা এখন বর্তমানই প্রলম্বিত হবে ভবিষ্যতের দিকে এবং সেই ভবিষ্যৎ দ্বন্দ্ববিহীন সুখের।
পুঁজিবাদীরা আজ এই কথাটাই বলতে চাইছে। তারা নানা রকমের সমাধিফলক রচনায় ব্যস্ত। বলছে মৃত্যু ঘটেছে সর্বজনীনতার এবং আদর্শবাদের। সেই রেনেসাঁসের কাল থেকে এই বিশ্বাস মানুষের মনে বিকশিত হচ্ছিল যে, মনুষ্যত্বের একটি কেন্দ্রীয় সত্তা আছে, যেটা সর্বজনীনও বটে। বিশেষ করে জার্মান দেশীয় দার্শনিকরা ওই সর্বজনীনতার ওপর জোর দিয়ে আসছিলেন। সর্বজনীনতার কথা কান্ট, হেগেল বলেছেন, মার্কসও বলেছেন। পরবর্তীকালে মার্কসের সর্বজনীনতাই সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেননা তাতে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এবং শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে ধ্বংস হবে এই অনিবার্যতার কথা। মৃত্যুর নানাবিধ সংবাদ ঊনবিংশতেও প্রচার পেয়েছিল; ঔপন্যাসিকরা বলেছেন তারা নায়ককে খুঁজে পাচ্ছেন না, সম্ভবত সে মারা গেছে; দার্শনিক নিৎশে বলেছেন, ঈশ্বর চলে গেছেন পরলোকে। কিন্তু এসব সংবাদে সর্বজনীনতাকে অস্বীকার করা হয়নি। অধুনা যা বলা হচ্ছে তা হলো, সর্বজনীন বলে কিছু নেই। সবকিছুই আপেক্ষিক; তাই সবার জন্য গ্রহণযোগ্য কোনো আদর্শও থাকবে না, থাকবে বহু চিন্তা, বিভিন্ন আদর্শ। স্বপ্ন থাকবে, তবে সেটা যোদ্ধাদের স্বপ্নের মতো সমষ্টিগত নয়, ভিক্ষুকের স্বপ্নের মতো ব্যক্তিগত। অথচ আদর্শ যে নেই, এই দাবিটাও একটি আদর্শের প্রচারই আসলে এবং একে দাঁড় করানো হচ্ছে সর্বজনীন সত্য হিসেবেই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতো পুঁজিবাদী আদর্শও চাইছে একচেটিয়া আধিপত্য। প্রচারণার মূল উদ্দেশ্যটা প্রচ্ছন্ন রাখা হচ্ছে। সেটা হলো শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বের যে সর্বজনীনতা ও আদর্শবাদ তাকে দুর্বল করা। এ কাজে তথাকথিত উত্তর-আধুনিকতার প্রবক্তারা বেশ পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছেন দুজন, ফুকো এবং দেরিদা। ফুকো মার্কসবাদকে অস্বীকার করছেন না, কিন্তু বলছেন, শ্রেণি সম্পর্কই একমাত্র সম্পর্ক নয়। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে ক্ষমতার, ক্ষমতার ক্ষেত্রে বর্ণ আছে, রয়েছে নারী-পুরুষ সম্পর্ক। ফুকো আরও বলছেন, মানুষ হচ্ছে একটি বহুমাত্রিক প্রাণী, তাকে বুঝতে হলে অনেক কিছুকে বিবেচনায় আনতে হবে; নৃতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, যৌনতা, আকাঙ্ক্ষা, উন্মাদনা, ভাষাতত্ত্ব, শৃঙ্খলা- এসব কোনো কিছুই অগ্রাহ্য নয়। তা গ্রাহ্য নিশ্চয়ই, দ্বন্দ্বও আছে বহুবিধ। কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে প্রধান যে দ্বন্দ্ব, সেটি যে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির, সেই সত্যটার কী হবে? উত্তর-আধুনিকতার অভিপ্রায় ওই দ্বন্দ্বকে অনেক দ্বন্দ্বের একটিতে পর্যবসিত করা এবং আপেক্ষিকতাকে সামনে নিয়ে আসা, যাতে করে নিপীড়িত মানুষ ও তাদের পক্ষাবলম্বীরা প্রধান দ্বন্দ্বের মীমাংসাকে আশু কর্তব্যজ্ঞান করে সংঘবদ্ধ না হতে পারে, যাতে তারা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়ে পড়ে, যুদ্ধটা ভুলে যায়।
বহুমাত্রিকতা ও আপেক্ষিকতার এই ধারণা আসলে মানুষকে দ্বিমাত্রিক করে তুলতে চায়, তার ভেতরকার দার্শনিক সামগ্রিকতা ও প্রতিরোধের সজীবতাকে নষ্ট করে দিয়ে তাকে তেমন প্রাণীতে পরিণত করতে চায়, যার জগতে বিষয় থাকবে প্রচুর কিন্তু বিষয়ী থাকবে না এবং বিষয়ের ঘাত-প্রতিঘাতে সে কখনো অস্থির কখনো নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকবে। মার্কসবাদীরা ইতিহাসকে প্রায় ঈশ্বরের মর্যাদা দিতে চায়; উত্তর-আধুনিকরা ইতিহাসকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে আগ্রহী, তারা বলতে চায় যে, ইতিহাস এক নয়, বহুবিধ; মানুষ যেমন সামগ্রিক নয়, বহু খণ্ডে বিভক্ত, ইতিহাসও তেমনি বিক্ষিপ্ত। শত্রু তো একটা নয়, অনেক এবং তাদের শত্রুতাও আপেক্ষিক, স্থান-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন; তাহলে কার বিরুদ্ধে কীভাবে স্বতঃস্ফূর্ত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়বে তুমি? তার চেয়ে ভালো নিজেরটা দেখা। পরামর্শটা এই প্রকারের। এ হচ্ছে বিচ্ছিন্নকে আরও বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা, যাতে তারা যুদ্ধ ছেড়ে ভিক্ষার দিকে চলে যায়। উত্তর-আধুনিকতা খুবই চটপটে, কিন্তু তার কারণ হয়তো এই যে, তার ভেতরে বস্তুর অসদ্ভাব।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়