প্রিয় জাকির ভাই,
অনেকদিন হলো আপনার সংযোগটি বিচ্ছিন্ন। তাই এখানকার অনেক খবর জানাতে পারিনি। তাই খোলা চিঠি লিখলাম। দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আমরা যারা সেদিন এক পতাকার তলে শামিল হয়েছিলাম আজ তাদের অনেকেই হারিয়ে গেছে মৃত্যুর করালগ্রাসে। এইতো কিছুদিন হলো আপনার বিশ্বস্ত সৈনিক নজির ভাই, নুরু ভাই, অধ্যাপিকা নাজমা, জহরলাল বণিক, আদমজীর শ্রমিক নেতা ছামাদ ভাই পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। বশির, আঃ হাইয়ের চলাফেরার সক্ষমতাও সীমিত হয়ে গেছে। সুদূর আমেরিকা থেকে মহিউদ্দিন ভাই আপনার খোঁজে এসে আপনাকে না পেয়ে মন খারাপ করে ফিরে গেছেন উনার প্রবাস জীবনে। আবদুল হালিম মুন্সী আমেরিকা থেকে দেশে এসে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের মিলনমেলার আয়োজন করেছিলেন উনার গ্রামের বাড়িতে। ডাঃ আবু আইয়ুব হামিদ, এডভোকেট গোলাম ফারুক, মোশতাকুর রহমান (ফুল মিঞা) সহ বেশ কিছু সংখ্যক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মিলনমেলায় অংশ নিয়েছিলেন। সেখানেও আপনার অনুপস্থিতি সকলের মনোবেদনার কারণ হয়েছিল। এই বাহিনীর জীবিত সদস্যদের অনেকেরই জীবনীশক্তি প্রায় নিঃশেষ। কেবল অসম সাহসী স্বপ্নবাজ নাসিরুল ইসলাম চৌধুরী জুয়েল তাঁর প্রচণ্ড জেদ ও জীবনী শক্তির জোরে আপনার ঝাণ্ডাটি বহন করে চলছেন। বীরমুক্তিযোদ্ধা জুয়েল চৌধুরীর সংস্পর্শে এসে এসব গেরিলারা নতুনভাবে জীবন ফিরে পায়। আমি ভেবে অবাক হই কতটা প্রাণশক্তি থাকলে একজন মানুষ জটিল পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত হয়েও এতটা সতেজ ও প্রাণবন্ত থাকতে পারে ? প্রতিকুল পরিবেশে থেকেও পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অসম লড়াই অব্যাহত রাখতে পারে ? চলে যাবার প্রাক্কালে তাঁকে এ লড়াইয়ের সিপাহসালারের দায়িত্ব অর্পণ করে নিঃসন্দেহে আপনি অসামান্য দূরদৃষ্টির পরিচয় রেখে গেছেন।
জাকির ভাই,
কারো সঙ্গে দেখা হলে এখনো আমরা সেদিনের মতোই দেশ নিয়ে কথা বলি। দেশের অবস্থা কী, দেশের মানুষ কেমন আছে,দেশ কোন দিকে যাচ্ছে এ নিয়ে প্রকাশ পায় আমাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। কেননা আমরা সুস্থ-সুন্দর সমাজ চাই। উন্নত জীবন চাই। তবে চাইলে কি হবে,আমাদের দেশ এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সার্বিক দিক বিবেচনায় এর মতো খারাপ অবস্থার দেশ দুনিয়ায় এখন কমই আছে। এক হিসেবে এটি এখন সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোর চেয়েও খারাপ অবস্থার দেশ।
জাকির ভাই,
