সাহিত্যক্ষেত্রে প্রমথ
চৌধুরীর আবির্ভাব যেমন বিলম্বিত, খ্যাতিলাভ তেমনি দ্রুতত্রস্ত। বলতে গেলে
লেখনী ধারণ মাত্রই তাঁর বিজয়বার্তা চতুর্দিকে ঘোষিত হয়েছে। বিলম্বিত
আবির্ভাব এই কারণে বলেছি যে, সবুজপত্রের প্রতিষ্ঠা এবং প্রমথ চৌধুরীর
সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা এমন অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত যে, একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটির
কথা ভাবাই যায় না। সেই সবুজপত্রের জন্ম বাংলা ১৩২১ ইংরেজী ১৯১৪ সালে। তখন
প্রমথ চৌধুরীর বয়স ছেচল্লিশ। নিঃসন্দেহে পরিণত বয়স। এদিক থেকে প্রমথ চৌধুরী
এবং রাজশেখর বসু সমগোত্রীয়। তাঁরা রয়ে সয়ে প্রচুর পুঁজিপাটা নিয়ে রীতিমত
তৈরী হয়ে সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করেছিলেন। এসে আর হাত মক্স করতে হয়নি, ধরেই
পাকা হাতের পরিচয় দিয়েছেন। দুজনের বেলাতেই দিগি¦জয়ী রোম্যান বীরের মতো
সমরা- ঙ্গনে প্রবেশ এবং জয়লাভ মুহূর্তে সংঘটিত হয়েছে।
জীবনের চল্লিশ
বৎসরকাল তিনি একান্ত মনে বিদ্যাচর্চাতেই কাটিয়েছেন সাহিত্য এবং দর্শনের
কৃতী ছাত্র। সংস্কৃত সাহিত্যে সুগভীর তাঁর অধ্যয়ন, প্রাচ্য পাশ্চাত্ত্য
দর্শনে নিত্য অনুসন্ধানী তাঁর মন, দেশ-বিদেশের সাহিত্যে অবাধ সঞ্চারণ।
বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অধ্যয়ন এবং অনুসন্ধিৎসা কত বিস্তৃত ছিল তার আক্ষরিক
প্রমাণ তাঁর রচনার বৈদগ্ধ্যে, চাক্ষুষ প্রমাণ তাঁর সুনির্বাচিত
গ্রন্থসংগ্রহে। তার কতক অংশ বিশ্বভারতী গ্রন্থাগারে, কতক বারাণসী হিন্দু
বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দান করে গিয়েছেন।
বহু স্মৃতি, বহু শ্রতি, বহু
অধ্যয়নে সমৃদ্ধ তাঁর মন। খুব কম লেখকই সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন।
শিল্পে সাহিত্যে অশিক্ষিত পটুত্বের অবকাশ আছে অর্থাৎ অধ্যয়নের অভাব বহু
দর্শনে, বহু শ্রবনে, বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে পূরণ করা অভাব বুদ্ধির দ্বারা
পূরণ হয়। তীক্ষè বুদ্ধির সঙ্গে দিব্যদৃষ্টির যোগ হলে চাই কি শেকসপীয়ারেরও
সৃষ্টি হতে পারে। শেকসপীয়ার ছাড়াও দেশে বিদেশে অনেক সাহিত্যিক দেখা গিয়েছে
যাঁরা পণ্ডিত নন কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তি। সে জ্ঞান তাঁদের অভিজ্ঞতা-লব্ধ।
বাস্তবিকপক্ষে এ কথা বারংবার প্রমাণিত হয়েছে যে, পুঁথি- পড়া বিদ্যা ছাড়াও
উঁচু দরের সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব। সেই সঙ্গে এ কথাও প্রমাণিত হয়েছে যে সে
সাহিত্যের আবেদন বহুবিস্তৃত। এটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ বেশির ভাগ পাঠকও
অশিক্ষিত পটুত্বের অধিকারী। তাঁদের বিদ্যে নেই, বুদ্ধি আছে। তাঁদের
