বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫
২৯ ফাল্গুন ১৪৩১
মৃত্যুচিন্তা ও মৃত্যুবোধ
জুলফিকার নিউটন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০২৫, ১:৪২ এএম আপডেট: ১৩.০৩.২০২৫ ২:১৩ এএম |

 মৃত্যুচিন্তা ও মৃত্যুবোধ
“এতোটা কি দুঃখ ছিলো বাবা? নৈরাশ্য-যন্ত্রণা? ভেতরে কি অগ্নিজ্বালা জ্বলতে জ্বলতে অঙ্গার হয়ে গেলি। 
সেই শৈশব কি একটা দারুণ স্বপ্নের মতো প্রাণময় উচ্ছ্বাস কাঁধে বুকে পিঠে জড়িয়ে কোমল হাত, কোমল শরীর ফুল ও পাপড়ির স্পর্শ-প্রসন্নতা আধো আধো বোল, ভাঙ্গা শব্দ রাশি কত যে খেলার সাথী খুনসুটি কত প্রশ্ন কত আব্দার চিনে নিতে এ পৃথিবী, এ মানবীয় কোলাহল। 
বড় হলি কতটা বন্ধু ছিলি, কতটা আপনার, কতটা সম্পদ, কতটা সন্তান কতটা পরম আরাধ্য কতটা হৃদয়িক আয়োজন। 
ক্লিষ্ট জীবনের ছায়া, ক্লেদ গ্লানি আর বিড়ম্বনা থেকে দূরে ছুঁতে দেইনি, দুহাতে রেখেছি তুলে- ওপরে বেদনা ও কষ্টের বাইরে কতটা জীবনের যুদ্ধ আগলিয়েছি নিজ বুকে সুন্দরের সোনালি আয়োজন ছড়িয়েছি তোর চোখে। 
আমাদের এতটা গভীর মমতার ঔদার্য হৃদয়মঞ্জুরী ভালোবাসার এ বাঁধন অনুভবের হৃদয়িক সম্ভার একবারও কি মনে করিয়ে দেয়নি? মনে কি হয়নি একটিবার বাবা-মা-ভাই-ভাবী শ্বাশত কল্যাণী মুখ? চিরন্তন ভালোবাসার পরম নির্ভরতার আশ্রয়। 
কেন চলে গেলি বাবা আমাদের সমস্ত উদ্দীপনা অনুরণন তছনছ করে লুটিয়ে ধূলায় জীবনের আস্বাদন দিয়ে গেলি নিঃশ্বাসের সাথে আগুন, বুকের ভেতর অগ্নিকুন্ড চোখের ভেতর বুক ছেঁড়া কি নিদারুণ কষ্টের ঝর্ণাধারা। 
তোর প্রাণের ‘ঋদ্ধমান’ চোখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে খোঁজে ‘ছাছু’ বলে কি জবাব দেবো এখন? আমাদের কাছে কোনো জবাব নাই নিজেরাই উত্তর তো খুঁজে পাইনা তোর যন্ত্রণা আমরা বুঝিনি কেউ বুঝেনি বাবা, কাউকে বুঝতে দিলিনা কেন? 
বাবা তোর জন্যে তো ছিলো প্রজাপতি ও কুসুমের উদ্যান সম্ভাবনার সাজানো সড়ক গৌরবময় উত্থান তোর অপেক্ষায় ছিলো আনন্দময় জগৎ-সংসার-মানুষ হিরন্ময় স্বপ্নসৌধ প্রণোদিত জীবন-গান তুইতো তেমনি একজন মানবিক বোধে উত্তরিত, মানুষের জন্য তবুও কেন নিস্তব্ধতায় দিশাহীন, পরম ক্লান্তির কাছে নির্বোধ সমর্পণে নুয়ে পড়লি? 
