শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি ২০২৫
১৮ মাঘ ১৪৩১
শিশু বিকাশ কেন্দ্র কি বন্ধের পথে?
শ্যামল আতিক
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫, ১:২১ এএম আপডেট: ৩০.০১.২০২৫ ১:৫৫ এএম |


 শিশু বিকাশ কেন্দ্র কি বন্ধের পথে?  “ছয় মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না, তারপরেও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। জানি না ভবিষ্যতে কী হবে?”- কথাগুলো বলছিলেন শিশু বিকাশ কেন্দ্রের একজন কর্মী। স্বভাবই আমি প্রশ্ন করলাম- বেতন ছাড়া সংসার চালাচ্ছেন কীভাবে? উত্তরে তিনি বললেন- কিছু জমানো টাকা ছিল, এতদিন সেটা খরচ করেছি। এ মাসে ধার করতে হয়েছে। 
কথাগুলো শিশু বিকাশ কেন্দ্রের একজন কর্মীর। যখন বলছিলেন তার কন্ঠ ভারী হয়ে আসছিল, ঠিক মতো বলতেও পারছিলেন না। কন্ঠে ক্ষোভ, হৃদয়ে অনিশ্চয়তা। একদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্তা ব্যক্তিরা পদপদবী ও সুযোগ সুবিধার জন্য বৈষম্যবিরোধী স্লোগান দিচ্ছেন, অন্যদিকে তাদের অধীনস্ত অনেক কর্মী ধার দেনা করে সংসার চালাচ্ছেন, বেতন না পেয়েও সেবা দিয়ে যাচ্ছনে। কী নির্মম বাস্তবতা! 
শিশু সন্তানরা কী খাবে, স্কুলের খরচ কে দেবে, বাসা ভাড়া কোত্থেকে আসবে, চিকিৎসার টাকা কীভাবে জোগাড় হবে- কিছুই বলতে পারছেন না। তারপরেও এই আশায় সেবা দিচ্ছেন যে- ভবিষ্যতে হয়ত তারা বেতন পাবেন। চারদিকে যখন সাম্য ও মানবধিকার রক্ষার স্লোগান, শিশু বিকাশের কর্মীদের তখন জীবন রক্ষার সংগ্রাম। 
গত ছয় মাস যাবত বেতন না পেলেও শিশু বিকাশের কেন্দ্রের কর্মীরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- এভাবে কতদিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এই কারণে যদি শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে যে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে- তা কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিরা আঁচ করতে পারছেন? 
আমাদের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দরিদ্র ও অশিক্ষিত। শিশু বিকাশ সম্পর্কে যাদের কোনো কোনো ধারনাই নেই। আরও ভয়ংকর দিক হচ্ছে, শিক্ষিত সমাজের অধিকাংশই প্রাক-শৈশব বিকাশ এবং শিশু মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানেন না। 
এ কারণে শিশুর অটিজম, ভাষাগত সমস্যা, আচরগত সমস্যা, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ, সহজে মিশতে না পারা সহ আরো অনেক বিকাশজনিত ত্রুটি, অধিকাংশ মা-বাবাই যথাসময়ে বুঝতে পারেন না। শিশু গায়ে গতরে বাড়তে থাকলে, সবকিছু ঠিক আছে বলে ধরে নেয়। দৃশ্যমান কোনো মারাত্মক রোগ বা অসঙ্গতি দেখা না দিলে, অধিকাংশ অভিভাবক ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। 
বয়স অনুপাতে শিশু চলাফেরা করতে পারছে কিনা? চোখে চোখে রেখে কথা বলছে কিনা? ভাষার বিকাশ ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা? সবার সাথে মিশতে পারছে কিনা? বয়স অনুযায়ী আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে কিনা? ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দেহের ফাইন মটর ও গ্রোস মটর বিকশিত হচ্ছে কিনা? ইত্যাদি বিষয়গুলো অধিকাংশ অভিভাবকই বুঝতে পারেন না।
যেখানে শহরের শিক্ষিত অভিভাবকদের অধিকাংশ এই বিষয়গুলো জানেন না, সেখানে গ্রামগঞ্জ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের কী অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। আরও কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, শিশুর বিকাশজনিত সমস্যা হলে কোথায় চিকিৎসা করাতে হবে, সেটাও তারা জানেন না।
এসব সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যেই শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মা-বাবা সাধারণত শিশুর শারীরিক কোনো সমস্যা নিয়ে হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে যান। চিকিৎসক যদি বিকাশজনিত কোনো ত্রুটি বা অসঙ্গতি দেখতে পান, তাহলে শিশু বিকাশ কেন্দ্রে রেফার করে দেন। কিছু মানুষ শিশু বিকাশ কেন্দ্রের সেবা সম্পর্কে জানলেও, অধিকাংশ মানুষ ডাক্তারদের পরামর্শে এখানে এসেছেন এবং সেবা পাচ্ছেন।
আরও আশার কথা হচ্ছে- শিশু বিকাশ কেন্দের এসে আপনি শিশু ডাক্তার, ডেভেলপমেন্ট থেরাপিস্ট এবং শিশু মনোবিজ্ঞানীর সেবা পেতে পারেন। এক জায়গায় তিন ধরনের সেবা। অর্থাৎ অল্প খরচে অভিভাবকরা শিশুর মনোদৈহিক এবং বিকাশজনিত ত্রুটির চিকিৎসা করার সুযোগ পাচ্ছেন একই জায়গায়।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের চিকিৎসাও এখান থেকে দেয়া হয়। অটিজম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, অতি চঞ্চলতা, খিচুনী, মৃগীরোগ ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা- এখানে এসে এমন কিছু সমস্যা শনাক্ত হয়েছে, যা হয়ত আর কিছু দিন দেরি হলে সারিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব বা খুব কঠিন হয়ে যেত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে ৩৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। তিন চারটি বাদে প্রায় সবগুলোই ঢাকার বাইরে। সবগুলো কেন্দ্রই সরকারী জেলা হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রমের সাথে সমন্বয় করে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। স্বাধীনতার পর থেকে স্বাস্থ্যখাতে যে কয়েকটি সুদূরপ্রারী উদ্যেগ নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রম অন্যতম। নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ।