জ্ঞানগম্যি অল্প কিন্তু রসবোধ প্রচুর। সাহিত্যসৃষ্টি এবং সাহিত্যপাঠ-উভয়
ক্ষেত্রেই বিদ্যার চাইতে বুদ্ধির অর্থাৎ রসবোধের প্রয়োজন বেশী। অপর পক্ষে
রসবোধের সঙ্গে বহু অধ্যয়ন যুক্ত হলে যে সাহিত্যের সৃষ্টি হয় সে অন্যবিধ
গুণের অধিকারী। তার নিজস্ব একটি আভিজাত্য আছে সেটি তার বৈদগ্ধ্য-জাত। তার
রীত-চরিত্রও আলাদা। সে বাক্যে এবং ব্যবহারে সংযত, মুখরতার চাইতে প্রথরতা
বেশী, উচ্ছলতার চাইতে উজ্জ্বলতা। এ সাহিত্যের আবেদন অপেক্ষাক্বত সীমাবদ্ধ
হতে বাধ্য কারণ এর জন্যে খানিকটা মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। লেখক যেখানে
নানা বিদ্যাচর্চার অলিগলি ঘুরে সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করেছেন পাঠককেও
সেখানে বিদ্যাবুদ্ধিতে একটু শান দিয়ে নিতে হয়, নতুবা এর পুরো রসটুকু গ্রহণ
করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
সাহিত্যিককে পণ্ডিত না হলেও চলে কিন্তু
তাঁর পণ্ডিত হতে কোনই বাধা নেই। বরং পাণ্ডিত্যকে যদি তিনি কাজে লাগাতে
পারেন তাতে তাঁর সাহিত্য কর্মের জলুস বাড়বারই কথা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে
সাহিত্যের কাজে পাণ্ডিত্যকে ব্যবহার করায় অনেকখানি কৌশলের প্রয়োজন।
পাণ্ডিত্য জিনিসটা আকরিক লোহার ন্যায় ব্যবহার করতে গেলে তাকে শোধন করে নিতে
হয়। সেটা একরুকমের রাসায়নিক প্রক্রিয়া। বলা যেতে পারে কবি, সাহিত্যিক বা
শিল্পী মনের ধষপযবসু-যার গুণে বিদ্যা বা পাণ্ডিত্য রসে পরিণত হয়। ঐ শোধন
প্রক্রিয়াটা জানা না থাকলে পাণ্ডিত্যতা যতই গভীর হোক সাহিত্যের ভোগে লাগে
না। সুখের বিষয়, প্রমথ চৌধুরী পাণ্ডিত্যের ছোবড়াটুকু ফেলে দিয়ে শাঁসটুকু
ব্যবহার করতে জানতেন। পাণ্ডিত্যকে রসান্বিত করবার কৌশলটি তাঁর বিশেষ ভাবে
জানা ছিল। বিদ্বান ব্যক্তির অভাব দেশে তখনও ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু সেই
বিদ্যার ব্যবহারে যে কৌশল বা আর্টের প্রয়োজন সেটি তখনও বেশী লোকের জানা ছিল
না, এখনও নেই। সে কৌশল তাঁদেরই আয়ত্ত যাদের মন সঙ্গীর এবং সক্রিয়, যাঁরা
নিজের মতো করে ভাবতে জানেন। আবার এঁরাই পরের ভাবনাকেও সম্পূর্ণ নিজস্ব করে
নিতে পারেন। আর সব চেয়ে বড় কথা, যে মানুষ নিজে ভাবতে জানেন তিনি অপরকে
ভাবাতেও জানেন। প্রমথ চৌধুরীর এই গুণ প্রচুর পরিমাণে ছিল। তিনি নিজের মতো
করে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে সব কিছু দেখেছেন, ভেবেছেন, বলেছেন এবং সেই সঙ্গে
বাংলা দেশের শিক্ষিত সমাজকে নতুন করে ভাবাতে শিখিয়েছেন। তিনি সারাক্ষণ
নিজের মনের সঙ্গে তর্ক করতেন, সব জিনিস যুক্তি দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। এদিক
থেকে বলা যেতে পারে, প্রমথ চৌধুরী আমাদের প্রবন্ধসাহিত্যে নতুন এক
