কারখানা থেকে শতকোটি টাকা চুরির অভিযোগে চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলা ঘিরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। যে কারখানা থেকে চুরির অভিযোগ করা হয়েছে সেই সেটির কাছে তিনটি ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৩২৮ কোটি টাকা। চুরির মামলা দায়েরের পর সার্বিক পরিস্থিতিতে বর্তমানে ঋণ আদায় ঝুঁকিতে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ঋণ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মামলা দায়েরের পর কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও বেইস টেক্সটাইল লিমিটেড কর্তৃপক্ষ কী কী মালামাল চুরি হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তালিকা দিতে পারেনি। আবার মামলার এজাহারে কখন কী চুরি হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। আসামির নামও উল্লেখ করা হয়নি। শুধু উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচ মাসে কারখানা থেকে প্রায় শতকোটি টাকার মালামাল চুরি হয়েছে। এ কারণে মামলাটি নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারও।
তবে পুলিশের ধারণা, কারখানা থেকে মূল্যবান মালামাল ও যন্ত্রপাতি আগেই সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এরপর সেটি একপ্রকার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। নেওয়া হয়নি তেমন কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। এ কারণে লোকজন হাতের কাছে যা পেয়েছে তা নিয়ে গেছে। সবমিলিয়ে ব্যাংকের ঋণ ফাঁকি দিতেই শতকোটি টাকার চুরির মামলাটি দায়ের করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
পুলিশ জানায়, গত ৬ নভেম্বর কালুরঘাট সিডিএ শিল্প এলাকায় অবস্থিত বেইস টেক্সটাইল লিমিটেড থেকে চুরির অভিযোগে মামলাটি দায়ের হয়। কারখানার সাবেক কর্মকর্তা মীর মানজির আহসান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হওয়ায় ২০২২ সালের জুনে বেইস টেক্সটাইলের তৈরি পোশাকের ইউনিটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে শ্রমিক অসন্তোষ এবং আর্থিক অসংগতির কারণে ২০২৩ সালের জুনে টেক্সটাইল ইউনিটও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারখানা বন্ধ থাকায় চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা প্রহরীদের সঠিকভাবে তদারকি করা সম্ভব হয়নি। এতে ২০২৪ সালের মে মাস থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কারখানার বিদেশি যন্ত্রপাতি, গ্যাস জেনারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র চুরি হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১০০ কোটি টাকা। এজাহারে আসামি হিসেবে কারো নাম বা অজ্ঞাতনামা হিসেবে কোনো সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বেইস টেক্সটাইলের পক্ষে চান্দগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। কারখানার ব্যবস্থাপক ফয়েজ আহমদ এতে উল্লেখ করেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর অস্থিতিশীলতার সুযোগে ছোটখাটো চুরি বাড়তে থাকে। কারখানার সামনে বখাটেদের আনাগোনা বেড়েছে। তারা কারখানার নিরাপত্তাকর্মী জহিরুল ইসলামকে মারধর করে বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়। তবে তখন চুরির অভিযোগ করা হয়নি।
সরেজমিনে গত ৮ ফেব্রুয়ারি গিয়ে দেখা যায়, কারখানার দেয়ালগুলোই শুধু অবশিষ্ট রয়েছে। গেটের ভেতরে লোহার কিছু স্ট্র্যাকচার পড়ে আছে। ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাচ ও ইটের টুকরো। পাকা মেঝে ভেঙে তুলে নেওয়া হয়েছে ছোট-মাঝারি আকারের যন্ত্রপাতি। জেনারেটরসহ বড় যন্ত্রপাতিও গ্যাসকাটার দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছে। কারখানার পাশে প্রশাসনিক ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্র, টেলিভিশনসহ বৈদ্যুতিক পণ্য খুলে নেওয়া হয়েছে। এমনকি জানালার গ্রিল পর্যন্ত খুলে নেওয়া হয়েছে।
কঙ্কালসার কারখানার ভেতরে থাকা প্রহরী মো. হারুন জানান, প্রতিদিন কারখানা থেকে কিছু না কিছু খুলে নিয়ে যাচ্ছে চোরেরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, যেসব যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও অন্য পণ্য চুরির অভিযোগ করা হয়েছে সেসবের তালিকা সরবরাহ করতে পারেনি মালিকপক্ষ। কারখানায় কোনো সিসিটিভি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। তিনশ শতক জায়গাজুড়ে থাকা বন্ধ কারখানার সামনের গেটে মাত্র একজন নিরাপত্তাকর্মী থাকে। তদন্ত করে মনে হয়েছে মেশিনারিজসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতি গত বছরের ৫ আগস্টের আগেই কারখানা মালিক সরিয়ে নিয়েছে। কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ৫ আগস্টের পর স্থানীয় চোরেরা কারখানার অবশিষ্ট যন্ত্রপাতি নিয়ে গেছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেইস টেক্সটাইল তিন ব্যাংকের ৩২৮ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ওয়ান ব্যাংকের ২২২ কোটি, সিটি ব্যাংকের ৬৮ কোটি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩৮ কোটি টাকা রয়েছে।