উন্নত বিশ্বে প্রায় প্রতিটি হাসপাতালেই এ ধরনের সেবা পাওয়া যায়। কারণ তারা জানে- শিশুরাই তাদের বড় সম্পদ। সমৃদ্ধ রাষ্ট গঠন করতে হলে, শিশুদের বিকাশের দিকে মনোযোগ দিতে হবে সবার আগে। তাই তারা আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছেন।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে- আমাদের দেশে সরকারী পর্যায়ে এ ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে অনেক পরে। আরও কষ্টকর হচ্ছে, এই কার্যক্রম নিয়ে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের অবহেলা দৃশ্যমান। শিশু বিকাশ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা তারা কতটুকু অনুভব করেন, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহের যতেষ্ট কারণ রয়েছে।
তারা বলতে পারেন, আমাদের দেশে আরও অনেক সমস্যা আছে, সেগুলোর দিকেই তো মনোযোগ দিতে পারছি না। অনেক সমস্যা আছে, সেটা আমরাও মানি। এর মধ্যে কোন সমস্যাগুলো সমাধানে অগ্রাধিকার দিতে হবে সেটা জানাও জরুরি। যে যুবকের কোনো কাপড় নেই, তার জন্য আগে লুঙ্গি বা প্যান্ট পরা জরুরি, তারপরে শার্ট।
কিন্তু আমাদের কিছু নীতি নির্ধারক এই বিষয়গুলো বুঝতে চান না। কোনো কারণে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রম যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে যে আশু বিপর্যয় আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা কি তা অবগত আছেন। কয়েকটি ইঙ্গিত আমরা দিচ্ছি। প্রতিবছর আমাদের দেশে অসংখ্য শিশু জন্মগ্রহণ করছে। যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।  বেশি শিশুর জন্ম মানে, তাদের চিকিৎসার জন্য বেশি সেবা কেন্দ্র প্রয়োজন।
শিশুর সংখ্যা বেশি হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবন্ধি ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর সংখ্যা বাড়বে। ২০২৩ সালের ইউনিসেপের একটি রিপোর্ট বলছে- বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার কমলেও, প্রতিবন্ধি শিশুর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে অশনি সংকেত।
ভবিষ্যত বিকাশজনিত সমস্যা সমাধানে আরো বেশি জনবল ও সেবা কেন্দ্রের প্রয়োজন হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই শিশুদের চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তা না করতে পারলে, অটিজম প্রকট আকার ধারন করবে, প্রতিবন্ধি ও মানসিক সমস্যাগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বাড়বে। এই শিশুদের স্বাভাবিক জীবনযাপন ও পড়াশোনা বিঘ্নিত হবে, তাদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে পরিবার ও রাষ্টের চিকিৎসা ব্যয় বাড়বে বহুগুণ।
শুরুতে চিকৎসা করাতে পারলে তারা জনসম্পদে পরিনত হতে পারত, সেখানে তারা পরিণত হবে পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা। নিঃসন্দেহে তা রাষ্ট্রের অগ্রগতিকে পেছনের দিকে টেনে ধরবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব গোড়াতেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে- শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধি শিশুর চিকিৎসা দেশের মানুষ কোথা থেকে পাবে। আমার জানা মতে, কয়েকটি বিভাগীয় শহর বাদে সারাদেশে এখনো এই ধরনের চিকিৎসা অবকাঠামো গড়ে উঠে নি। শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে অনেক জেলা শহরের অভিভাবকরা চিকিৎসা ও পরামর্শ সেবা পাচ্ছেন। সেটাও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক কম। তাও আবার বন্ধ হওয়ার পথে।
শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রম যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মফস্বল ও দুর্গম জনপদের মানুষ তাদের শিশুদের চিকিৎসা করাবেন কোথায়? আশা করি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নীতি নির্ধারকরা এ দিকে বিশেষ মনোযোগ দেবেন। 
লেখক- গবেষক ও ‘প্যারেন্টিং কলাম’ বইয়ের লেখক












সর্বশেষ সংবাদ
কুমিল্লা ক্লাবের নির্বাচন আজ
একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হতেই হবে : তারেক রহমান
কুমিল্লায় এলজিইডি প্রধানের গাড়ি চুরির সময় যুবক আটক
দাউদকান্দিতে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু
বুড়িচং উপজেলা জাতীয়তাবাদী প্রবাসী ফোরামের কমিটি অনুমোদন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা ক্লাবের নির্বাচন ঘিরে ব্যাপক উৎসাহের আমেজ
নামাজ পড়েই গাড়ি চুরির চেষ্টা যুবকের!
নাঙ্গলকোটে একই স্থানে বিএনপির দু’গ্রুপের সভা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা
কুমিল্লায় গ্রাহকের অভিযোগে ফেঁসে গেলেন পূবালী ব্যাংক ম্যানেজার
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাদ্দামের বিচার দাবিতে দেবিদ্বারে বিক্ষোভ
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২