দেশের শিল্প খাত আজ গভীর সংকটে
নিমজ্জিত। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। টাকার
অবমূল্যায়নের কারণে কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি খরচ বাড়ছে। ফলে
বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি শিল্পোৎপাদনে
প্রভাব ফেলছে। গ্যাসের অভাব ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। এতে উৎপাদন ব্যাপকভাবে
ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদ হার
বৃদ্ধি করায় ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়তে বাড়তে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
এক বছরের
ব্যবধানে শিল্পঋণের ব্যয় প্রায় ১৭ শতাংশ বেড়েছে। রয়েছে ডলার সংকট। ফলে
ঋণপত্র খোলা এবং নিষ্পত্তির হার অনেক কমেছে। শিল্পোৎপাদনে তার প্রভাব পড়ছে।
এসব
কারণে শিল্প-কারখানা ক্রমাগতভাবে লোকসানের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এরই মধ্যে
কয়েক শ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ধুঁকছে অনেক কারখানা। অনেক কারখানা নিয়মিত
বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে বাড়ছে শ্রম অসন্তোষ।
সেটিও শিল্প-কারখানার উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। তাই দেশের শিল্প-বিনিয়োগ চরম ঝুঁকিতে পড়েছে।
গবেষণা
ও পরিসংখ্যান বলছে, দেশে নতুন বিনিয়োগ থমকে গেছে। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা
বলছেন, দেশে এখন বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। ফলে এখন তাঁরা কোনো রকমে টিকে থাকার
জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। ব্যাংকঋণের সুদ ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় ঋণের ওপর
নির্ভরশীল ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ নিটওয়্যার
ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ)
সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘নতুন সুদহার মূল্যস্ফীতি কমাবে বলে আমি মনে
করি না, বরং এতে শিল্পের ভোগান্তি বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীরা ঋণখেলাপি হতে
পারেন।’ বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট অনুযায়ী
মূল্যস্ফীতির চাপ, অস্থিতিশীল অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক
অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি ভোগ, বিনিয়োগ ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাবে বলে
আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং টেকসই
প্রবৃদ্ধির জন্য রুগ্ন করপোরেট খাতকে জাগিয়ে তুলতে উদ্যোক্তাদের পরামর্শ
হচ্ছে, করপোরেট খাতকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার
ত্বরান্বিত করতে সরকারকে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। এর মধ্যে থাকবে কম সুদে
ঋণপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা, প্রকল্প ও সেক্টর বা কম্পানিগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি, কম
সুদ ও পুনর্গঠন সুবিধাসহ ডাউনপেমেন্ট ছাড়া বা কম ডাউনপেমেন্টে অর্থায়ন,
করপোরেট ও ব্যাংকিং খাতের জন্য সহায়ক হয় এমন আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং
অনুশীলনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নন-রিকোর্স, কম জামানতপূর্ণ, পর্যাপ্ত
আর্থিক সুবিধা, কম সীমাবদ্ধ আমদানি সুবিধা, সেকেন্ডারি ঋণ বাজার ইত্যাদি
প্রবর্তন করা, কাঁচামাল ও জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় উপকরণে ভর্তুকি প্রদান,
জরুরি খাতগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে অনুদান প্রদান, কর ছাড় ও
রেয়াত, পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারি (পিপিপি) বাড়ানো ইত্যাদি।
দেশে
বর্তমানে বিপুল বেকারত্ব রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত বাড়ছে জনসংখ্যা। বাড়ছে
কর্মসংস্থানের চাহিদা। কিন্তু সেই চাহিদা অনুযায়ী বাড়ছে না শিল্প-কারখানা,
বাড়ছে না কর্মসংস্থানের সুযোগ। বরং এখন উল্টো চিত্রই দৃশ্যমান হচ্ছে। নতুন
বিনিয়োগে গতি নেই। পুরনো উদ্যোগগুলোও ধুঁকছে। এই অবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক
স্থিতিশীলতার স্বার্থে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। দেশের
করপোরেট খাতগুলোকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে হবে।