এত তাড়াতাড়ি যাওয়াটা কি খুব জরুরি ছিলো? না মোটেও না খুব হেলা ফেলায় চলে গেলি। কেন চলে গেলি বাবা, সকল কাজ ফেলে।”
উপরোক্ত কবিতাটি ছোট সন্তান নীলাভ্র তারিফ চৌধুরীর অকাল মৃত্যুতে পিতা আলী হোসেন চৌধুরী শোকগাথা। 
মৃত্যুর সঙ্গে যে জীবনের কোনো বিরোধ নেই, এই তত্ত্বটা প্রাচীনের সহজে মেনে নিয়েছিলেন। অন্তত একটা বয়সের পর সন্ন্যাস ও মহাপ্রস্থানের চিন্তা তাঁদের জীবনদর্শনের অঙ্গ ছিল। আধুনিক মন ছন্দের সঙ্গে মৃত্যুকে কিছুতেই মেলাতে পারে না। এ নিয়ে পুনর্বিচার প্রয়োজন। 
ব্যক্তিবিশেষের অস্তিত্ব তার মৃত্যুতে সমাপ্ত। বিশ্বমানবের যাত্রাপথ কিন্তু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিস্তৃত, বিচিত্র রূপান্তরের ভিতর দিয়ে। মানুষ তার ইতিহাস সৃষ্টি করে কর্মের ভিতর দিয়ে। এক প্রজন্মের কর্মফলের সমষ্টি নিয়ে আর এক প্রজন্মের যাত্রা শুরু হয়, তাতে যোগ হয় নতুন প্রজন্মের উদ্যোগ। এরই আশ্রয়ে ব্যক্তির কর্মেরও সার্থকতা। এমনি করেই ব্যক্তিবিশেষের স্মৃতি, সৃজনশীল মানুষের কীর্তি, ব্যক্তির মৃত্যুকে অতিক্রম করে কাল থেকে কালান্তরে প্রবাহিত হয়ে চলে। ব্যক্তির পক্ষে এর বেশি অমরত্ব দাবি করা বৃথা। এর কমে সন্তুষ্ট থাকাও মনে হয় অসার্থক। কোনো তরঙ্গই চিরস্থায়ী হয় না। আবার কোনো তরঙ্গই একেবারে হারায় না, নিজেকে ব্যাপ্ত করে কার্যকারণে শৃঙ্খলায়। মানুষের এই প্রাবহিত জীবনধারার সঙ্গে জন্মমৃত্যুকে যুক্ত করে দেখা চাই, নইলে দৃষ্টি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মনে হয় কর্মবাদ ও জন্মান্তর সম্বন্ধে প্রাচীন বিশ্বাস ও পুরানো ভাষাকে এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সেটা হয়ে ওঠে যুক্তিবাদী চিন্তার পক্ষে সহায়ক।
অভ্যস্ত সংস্কৃতিতে, শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজে, হত্যা এবং আত্মহত্যা বিষয়ে প্রবল বিরূপতা আছে। এটাই স্বাভাবিক। যে-আদিম বর্বর অন্ধকারময় যুগ থেকে মানুষের যাত্রা শুরু, তারই প্রভাবে মানুষের ভিতর একটা প্রকৃতিদত্ত হিংস্রতা থেকে গেছে অতিমাত্রাতেই। আজকের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সেই হিংসার শক্তিকে নৈতিক নিয়ম দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করার প্রচেষ্টা চলেছে সমস্ত সভ্য সমাজেই বহুদিন থেকে। হত্যাকে আমরা পাপ বলে জানি। আত্মহত্যাও হত্যারই একটা রূপ। অপরের প্রাণনাশকে বলি হত্যা, নিজের প্রাণনাশ আত্মহত্যা। সমাজের গৃহীত নীতিবোধে এই সবই পাপ। এটাই প্রচলিত ধারণা।
প্রচলিত এই ধারণা যদিও মূল্যবান তবুও অসম্পূর্ণ। একটু ভাবলেই এর অসম্পূর্ণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সচেতনভাবে অপরের প্রাণনাশের নামই যদি হয় হত্যা তবে এই ঘটনা পাওয়া যাবে অন্তত তিনটি ভিন্ন স্তরে। চেতনার স্তরভেদে রূপের ভেদ ঘটে। যুক্তি ও নৈতিকতার দিক থেকে এরা এতই ভিন্ন যে, যদিও আক্ষরিকভাবে প্রত্যেকটিই প্রাণহনন, তবু এদের একই নামে চিহ্নিত করতে আমাদের মনের ভিতর থেকেই বাধা থাকে। সেই বাধা অতিক্রম করে বিষয়টিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখা যাক।