ভায়েলেকটিকের জন্মদাতা। সে ভাষা যেমন সতর্ক তেমনি সপ্রতিভ।
আমাদের ভাষার
এক প্রান্তে বিদ্যাসাগরী ভাষা, অপর প্রান্তে বীরবলী। বাংলা গদ্যের অবয়ব
নির্মাণ করে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথের হাতে সে ভাষাই
রূপে লাবণ্যে মোহনী রূপ ধারণ করেছিল। প্রমথ চৌধুরী কোন -কিছুরই মোহিনী রূপে
ভুলতেন না। যা স্বাভাবিক নয়, পোশাকী, তাকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। আমাদের
সাধু ভাষাকে তিনি পোশাকী ভাষা বলে বর্জনীয় মনে করেছেন। মানুষ মনের ভাব
প্রকাশ করে মুখের কথায়, সে কথা যখন কলমের মুখে প্রকাশ পাবে তখন তার রূপ কেন
বদলে যাবে তার সঙ্গত কারণ তিনি খুঁজে পাননি। এজন্যে লেখার ভাষাকে তিনি
যতটা সম্ভব মুখের ভাষার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। শিক্ষিত সমাজে মৌখিক বাক্য এবং
লিখিত বাক্যের ব্যবধান ঘুচে যাবে এটাই স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত। এই
অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজটি করতে গিয়ে প্রচুর বাধা এবং বিরুদ্ধতার সম্মুখীন
হতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সাহায্য ব্যতিরেকে কতখানি সম্ভব হত বলা যায় না,
তথাপি বাংলা সাহিত্যে চলতি ভাষা প্রচলনের ক্বতিত্ব বহুলাংশে প্রমথ চৌধুরীর
প্রাপ্য, এ কথা স্বীকার করতেই হবে। ভাষার কথ্য রূপই তাঁর ভাষার একমাত্র
গৌরব নয়। আগেই বলেছি তাঁর ভাষার আশ্চর্য মুনশিয়ানা। তিনি নিঃসন্দেহে বাংলা
ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী। বিশেষ করে লক্ষ্য করবার বিষয়ে যে,
রবীন্দ্র-গুণগ্রাহী- দের অগ্রণী হয়েও প্রমথ চৌধুরী সজ্ঞানে কোন বিষয়ে
রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ করেননি। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে তিনি প্রেরণা গ্রহণ
করেছেন আর কিছু নয়। লেখার মাল মসলা, ঠাটঠমক সমস্তই তাঁর নিজস্ব।
প্রমথ
চৌধুরী স্বনামে বেনামে দুভাবে লিখেছেন। গল্প, কবিতা এবং সাহিত্য সমাজ
রাজনীতি বিষয়ক প্রবন্ধাদি লিখেছেন স্বনামে। অন্যত্র তিনি ছল করে ছদ্মনামের
ব্যবহার করেছেন। প্রমথ চৌধুরী স্বভাবত মজলিসী মানুষ ছিলেন। মজলিসী মানুষরা
সারাক্ষণ কাজের কথা বা জরুরী কথা নিয়ে থাকতে পারেন না। তাঁদের সব কথাই
কথার কথা অর্থাৎ কিনা বাজে কথা। কিন্তু সেই বাজে কথাতে একটু যদি রস লাগানো
যায় তা হলে সেই জিনিসই সাহিত্য হয়ে ওঠে। সুবিখ্যাত ইংরেজী উপন্যাস ঞৎরংঃৎধস
ঝযধহফধুর রচিয়তা বলেছিলেন, 'ডৎরঃরহম, যিবহ ঢ়ৎড়ঢ়বৎষু সধহধমবফ, রং নঁঃ ধ
ফরভভবৎবহঃ হধসব ভড়ৎ পড়হাবৎংধঃরড়হ.' আমাদের সাহিত্যে এ উক্তির সত্যতা প্রমাণ
করেছেন বলতে গেলে একমাত্র প্রমথ চৌধুরী। গুরুগম্ভীর বিষয়েও এমনভাবে
লিখেছেন, মনে হবে ঠিক যেন কথা বলে যাচ্ছেন।
