শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
৩০ ফাল্গুন ১৪৩১
ডিজিটাল কোকেন থেকে সাবধান
শ্যামল আতিক
প্রকাশ: শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১২:৫৭ এএম আপডেট: ০৮.০২.২০২৫ ১:৫০ এএম |




 ডিজিটাল কোকেন থেকে সাবধান ধরুন, ঢাকা শহরের ভালো একটি অ্যাপার্টমেন্টে আপনি বাস করেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব ভালো। আশপাশের মানুষজনও ভালো। অ্যাপার্টমেন্টের সামনে একটি খোলা মাঠ আছে। খেলাধূলার জন্য এই মাঠটি চমৎকার। তারপরেও আপনি শিশুকে এখানে খেলতে দেন না। কারণ, আপনি জানেন যে এই মাঠের পাশেই কয়েকটি ছাপরা ঘরে নিয়মিত বসে মাদকের আসর, চলে মাদকের বেচাকেনা।
এ থেকে বাঁচার জন্য, শিশুকে আপনি কম্পিউটার বা ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন দিয়ে ঘরের মধ্যে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন। তারপরেও আপনার ভয়, শিশু যেন কোনভাবেই ওসব ছাপরা ঘরের কাছে না যায়। যেতে দিলে আপনার ছেলেও মাদকাসক্ত হয়ে, তার নিজের জীবন বিপন্ন করে তুলতে পারে। তবে এখন আপনি নিশ্চিন্ত। শিশু হয় টিভিতে কার্টুন দেখে অথবা স্মার্টফোনে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটায় অথবা কম্পিউটারে ভিডিও গেমস খেলে অথবা ট্যাবে ইউটিউব দেখে। কাউকে বিরক্ত করে না বলে আপনিও খুশি।
কিন্তু প্রকৃত সত্য জানলে, আপনার এই খুশির স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ থাকবে না। বাইরের মাদক থেকে রক্ষার জন্য আপনি শিশুর হাতে আরও ভয়ংকর মাদক তুলে দিচ্ছেন। অথচ নিজেও জানেন না, কীভাবে আপনি এই কাজটি করছেন? আসলে বেশিক্ষণ স্ক্রিনের সামনে সময় কাটালে শিশুদের মধ্যে একধরনের আসক্তি জেগে ওঠে। হেরোইন-কোকেনের ন্যায় ডিজিটাল স্ক্রিনও তখন মাদকের মতো কাজ করে। মনোবিজ্ঞানীরা এই মাদককে ডিজিটাল কোকেন নামে অভিহিত করেছেন। 
তারা লক্ষ্য করেছেন, স্ক্রিন আসক্ত এবং কোকেন আসক্ত মানুষের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ব্রেন স্ক্যানে দেখা গেছে, মাদকাসক্ত ও স্ক্রিন আসক্ত উভয় দলেরই মস্তিষ্কের হোয়াইট ম্যাটার অংশটি ক্ষয়ে গেছে। হোয়াইট ম্যাটার নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের আবেগ, মনোযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা। হোয়াইট ম্যাটার ক্ষয়ে গেলে আবেগ ভারসাম্যহীন হয়, মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
মানুষের মস্তিষ্কে প্রতিনিয়ত ডোপামিন নামে এক ধরনের রাসায়নিক পর্দাথ নিঃসৃত হয়। কোনো কারণে প্রত্যাশার চেয়ে ভালো কিছু ঘটলে ডোপামিনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। যে কারণে ডোপামিনের নিঃসরণ বেড়ে যায়, মস্তিষ্ক সে কাজটি বার বার করতে চায়। প্রতিনিয়ত ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়ানোর জন্য আমাদের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়, এটাই আসক্তি। আসক্ত হলে মানুষ একই কাজ বার বার করতে চায়।
মাদকাসক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি ঘটে। প্রতিবার মাদক গ্রহণ করার পর দেহমনে এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় সাময়িক ভালো লাগা। এভাবে কিছুদিন চলতে থাকলে শরীর ও মস্তিষ্ক তখন একই মাদক বার বার গ্রহণ করতে চায়। এটা ছাড়া তার আর ভালো লাগে না।
স্ক্রিন আসক্ত মানুষের মধ্যেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে। কেউ যখন সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, ভিডিও গেমস নিয়ে মত্ত থাকে, তার মস্তিষ্কে তখন ডোপামিনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। জাগ্রত হয় সাময়িক উত্তেজনা এবং ভালো লাগার অনুভূতি। মস্তিষ্ক এই ভালো লাগার অনুভূতিকে আরও বাড়াতে চায়। সে তখন স্ক্রিনের সামনে আরও সময় কাটাতে চায়। এটাই স্ক্রিন আসক্তি। কিছুদিন পর এই আসক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ইচ্ছে করলেও এই আসক্তি থেকে বেরোতে পারে না।
মাদকাসক্ত ব্যক্তি যেমন বুঝতে পারে না সে ভুল কাজ করছে, স্ক্রিন আসক্তদের অবস্থাও একই রকম। মাদকাসক্তদের ন্যায় তারাও বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যেহেতু শিশুদের বোঝার ক্ষমতা বড়দের তুলনায় কম, তাই স্ক্রিন আসক্তির প্রভাব তাদের ওপর বেশি পড়ে।
ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই আসক্তির প্রভাব আরও মারাত্মক। রাতে না ঘুমিয়ে মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার স্ক্রিনে সময় কাটানোর কারণে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগী হতে পারছে না, পড়াশোনায় পিছিয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে নানা স্বাস্থ্য সমস্যা। চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। নড়াচড়া কম হওয়ার কারণে ওজন বেড়ে যাচ্ছে। 
স্ক্রিনে বুঁদ হয়ে থাকার কারণে ধীরে ধীরে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে ওঠছে। পরিবারে অবস্থান করলেও তারা আসলে বিচ্ছিন্ন। মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কম হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে তারা অসামাজিক হয়ে ওঠছে। মানুষের চেহারার অভিব্যক্তি বুঝতে পারছে না। পরিণত বয়সে এই শিশুরা যখন বিয়ে করে, তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক সুন্দর হয় না। চেহারায় ফুটে ওঠা অভিব্যক্তি না বোঝার কারণে জীবনসঙ্গীর আবেগ-অনুভূতি, ভালো লাগা, মন্দ লাগা ইত্যাদি বিষয়গুলো তারা বুঝতে পারে না। যার চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে দাম্পত্য কলহ, সহিংসতা ও বিবাহ বিচ্ছেদ।
উন্নত দেশগুলোতে এই সমস্যা এতটাই ভয়াবহ যে, সেখানে স্ক্রিন আসক্তি কাটানোর জন্যে রিহ্যাব সেন্টার বা পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে। এসব সেন্টার স্ক্রিন আসক্ত মানুষদের (বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের) কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করে।
আমাদের দেশের মানুষ স্ক্রিন আসক্তির বিষয়টি নিয়ে এখনও সচেতন নয়। অধিকাংশই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানে না। বাস্তবতা হচ্ছে, স্ক্রিন আসক্ত বেশিরভাগ মানুষকে এই বিষয়গুলো বোঝাতে পারবেন না। তারা মনে করে তারা সুস্থ আছেন, বরং আপনি সেকেলে। এটাও আসক্ত মানুষদের আরেকটি ক্ষতিকর দিক।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প আমরা সবাই জানি। ভার্চুয়াল জগত আজ হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ভূমিকা পালন করছে। পুঁজিবাদী শয়তানী শক্তি আজ শিশু-কিশোরদের জীবন ধ্বংসের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তারা তাদের সন্তানদের মোবাইল ফোন, ট্যাব, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেট খুব একটা ব্যবহার করতে দেয় না। অথচ মুনাফার জন্য সারা পৃথিবীর শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছে ক্ষতিকর প্রযুক্তি পণ্য।
যার ফলাফল হচ্ছে সামাজবিচ্ছিন্ন, দায়িত্ব-অসচেতন, আত্ম-আসক্ত প্রজন্ম। আশু বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য, অভিভাবকদের সচেতন হতে সবার আগে। তাই শিশুর হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব না দিয়ে, বরং তাকে একটি ভালো বই উপহার দিন, তাকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসুন, তার সঙ্গে খেলাধুলা করুন, আত্মীস্বজনদের বাসায় নিয়ে যান।
লেখক: গবেষক ও “প্যারেন্টিং কলাম” বইয়ের লেখক












সর্বশেষ সংবাদ
দাউদকান্দিতে ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে সরকারী গাছ কাটার অভিযোগ
মনোহরগঞ্জে ইসলামী আন্দোলনের সম্মেলন ও ইফতার মাহফিল
সংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দ ও জুলাই বিপ্লবে আহতদের সম্মানে কুবি শাখা শিবিরের ইফতার
কুমিল্লা-৫ বুড়িচং-ব্রাহ্মণপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের নেতাদের সম্মানে এবি পার্টির মতবিনিয়র সভা ও ইফতার মাহফিল
তিতাসে ব্যবসায়ী ফোরামের আয়োজনেইফতার মাহফিল
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বিএনপি চেয়াপার্সনের উপদেষ্টা হলেন হাজী ইয়াছিন
১৬ বছর যাবৎ পৌর মার্কেটের ২৬ দোকানের ভাড়া আত্মসাৎ
মুয়াজ্জিনের পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে ওসির বিরুদ্ধে মামলা
‘বিমানবন্দরেই ডাকাতদের টার্গেট হন প্রবাসীরা’
যুব ও ক্রীড়া বিভাগ জামায়াতে ইসলামী কুমিল্লা ৬নং ওয়ার্ডের ইফতার মাহফিল
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২