একটা জটিল এবং স্পর্শকাতর বিষয়কে যথাসম্ভব সহজভাবে বলার জন্য আমরা সহজ উদাহরণের সাহায্য নিচ্ছি। ধরুন, একটা লোক নিতান্তই লোভের বশে স্বার্থান্ধ হয়ে কাউকে খুন করল, দ্বিতীয় ব্যক্তির সম্পত্তি দখল করার জন্য। বিচারে হত্যাকারীর প্রাণদণ্ড হলো। এখানে আমরা দুটি প্রাণনাশের ঘটনা পাচ্ছি। একটির পিছনে আছে লোভ, অন্যটির পিছনে আইন অনুযায়ী বিচার। যুক্তির দিক থেকে এই দুটি হত্যা কি একই স্তরের ঘটনা? আরও নানা কারণেই প্রাণনাশ ঘটে থাকে। অন্ধ উত্তেজনায় মানুষ মানুষকে খুন করে। আবার নিতান্ত করুণা থেকেও আমরা কঠিন যন্ত্রণায় আক্লান্ত কোনো জীবের জীবনান্ত ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারি। অর্থাৎ, সচেতনভাবে প্রাণনাশ সম্ভব অন্তত তিনটি স্তরে। একটিকে বলব অন্ধ জৈব প্রবৃত্তির স্তর, দ্বিতীয়টি যুক্তিআশ্রয়ী যথাসম্ভব নিরপেক্ষ বিচার, তৃতীয়তে আছে করুণা। চেতনার এই তিনটি প্রধান স্তর। প্রতিটিতে পাওয়া যাবে যেমন সৃষ্টি তেমনি সংহার। অধিক উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন। প্রয়োজন কিছু সতর্কতা। প্রতিহিংসা অনেক সময় ন্যায়বিচারের মুখোশ পরে আসে, সেইখানে বিপদ। 
হত্যা সম্বন্ধে যে-কথা খাটে আত্মহত্যা সম্বন্ধেও মোটামুটি সেই ধারাতেই আলোচনা সম্ভব। প্রভেদ এই যে, অপরের ক্ষেত্রে নিরাসক্ত বিচার অপেক্ষাকৃত সহজ, নিজের ক্ষেত্রে কঠিন। আরও কিছু পার্থক্য আছে। জৈব প্রবৃত্তির স্তরে পাওয়া যাবে, ক্রোধে হত্যা, অভিমানে আত্মহত্যা। দুয়ের ভিতরই আছে অন্ধ আবেগ, যেটা আঘাত হানছে কখনো অপরের বিরুদ্ধে, কখনো নিজেরই বিরুদ্ধে। হিংসা থেকে ঘটে হত্যা, নৈরাশ্য থেকে আত্মহত্যা। আবেগ অন্ধ হলেও দেখি তার রঙে একটা পার্থক্য এসে গেছে, কোথাও সেটা তীব্র লাল, কোথাও ঘন অন্ধকার।
অন্ধ জৈবতাকে অতিক্রম করে যুক্তি ও করুণার স্তরে যেমন হত্যা সম্ভব, তেমনি সম্ভব আত্মহত্যাও। এ কথাটা আমরা অনেকে হঠাৎ মানতে চাইব না। আবারও বলতে হচ্ছে, আত্মহত্যার বিষয়ে অনাসক্ত আলোচনা অপেক্ষাকৃত কঠিন, যে বলে তার পক্ষেও, আর যারা শোনে তাদের পক্ষেও। এর একটা সহজ কারণ আছে। জীবের চেতনার গভীরে প্রকৃতি রোপণ করেছে আত্মরক্ষার এক দুরতিক্রম্য প্রবল প্রবৃত্তি। অতি দুঃস্থ দরিদ্র ভিক্ষুকও এই প্রবৃত্তির বশে প্রাণপণে চেষ্টা করে জীবনটাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে। এই জৈবধর্ম কখনো পরাভূত হয় সাময়িক কোনো তীব্র আবেগের আঘাতে। শুধু ধিরস্থির শান্ত বিচারের দ্বারা একে অতিক্রম করা সহজ নয়।
তাই আলোচনা শুরু করা আবশ্যক এমন কিছু উদাহরণ দিয়ে যেখানে যুক্তি ও আবেগের ভিতর বিরোধ অনুপস্থিত, যেখানে দুটিই একমুখী। তারপর ক্রমে তোলা যাবে এমন সব প্রশ্ন, অগ্রসর হওয়া যাবে এমন প্রসঙ্গে, যেখানে তর্ক জোরালো, আপত্তি অনিবার্য। তবু বিতর্ক অর্থহীন নয়। অন্তত যুক্তিতে যারা বিশ্বাসী তাদের কাছে অর্থহীন হওয়ার কথা নয়। ভিয়েতনামের যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষু জনসমক্ষে প্রজ¦লিত অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বজাতির কাছে বীর শহিদ বলে যাঁরা পূজিত তাঁরা