প্রমথ চৌধুরীর সব চাইতে বড়
ক্বতিত্ব তিনি বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিকেল রীতির প্রবর্তক। বাংলা ভাষার
স্বভাবধর্মবশত আমাদের ভাষার সুললিত ভঙ্গির চর্চাটাই অত্যধিক হয়েছে।
প্রত্যেক ভাষাতেই লালিত্যের যেমন প্রয়োজন তেমনি ঋজু কঠিন ভাবেও প্রয়োজন
আছে। বাংলা ভাষায় সেটার যথেষ্ট অভাব ছিল। সে অভাব প্রমথ চৌধুরী অনেকাংশে
পূরণ করেছেন। বাঙালি মন স্বভাবধর্মে আলস্যপরায়ণ, জড়ত্বপ্রাপ্ত মন।
নির্বিচারে সব কিছুকেই গ্রহণ করা তার স্বভাব। সেই স্বভাবকে তিনি খানিকটা
চৌকস এবং সচকিত করে তুলেছিলেন। বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথও যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবী
মানুষ ছিলেন, কিন্তু তাঁদের লেখনীর মোহিনী মায়া যতখানি আমাদের মুগ্ধ করেছে,
তাঁদের দিক্সন্ধানী সত্যান্বেষী মন ততখানি আমাদের স্পর্শ করেনি। বোধ করি
এই অর্থেই কেউ কেউ বলেছেন যে, বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন সোনার কলম দিয়ে
আর প্রমথ চৌধুরী লিখেছেন ইস্পাতের কলম দিয়ে। সে ইস্পাত আবার ইংরেজীতে যাকে
বলে ড়ভ ঃযব ভরহবংঃ ঃবসঢ়বৎ. সে ভাষার যেমন ধার তেমনি ঝকঝকে তার মূর্তি। এমন
খুরধার মেদলেশহীন সুগঠিত ভাষা বাংলা সাহিত্যে ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। প্রমথ
চৌধুরীর গল্প সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন “ঠিক তোমার
সনেটেরই মত পালিশ করা, ঝকঝকে, তীক্ষè। উজ্জ্বলতার বাতায়ন মগজের তিনতলা
মহলে মধ্যাহ্নের আলো সেখানে অনাবৃত। রসাক্ত সুমিষ্টতা দোতলায়, সেখানে রসনার
লোলুপতা। তোমার লেখনী সে পাড়া মাড়াতে চায় না।” এ কথা তাঁর গল্প সম্বন্ধে
যতখানি প্রযোজ্য, প্রবন্ধ সম্বন্ধে ততথানি তো বটেই, বোধ করি ততেধিক। এমন
শানিত ভাষায় লেখা প্রবন্ধ ইতিপূর্বে বাংলা সাহিত্যে দেখা যায়নি। রঙ্গে
ব্যঙ্গে, হাস্যে শেষে, বিদ্যার ঔজ্জ্বল্যে, বুদ্ধির ঝলকে প্রবন্ধসাহিত্যকে
তিনি এক নতুন মূর্তিতে উপস্থাপিত করেছিলেন।
একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে
যে, তাঁর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধসব একই গুণে গুণান্বিত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়
পালিশ-করা), ঝকঝকে, তীক্ষè। কবিতা খুব বেশী লেখেননি। দু'খানা মাত্র
গ্রন্থ-সনেট পঞ্চাশৎ এবং পদ-চারণ শেষোক্ত নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। দুটিই
শীর্ণকায়, কিন্তু ঝিলমের শীর্ণ স্রোতের ন্যায় ‘খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার'।
আবেগের বাষ্প-মাত্র নেই, তাই বলে শুষ্ক নয়। ধারালো ঝাঁঝালো অথচ রসালো।
পদচারণ নামক কবিতা-গ্রন্থটি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে উৎসর্গীকৃত।
