শিক্ষক
মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকই মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে
রূপান্তরিত করে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতা কেবল
চাকরি নয় বরং এক মহান পেশা ও ব্রত। যুগে যুগে কালে কালে তাই শিক্ষক জ্ঞানের
দ্বীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন জ্ঞানের ভান্ডার।
শিক্ষার
আলো জ্বেলে দেওয়ার মহতী চেতনা ও উপলব্ধি তাঁকে শিক্ষাদানের পবিত্র দায়িত্ব
পালনে উদ্বুদ্ধ করে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর মনন, মেধা ও প্রতিভার বিকাশ,
প্রসার ও উন্নয়ন সাধনে যথার্থ ভূমিকা রাখেন। আদর্শ শিক্ষক সহজ, সরল,
নিরহংকার, উদার, কর্তব্যনিষ্ঠ, নিঃস্বার্থ, নির্ভীক ও প্রগতিশীল মনের
অধিকারী। নিজের অর্জিত জ্ঞানভান্ডারকে তিনি সমৃদ্ধতর করে শিক্ষার্থীদের
মধ্যে বিতরণ করেন। তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা, নিরলস পরিশ্রম, সততা ও কঠিন নিয়ম
শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস।
এখন প্রশ্ন থাকতে পারে এই মহান
পেশার প্রতি দেশের শিক্ষকরা কতটা যত্নবান? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটা
আন্তরিক? এসব প্রশ্নের পাশাপাশি আরও প্রশ্ন আসে: যেমন শিক্ষকের দায়িত্ব ও
কর্তব্য পালনে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশ কতটুকু সহায়ক? আবার দেশের এই
শ্রেষ্ঠ মানুষ-শিক্ষকরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছেন কি?
এতে
নির্দ্বিধায় বলা যায়- শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে প্রচুর
অসংগতি। তা ছাড়া শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা
বোর্ডগুলো, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় শিক্ষাক্রমও
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের পরস্পরবিরোধী,
অস্পষ্ট, জটিল ও বৈষম্যমূলক বিধিবিধান, নিয়ম নির্দেশনা ও কর্তৃপক্ষগুলোর
মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে প্রতিনিয়ত শিক্ষা কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
হচ্ছে। সব কিছুই স্পষ্ট যে, শিক্ষকের মান উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়ন
সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন প্রতিভাশালী, মেধাবী ও সৃজনশীল মেধাবী ব্যক্তিদের
শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা।
শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য
শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে
হবে। শিক্ষকের জন্য গবেষণাকর্মের প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তবে
শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে বলতে হয়, বিষয়টি চরমভাবে
উপেক্ষিত। একটি স্বাধীন দেশের জন্য আমাদের শিক্ষকতার অবস্থা লজ্জাজনক।
এ
মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর, চলমান ধারাবাহিকতায় সরকারি ও
বেসরকারি দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলতে থাকে। যদিও একটি
স্বাধীন দেশে কোনক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত? শিক্ষার প্রত্যাশিত
মানোন্নয়নের লক্ষ্যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ দূর করে সামাজিক ন্যায়বিচার
প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের কোনো বিকল্প নেই। পৃথক শিক্ষা
সার্ভিস কমিশন গঠন করে অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালায় মেধাসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য
শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।
সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকের বৈষম্য দূর
করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি শিক্ষকের
অনুরূপ নিয়মিত বেতন-ভাতাদি প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যাতে আর্থিক
অসচ্ছলতার কারণে শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি বা অন্য কোনো বাড়তি কাজের
দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হতে না
হয়। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও
পদোন্নতির সুযোগ নেই। সৌভাগ্যবান কেউ কোনোমতে এক ধাপ এগিয়ে গেলেও পরবর্তী
সব ধাপ বন্ধ। শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন, আবাসিক ব্যবস্থা, কর্মস্থলে
যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থাসহ নানাবিধ সমস্যা রয়েছে।
অন্তর্বতীকালীন
সরকার দেশে বিরাজমান গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং স্থায়ী উন্নয়নের
পথ তৈরি করতে ১১টি খাতের জন্য “সংস্কার কমিশন” গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই
কমিশনগুলোর রিপোর্ট জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে: এরই মধ্যে
চারটি কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাকিগুলোর
প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাওয়া যাবে। সংস্কারের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে
প্রশংসনীয়। তবে অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয় হলো, সংস্কারের জন্য শিক্ষা খাতের
মতো মৌলিক একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
শিক্ষা কেবল একটি খাত নয়,
বরং এটি এমন একটি ভিত্তি, যার ওপর অন্যান্য সব খাতের সংস্কার-সাফল্য
অনেকটাই নির্ভর করে। ফলে শিক্ষা খাতের ওপর পর্যাপ্ত গুরুত্ব আরোপ ছাড়া
অন্যান্য খাতে অর্থবহ অগ্রগতি অর্জন প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশের
শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘ সময় ধরেই নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এ খাতের