সজ্ঞানে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এই রকমের আত্মহত্যাকে পাপ মনে করা হয় না, বরং এটা পুণ্য বলেই গণ্য হয়। যাঁরা শহিদ তাঁরা যে একটা গভীর ও প্রবল আবেগের দ্বারা চালিত হয়েছেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। যুক্তির সঙ্গে এই আবেগের বিরোধ আছে এমন কথা অনেকেই মানবেন না। আবেগ ও যুক্তি একই আদর্শ বেছে নিতে পারে। এমন ঘটেছে কত মহামানবের জীবনে। যিশু ও গান্ধীজির দৃষ্টান্ত মনে পড়ে, যুক্তি ও আধ্যাত্মিকতার ভেদ যেখানে মুছে গেছে।
যুক্তির দিক থেকে কথাটা এইভাবে সাজানো যায়। ব্যক্তির মৃত্যু শেষ কথা নয়, তার চেয়ে বড় হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রসারিত ভবিষ্যৎ। স্বদেশের এবং অবশেষে মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য আজকের কোনো আত্মহত্যা যদি প্রয়োজন মনে হয় তবে নির্ভীকভাবে সেই পথে এগিয়ে যাওয়াটাই উচ্চতর নৈতিকতা, মহত্তর আদর্শ। এই ভাবনায় যুক্তি ও আবেগের মিলিত হতে বাধা নেই। অবশ্য বিচারে ভুল হতে পারে শহিদেরও, সেটা অন্য কথা।
যাঁরা শহিদ বলে মান্য ও সম্মানিত তারা সংখ্যায় অল্প। কিন্তু উদাহরণ বাড়ানো কঠিন নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ নামে পরিচিতি আত্মহত্যায় প্রস্তুত বাহিনীর তৎপরতা বিরল ঘটনা নয়। এখানেও বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ভাবটাই প্রধান। এইসব উদাহরণের ভিতর দিয়ে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমাজের বিচারে আত্মহত্যা মাত্রই অপরাধ নয়, পাপ নয়। অবস্থাবিশেষে সেটা সমর্থনযোগ্য, এমনকি শ্রদ্ধেয়, অবস্থান্তরে অশ্রদ্ধেয়।
আলোচনাটাকে এবার যুদ্ধক্ষেত্রের বিশেষ পরিস্থিতি থেকে মানুষের জীবনের প্রাত্যহিকতায় ফিরিয়ে আনা যাক। শহিদ নিয়ে আলোচনায় একটা মুশকিল আছে : এক পক্ষের বিচারে যে দেবী, অন্য পক্ষের বিচারে সে অসুর। সংসারের সাধারণ অবস্থায় ভালো-মন্দের প্রশ্ন ঠিক সেইভাবে আসে না। যেখানে ব্যাপারটা প্রথম দৃষ্টিতে সরল সেখানেও শেষ অবধি কিছু জটিলতা চোখে পড়ে। সাধারণ কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক।
দারিদ্র্রের তাড়নায় আত্মহত্যার কথা আমরা জানি। আবার ধনী দেশেও কিন্তু আত্মহত্যার হার তুচ্ছ নয়। জীবনটাকে যথাসম্ভব টেনে নিয়ে চলাটাই অতি দীন ভিখারির জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নিতান্ত দারিদ্র্য বোধ করি আত্মহত্যার প্রধান কারণ নয়। যারা অর্থের মুখ দেখেও অর্থ থেকে বঞ্চিত, সার্থকতার ধারণার কাছাকাছি এসেও অসার্থক, ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি কানে শুনেও ভালোবাসার বঞ্চনায় পীড়িত, তাদের দুর্জয় অভিমানই হয়ে ওঠে আত্মহত্যার প্রধান কারণ। ব্যক্তিগত অভিমানববশত যে আত্মহত্যা, তাকে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করা প্রায়ই কঠিন, এখানে যুক্তি আর আবেগ চলে বিপরীত মুখে। ধৈর্য ধরলে, সময়ের নিঃশব্দ প্রভাবে আবেগ দুর্বল হয়ে আসে। সংসারী মানুষের পরামর্শ তাই সাবধানতা। সংসার থেকে উত্থিত অভিমানের বিরুদ্ধে অন্যতম পরামর্শদাতা স্বয়ং বিশুদ্ধ সাংসারিকতা। এই পরামর্শের সপক্ষে আছে প্রচলিত সংস্কার।