উৎসর্গপত্রে নিজেই বলেছেন এ পদ্যগুলো গদ্যের কলমে লেখা। এ কবিতা যে
ক্লাসিকেল রীতিতে রচিত ঐ কথার মধ্যেই তার আভাস আছে।
আমাদের দেশে এ যুগের
সব লেখকই বলতে গেলে ইংরেজী পাঠশালার ছাত্র। প্রমথ চৌধুরী পাঠ নিয়েছেন
ফরাসী পাঠশালায়। দর্শনে বার্গসনস তাঁর গুরু- সাহিত্যে ভলতেয়ার। ভলতেয়ারের
ভাষা সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন ‘লঘু, তীক্ষè, চোস্ত, সাফ’ কোথাও
ঢিলেঢলা কিছু নেই, যেমন আঁটসাট দেহের বাঁধুনি, তেমনি ঝলমলে উজ্জ্বল
মুখশ্রী। অনেক কাল আগে যখন প্রমথ চৌধুরী সবে লেখায় হাত দিয়েছেন তখনই
রবীন্দ্রনাথ তাঁর লিখনভঙ্গি সম্বন্ধে একটি চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন যে,
কোথাও ফাঁক নেই, শৈথিল্য নেই, একেবারে ঠাসবুনানি। সেই চিঠিতে এ কথাও
বলেছিলেন যে, এ গুণটি প্রাচ্য নয়। ঠিকই বলেছেন, প্রমথ চৌধুরীর মনটা
পশ্চিমমুখী। পদ্য লিখছেন ইটালীয় ছাঁদে, গদ্য ফরাসী চালে।
প্রমথ চৌধুরীর
নামের সঙ্গে সবুজপত্রের নাম অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, এ কথা পূর্বেই বলেছি।
সবুজপত্র নিঃসন্দেহে তাঁর জীবনের বৃহত্তম কীর্তি। তার কারণ সবুজপত্র
কেবলমাত্র একটি সাহিত্যপত্র নয়, এটি বাংলা দেশের একটি ষরঃবৎধৎু সড়াবসবহঃ,
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটি বিশেষ একটি অধ্যায়। খুব একটি শুভ লগ্নে ১৯১৪
সালে এর জন্ম। এক বৎসরও পূর্ণ হয়নি, রবীন্দ্র- নাথ নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যের গৌরব নিঃসন্দেহে বেড়েছে, সাহিত্যসেবীদের মনে নতুন উদ্দীপনা
এসেছে, বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায়ের মনে। ঠিক সেই মুহূর্তে নতুন আদর্শে
অনুপ্রাণিত একটি সাহিত্যপত্রের পরি- কল্পনা খুব স্বাভাবিক কারণেই মনে
এসেছে। দেশের যৌবনকে, নবীন সম্প্রদায়কে নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করা এবং নতুন পথে
পরিচালিত করাই এ পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল। আমাদের জরাগ্রস্ত জড়ত্বপ্রাপ্ত
দেশে সবুজপত্র জীবনের এবং যৌবনের বার্তা প্রচার করবে এই ছিল স্পষ্টত তার
ঘোষণা। এইজন্যেই একে একটি আন্দোলন বলেছি। রবীন্দ্রনাথ সে আন্দোলনের
পৃষ্ঠপোষক, প্রমথ চৌধুরী প্রধান কর্মকর্তা। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ নিয়ে যে
সবুজপত্রের যাত্রা শুরু তার প্রমাণ পত্রিকার প্রথম প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের
জন্মদিন ২৫শে বৈশাখে (১৩২১)। শুধু তাই নয়, আমার মতে ঠিক ঐ সময়ে সবুজপত্রের
প্রতিষ্ঠাকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির ঢ়ঁনষরপ পবষবনৎধঃরড়হ
হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। আবার সবুজপত্র যে যৌবনের অভিযান হিসাবে যাত্রা
শুরু করেছিল তারও প্রমাণ প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথের সুবিখ্যাত সবুজের
অভিযান নামক কবিতা। ‘আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’-এটাই ছিল সবুজপত্রের
প্রধান উদ্দেশ্য। ঐ সংখ্যাতে বীরবলের প্রবন্ধ ‘সবুজপত্র’-তাতে তিনি
পত্রিকার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে সবুজের তথা যৌবনের গুণকীর্তন করেছেন। এ
ছাড়াও প্রথম সংখ্যায় ছিল সত্যেন দত্তের কবিতা ‘সবুজ পাতার গান’। তাতে তিনি
যৌবনকে রাজটিকা দেবার প্রস্তাব করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জরা- গ্রস্ত
দেশের নাম দিয়েছিলেন জরাসন্ধের দুর্গ। প্রমথ ঢুকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন
“আমাদের জরাসন্ধের দুর্গের মধ্যে দেশের ক্ষত্রিয়েরাই বন্দী রয়েছে, যারা
ক্ষত থেকে দেশকে ত্রাণ করবে, যারা দূরে দূরান্তরে আপন অধিকার বিস্তার করবে,
যারা বিরাট প্রাণের ক্ষেত্রে দেশের জয়ধ্বজা বহন করে নিয়ে যাবে। সেই যুবক
ক্ষত্রিয়দের হাত পা থেকে জরার লোহার বেড়ি ঘুচিয়ে দেবার ব্রত নিয়েছ তোমরা।”
যদ্দুর মনে পড়ছে সম্পূর্ণ চিঠিটি পরে সবুজপত্রে ছাপা হয়ে ছিল। এটিকে
সবুজপত্রের সধহরভবংঃড় বলা যেতে পারে। প্রমথ চৌধুরী একদা অগ্রণী হয়ে
জরাসন্ধের লৌহকপাটে আঘাত হেনেছিলেন, সে ক্বতিত্ব তাঁকে দিতে হবে। তাঁর
শক্তির উপরে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ আস্থা ছিল বলেই তাঁকে ঐ কাজে এমন
অকুণ্ঠভাবে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
কবিতা প্রবন্ধ গল্প-সাহিত্যের এই তিন
বিভাগেই তিনি ক্বতিত্বের অধিকারী। নাটকে হাত দেননি। কিন্তু তাঁর কোন কোন
গল্প একটি যেন সড়হড়ষড়মঁব, সেও এক ধরনের নাটক। তা ছাড়া অনেক গল্পই ফরধষড়মঁব
প্রধান। উরধ- ষড়মঁব রচনায় এতখানি যার নৈপূণ্য তিনি ইচ্ছে করলে নাটক রচনায়
প্রয়াসী হতে পারতেন, কিন্তু তাঁর মনের গড়নটা ঠিক নাটক রচনার অনুকূল ছিল না।
তাঁর মন এবং বলার ধরুণ দুটোই অতিমাত্রায় মজলিসী। নাটকেও একটা সুনির্দিষ্ট
সুবিন্যস্ত কাঠামো আছে, খানিকটা যেন ংঃৎধরঃ-লধপশবঃ পরানো মূর্তি ‘সে
ইচ্ছামত হাত পা ছুঁড়তে পারে না। তাকে একটা নির্দিষ্ট পথে নির্দিষ্ট পরিণতির
দিকে এগিয়ে যেতে হয়। মজলিসী গল্প সে রকম নয়, সে আপন খুশিমতো ডাইনে বাঁয়ে
হেলে দুলে চলে, সদর রাস্তা ছেড়ে যখন তখন অলিতে গলিতে ঢুকে পড়ে। নাটক
জিনিসটা অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন বস্তু তাকে একটা রহবারঃধষনব পরিণতিতে
গিয়ে পৌঁছতে হয়। মজলিসী গল্পের কোন দায়দায়িত্ব নেই সেখানে রহবারঃধনষব বলে
কিছু নেই। অত্যন্ত গম্ভীর সুরে যার আরম্ভ মৎড়ঃবংয়ঁব-এ তার অবসান। পরমা