আপনার অজানা নয় একথা যে,স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকেই এখানকার মানুষ মনে-মননে, শৌর্য-বীর্যে, শিক্ষা-দীক্ষায়,দয়া-দাক্ষিণ্যে,আচার-আচরণে,নম্রতা-ভদ্রতায়,জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় ক্রমশ ছোট হতে শুরু করেছিল। এখন তারা এতই ছোট হয়ে পড়েছে যে মুক্ত স্বাধীন জীবনের কথা ভাবতেও তারা ভয় পায়। অবস্থার ক্রমাবনতিতে দেশটি এখন বিশ্বসভায় নগণ্য হতে হতে খেয়োখেয়ির দেশে পরিণত হয়েছে। সঙ্গত কারণে এখানে এখন সৎ লোকের আকাল দেখা দিয়েছে। খারাপ লোকের ভালো হবার সুযোগ কমে গেছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুশ্চরিত্র ও দুর্বৃত্তদের প্রাধান্যের কারণে অপেক্ষাকৃত ভালো লোকগুলো দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এ দেশে এখন ঐ ব্যক্তিই সৎ, যিনি জীবনে অসৎ হওয়ার কোন সুযোগ পাননি। কিংবা যিনি একাকীত্বে অসহায় জীবন বেছে নিয়েছেন। এমন কঠিন- কঠোর নির্জন গুহা জীবন বেছে নেবার শক্তি সাহস সম্পন্ন মানুষেরা হারিয়ে গেছে আমাদের জাতীয় রাজনীতি থেকে। এখানকার শতভাগ মানুষের জীবন এখন বলতে গেলে ঐসব মাছির মতো মধু আর মলে যাদের সমান বিচরণ। অথচ এমনটি একসময় ছিলো না। তখন দু’একজন লোক মিথ্যা বলতো। এখন মিথ্যা কথা বলে না এমন লোক বিরল। সাধারণ -অসাধারণ নির্বিশেষে সর্বত্রই মিথ্যার বেসাতি। কথায় কথায় মিথ্যা বলা মোনাফেকির অন্যতম লক্ষণ। রাষ্ট্র, দেশ, সমাজ এতো মোনাফেক মানুষ নিয়ে কিভাবে এগিয়ে যেতে পারে?
জাকির ভাই,
আপনি রাজনীতিকে মনে করতেন জনগণের জন্য কাজ করার একটি অন্যতম মাধ্যম। আমিও তেমনটি মনে করি। তবে আজকাল রাজনীতিতে আদর্শের পরিবর্তে পপুলিজম বা জনতুষ্টিবাদের নীতির প্রাধান্য দেখতে দেখতে রাজনীতির প্রতি দিন দিন উৎসাহ হারিয়ে ফেলছি। এ অবস্থা কেবল আমার একার নয়, মার্ক্সবাদী দলগুলোর মধ্যেও শ্রেণী দ্বন্দ্বের পরিবর্তে শ্রেণী সহনশীলতা, হঠকারিতা এবং বিদ্যমান প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ফেবিয়ান প্রবণতা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় আপনি আদর্শভিত্তিক রাজনীতির স্থলে নিঃসন্দেহে ইস্যুভিত্তিক রাজনীতির পথে হাঁটতেন। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় রাজনীতিতে মধ্যবাম দলগুলোকে এগিয়ে নিতে এ পথের বিকল্প নেই বলে আপনার ন্যায় আমিও মনে করি।
জাকির ভাই,
আপনি বলতেন সমস্ত প্রগতির জন্যেই মানুষকে চরম মূল্য দিতে হয়; এর জন্য বীরদের শুধু যুদ্ধে জীবনাহুতি দিতে হয় না, অনেককে বলিও হতে হয়। ইতর লোকেরা এদের পিছনে লেগে থেকে নানা দোষত্রুটির ফিরিস্তি তৈরি করে এদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চায়। কিন্তু যারা দেশ ও জনগণের মুক্তির জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছে কোন কলুষ কালিমা এদের স্পর্শ করতে পারে না।
আপনি ছিলেন তাদেরই একজন। আপনার কথার সমর্থনে আমাদের প্রিয় লেখক Fyodor Dostoevsky-র কথা উদ্ধৃত করে এ খোলা চিঠির যবনিকা টানছি।
Pain and suffering are always inevitable for a large intelligence and deep heart.The really great men must,I think ,have great sadness on earth.