পাওনাদার ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা জানান, যন্ত্রপাতি, গ্যাস জেনারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ কারখানার গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র চুরি হওয়ায় আমাদের ঋণ আদায় ঝুঁকিতে পড়েছে। এখন শুধু কারখানার দেয়ালগুলো অবশিষ্ট আছে। কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান শিবলী ও তার স্ত্রী (পরিচালক) ইসরাত জাহান আরব আমিরাত ও পরিচালক এস এম জামাল উদ্দিন নিউজিল্যান্ডে অবস্থান করছেন। চেয়ারম্যান সিদরাতুল মুনতাহা কোথায় আছেন তার তথ্য নেই ব্যাংকের কাছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক এ এম সালেহ উদ্দিন কুতুবী বলেন, বেইস টেক্সটাইলের কাছে আমাদের পাওনা ৩৮ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করতে আমরা প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছি। ২০১৫ সালে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণসুবিধা গ্রহণ করে বেইস টেক্সটাইল।
ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক জাহেদ ইকবাল বলেন, ২০০৪ সালে এ শাখাতে লেনদেন ও ঋণসুবিধা নিয়ে ব্যবসা করে বেইস টেক্সটাইল। প্রথম প্রজন্ম ভালো ব্যবসা করলেও ২০২২-২৩ সালে এসে কারখানাটির রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ঋণ খেলাপি হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে চারটি চেক প্রত্যাখ্যান (এনআই অ্যাক্ট) মামলা হয়েছে। মামলায় বিবাদীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।
এ বিষয়ে জানতে বেইস টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান শিবলির মোবাইলে ও হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
চান্দগাঁও থানায় দায়ের করা চুরির মামলার বাদী ও বেইস টেক্সটাইলের সাবেক ম্যানেজার সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং মীর মানজির আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২৪ সালের মে থেকে কারখানায় ছোটখাটো চুরির ঘটনা ঘটে। সেপ্টেম্বরে এসে একেবারে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তখন কারখানায় আগুন দেওয়া হয়েছিল। এতে বেশ কিছু নথি পুড়ে যায়। এত বড় ঘটনা, তাই কী কী যন্ত্রপাতি চুরি হয়েছে নির্দিষ্ট করে সেটার তালিকা দিতে পারিনি। কারখানায় চুরি-ডাকাতি এখনো থামেনি। সবশেষ কয়েকদিন আগেও একেবারে ট্রাক নিয়ে ডাকাতির চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু থানা পুলিশ ও শিল্প পুলিশের তৎপরতায় তা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আমরা আসলে ডাকাতি মামলা করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওইসময় পুলিশ ডাকাতি মামলা রেকর্ড করেনি। তাই আমরা চুরি মামলা করেছি। পুলিশ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। কিন্তু তারা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না জানা যায়নি। সবমিলিয়ে আমরা মনে করছি একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছাড়া ধারাবাহিকভাবে এসব ঘটনা ঘটানো সম্ভব না। সেটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হতে পারে অথবা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী হতে পারে।
চান্দগাঁও থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব উদ্দিন বলেন, কারখানাটি থানা এরিয়া থেকে একটু দূরে। কারখানা মালিকের নিজস্ব কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। নিজস্ব নিরাপত্তা ছাড়া শুধু থানা পুলিশ দিয়ে একটি কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত সম্ভব নয়। এরপরও মামলা দায়েরের পর থেকে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে চুরির সম্পৃক্ততায় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। কিছু মালামালও উদ্ধার করা হয়েছে।
১৯৯৬ সালে চালু হওয়া এ কারখানার দুই দশক আগে শীর্ষ পর্যায়ের রপ্তানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুখ্যাতি ছিল। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে ২০০৪-০৫ অর্থবছরে এ কারখানা থেকে রপ্তানি হয়েছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সর্বশেষ তুরস্কে একটি চালান পাঠিয়েছে কারখানাটি। কারখানাটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাহাদাত হোসেন। প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এস এম নুরুল হুদা চৌধুরী জাহাঙ্গীর। দুই উদ্যোক্তার বাড়ি চট্টগ্রামে।
প্রায় এক দশক আগে দুই উদ্যোক্তা মারা গেলে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে আসে কারখানাটি। এরপর মালিকানা নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। করোনা মহামারির পর কারখানাটির রপ্তানি কমতে থাকে। তখন শ্রমিক অসন্তোষও শুরু হয়।