রূপসী অকস্মাৎ প্রেতিনী প্রতিপন্ন হয়। যেখানে চার-ইয়ারী-কথা সেখানে
ইয়ারবক্সীসুলভ খানিকটা রৎৎবংঢ়ড়হংরনষব আবহাওয়া থাকবেই। প্রমথ চৌধুরীর সব
গল্পই বলতে গেলে ‘ফরমায়েশী গল্প'। সেটাকে তিনি ইচ্ছামত কান মুচড়ে মুচড়ে
একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
প্রমথ চৌধুরী কে জিজ্ঞেস করা
হয়েছিল, গল্প কাকে বলে। তিনি বলেছিলেন, যা শুনতে ভালো লাগে তাই গল্প। এই
কথাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সেই আদি যুগ থেকে লোকে বলছে, গল্প বল। গল্প
বরাবর লোকে শুনতেই এসেছে। গল্প বলা আর শোনা এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। লেখা
গল্প বসে বসে পড়তে গেলে গল্পের স্বাভাবিকতা খানিকটা নষ্ট হয়ে যায়। মুখে বলা
গল্প এক, কলমে লেখা গল্প আর। কলমের কালিমা একটু তার গায়ে লাগবেই। মুখে বলা
গল্পের মুখশ্রী আলাদা। প্রমথ চৌধুরী তাঁর বলার গুণে গল্পের সেই মুখশ্রটি
অবিকৃত রেখেছেন। অর্থাৎ গল্পটা পড়লেও মনে হয় যেন কারো মুখ থেকে শুনছি।
তাঁর
স্বকীয়তা এবং অন্যান্য সমস্ত গুণের পূর্ণ মর্যাদা দিয়েও একটি কথা বলা
আবশ্যক। হৃদয়াবেগ নামক পদার্থকে তিনি অতিশয় সন্দেহের চোখে দেখেছেন এবং
সর্বপ্রকারে তাকে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করেছেন। ভাবে গদগদ হওয়া কোন কাজের কথা
নয়, কিন্তু তাই বলে কাব্যে সাহিত্যে বসড়ঃরড়হ এবং ংবহঃরসবহঃ জাতীয় জিনিস
একেবারেই অচল এমন কথা কেউ বলবেনা। দেহে অতিরিক্ত চর্বি থাকা বাঞ্ছনীয় নয় ;
কিন্তু খানিকটা চর্বি শরীরের পোষণ এবং রক্ষণের জন্যে অত্যাবশক। প্রমথ
চৌধুরীর গল্পে কবিতায় চর্বি নেই। শরীরে চর্বি না থাকলে যেমন শীর্ণকায় দেখতে
হয় প্রমথ চৌধুরীর রচনায় তেমনি একটি শীর্ণ ইংরেজিতে যাকে বলে বসধপরধঃবফ ভাব
আছে। কবিতায় সেই পরিপুষ্ট মুখশ্রী নেই, গল্পের অনেক চরিত্রই পূর্ণাবয়ব হয়ে
ফুটে ওঠেনি। আগে বলেছি যে পোশাকী জিনিসকে তিনি সাহিত্যে বর্জনীয় মনে করতেন
কিন্তু কৌতুকের বিষয় যে, হৃদয়ানুভূতিকে বাদ দেওয়ার দরন তাঁর গল্পের
চরিত্রগুলোকে ঠিক রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না। এরা পোশাকী মানুষ।
যেখানে মানুষ নিয়ে কারবার সেখানে ভাবে ভাষায় একটু আর্দ্রতার প্রয়োজন আছে। ঐ
আর্দ্রতার অভাবে তাঁর গল্প যতদিন যাচ্ছে, তত যেন একটু নৎরঃঃষব হয়ে পড়ছে।
প্রমথ চৌধুরী রাজ্যে প্রেমে পড়লেই বোকা বনতে হয়। চারইয়ারী কথার চার বন্ধুই
সমান তুখোড় কিন্তু শেষ পর্যন্ত চারজনাই বোকা বনেছেন। রিঃ-এর ঝলকে কথার
বাহাদুরিতে পাঠকের মনকে ধাঁধিয়ে দেবার মতো অর্থাৎ এর মধ্যে ষরঃবৎধৎু ারৎঃঁব
যতখানি তার চাইতে ঢের বেশী এর ঠরৎঃঁড়ংরঃু. লিপিচাতুর্যে অতুলনীয় কিন্তু
সাহিত্যের অন্তিম পরীক্ষায় ক্ষীণজীবী।