সমস্যাগুলো কেবল ব্যক্তিগত উন্নয়নেই বাধা সৃষ্টি করে না, বরং এটি
স্বাস্থ্য, শাসনব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ
খাতেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শক্তিশালী
শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদি
পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জাতীয় উন্নয়নের পথে
অগ্রসর হওয়ার মূল চাবিকাঠি।
পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনীতির চাহিদার
সঙ্গে বর্তমান পাঠ্যক্রমের অসামঞ্জস্যের ফলে শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে
দক্ষতার অভাব অনুভব করছে, যা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি
করে। তাছাড়া যদিও সামগ্রিক শিক্ষার্থী ভর্তিহার বৃদ্ধি পেয়েছে, গুণগত
শিক্ষার ক্ষেত্রে এখনো উল্লেখযোগ্য বৈষম্য বিদ্যমান। বিশেষত গ্রামীণ
এলাকাগুলোতে, যেখানে শহুরে কেন্দ্রগুলোর তুলনায় অবকাঠামো, শিক্ষার উপকরণ
এবং দক্ষশিক্ষকের অভাব প্রকট। শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের
মতো বিষয়গুলো শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদন্ড। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকরা প্রায়ই
পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। শিক্ষক নিয়োগ
প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি অন্যতম প্রধান বাধা। এছাড়া,
শিক্ষকদের তুলনামূলকভাবে কম বেতন, অপ্রতুল সুযোগ- সুবিধা এবং অতিরিক্ত
কাজের চাপ তাদের পেশাগত অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। এর ফলে উচ্চমাত্রায় পদত্যাগ,
চাকরি পরিবর্তন এবং শিক্ষার মান হ্রাস পাচ্ছে।
গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার
মধ্যে প্রযুক্তিগত সুবিধার বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। শহুরে স্কুলগুলোতে
ইন্টারনেট, কম্পিউটার ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য হলেও
গ্রামীণ স্কুলগুলোতে এসব সুযোগ কম। প্রযুক্তির অভাব শিক্ষার্থীদের
ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন বাধাগ্রস্থ করে, যা তাদের আধুনিক কর্মক্ষেত্রের
প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেয়। গ্রাম-শহর বিভাজন দূর করে সমান প্রযুক্তিগত সুযোগ
নিশ্চিত করা শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সামগ্রিক
উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষা খাতের সংস্কার অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ
অন্যান্য খাতের সাফল্য সরাসরি শিক্ষার মান ও প্রসারের ওপর নির্ভরশীল।
গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভূমিকা অপরিসীম।
মানসম্মত শিক্ষা সচেতন নাগরিক তৈরি করে, যারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন
এবং নেতাদের জবাবদিহির আওতায় রাখতে সক্ষম। পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধ,
সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে শিক্ষার অপরিহার্য ভূমিকা
রয়েছে। শিক্ষা সরাসরি একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান
রাখে।
দক্ষ ও প্রশিক্ষিণ প্রাপ্ত কর্মশক্তি তৈরির জন্য মানসম্মত
শিক্ষা অত্যাবশ্যক। শিল্পায়ন ও প্রযুক্তি খাতে অগ্রগতি অর্জনের লক্ষ্যে
আইসিটি, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য। শিক্ষা খাতের উন্নতির
জন্য যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম প্রণয়নের বিশেষ প্রয়োজন। প্রথাগত শিক্ষার
পরিবর্তে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা এবং বাস্তব দক্ষতা শেখানোর
জন্য পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাসের সময়ের দাবি।
বৈষম্য দূর করতে হবে
গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মধ্যে। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলোর জন্য
বিশেষ বৃত্তি এবং সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। নারী শিক্ষার প্রসারে গ্রহণ
করতে হবে আলাদা পরিকল্পনা। শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়নের
সুযোগ তৈরির পাশাপাশি মানসম্পন্ন শিক্ষকতাকে উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয়
ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তির একীভূতকরণও
অত্যন্ত জরুরি। অনলাইন শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল
শিক্ষার সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুলগুলোর অবকাঠামো
উন্নত করতে হবে। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, পাঠদানসামগ্রী, নিরাপদ পানি এবং
স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। রাজনীতি ও
দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন রাখাটাও অপরিহার্য।
চলমান প্রেক্ষাপটে
অবিলম্বে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন “শিক্ষা কমিশন” গঠন করা যেতে পারে।
যথোচিত পন্থায় পরিচালিত হলে এই কমিশন শুধু শিক্ষা খাতের কাঙ্ক্ষিত
পরিবর্তনই আনবে না, বরং অন্যান্য খাতের জন্য গৃহীত সুপারিশ বাস্তবায়নেও তা
সহায়ক হবে। এভাবে সঠিক পরিকল্পনা, গবেষণা, এবং সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে
শিক্ষা খাতের আধুনিকায়ন করলে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে।
বর্তমান সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব কতৃপক্ষকে এই বিষয়ে বেশি মনোযোগ হওয়ার দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক সমস্যা তবুও সংস্কার কমিশন নেই!
প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ , কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।