অভিমানই কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যুর একমাত্র প্রেরক ও পটভূমি নয়। অন্য পটভূমি খুঁজে পাওয়া যাবে সংসারের সাধারণ অবস্থাতেও। যেমন ধরা যাক কঠিন রোগাক্রান্ত জীবন। রোগ যেখানে অতি যন্ত্রণাদায়ক, মৃত্যু যেখানে অনিবার্য, সেখানে যন্ত্রণাটাকে দীর্ঘ করার সপক্ষে যুক্তি দুর্বল। তবুও অনেক সমাজে স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার স্বীকৃতি পায়নি সেই অবস্থাতেও। ডাক্তার বলেন, মৃত্যু ঘটাতে সাহায্য করা আমাদের কাজ নয়, জীবনরক্ষা করাটাই কর্তব্য হিসেবে আমরা মানি। কিন্তু একটা জীবনমৃত অবস্থাকে অনেক মূল্যে অনির্দিষ্টকাল রক্ষা করে যাওয়াতে কি কোনো গৌরব আছে? আত্মীয়- বন্ধুসহ কাছের মানুষেরা বলেন, কারও মৃত্যু যে আশু ও অনিবার্য এমন কথা আগে থেকে ধরে নেব কেন? অত্যাশ্চর্যভাবে কেউ কেউ তো বেঁচে যান। বৈজ্ঞানিক আমরা সম্ভাবনার হিসাবটাই করতে পারি, অনিবার্যতার কথা বলতে পারি কি? এসব ঠিক। তবু সম্ভাবনার হিসাবেই অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোনো একটা সম্ভাবনা বিশেষ কোনো অবস্থায় এতই প্রবল যে বিপরীত সিদ্ধান্ত সেখানে অযৌক্তিক, অতএব, সমর্থনের অযোগ্য। কিছু জটিলতা অবশ্য এরপরও থেকে যায়। স্বার্থান্বেষী প্রতিপক্ষ নিশ্চয়ই সম্ভাবনার হিসাবটাই আমাদের ভুলভাবে বোঝার চেষ্টা করতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্কতা প্রয়োজন। আবার নিজেরই মনের ভিতরে অন্ধ আসক্তি অন্ধ ভয় দিয়ে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কাটাও তুচ্ছ নয়। সতর্কতা প্রয়োজন তার বিরুদ্ধেও। আর্তিনাশই লক্ষ্য। অন্ধ আসক্তির পথে সেটা লভ্য নয়। এই অন্ধতার প্রতিধ্বনি আছে প্রচলিত সংস্কারে ও কুসংস্কারে।
নতুন প্রজন্মের হাতে সমাজ সংসার চালানোর দায়িত্ব অর্পণ করে বৃদ্ধেরা বিদায় নেবেন এটাই সুস্থ স্বাভাবিক নিয়ম। সবসময় এটা মসৃণভাবে ঘটে না। বৃদ্ধ কর্তারা কর্তৃত্বের স্থান ত্যাগ করতে চান না। আরম্ভ হয় অনাবশ্যক এবং পীড়াদায়ক তিক্ততা, স্নায়ুর লড়াই। এই সম্ভাবনার কথা ভেবেই বোধকরি বৃদ্ধদের জন্য সন্ন্যাস গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যে। গৃহত্যাগের কথা ভাবতে হবে এমন নয়, যদিও প্রয়োজন সেটাও বিবেচ্য। তবে শুভেচ্ছা ও সদ্ভাব নিয়ে পুরানো প্রজন্ম নতুনের হাতে সংসারের দায়িত্ব ও সক্ষমতা ন্যস্ত করবেন এই মূলভাবটা মনে রাখার যোগ্য।
এরপরও সংসারে বৃদ্ধদের একটা স্থান থেকে যাওয়া সম্ভব, যেটা না চাইতেই পাওয়া উচিত। পাওয়া যায় যদি নতুন প্রজন্ম মানতে রাজি থাকে আর পুরানো প্রজন্ম দাবি জানাতে ব্যস্ত না হয়, যদি পরিবেশ হয় অনুকূল। তা নইলে দুর্ভাগ্য, সেটা দুপক্ষেরই। বৃহৎ পরিবারে পিতামহ কিংবা পিতামহী, মাতামহ অথবা মাতামহী, হতে পারেন শান্তির ধারক। একটা পারিবারিক ঐক্যভাবকে তাঁরা পারেন নিঃশব্দ প্রভাবে সঞ্জীবিত রাখতে। নাতি-নাতনির থাকে দাদা-দাদির সঙ্গে একটা বিশেষ সম্পর্ক। বাপ-মায়ের ভূমিকা এক, দাদা-দাদির অন্য। এইসব কিছুর মূল্য স্বীকার্য, যদিও অপরিহার্য নয় কিছুই। বৃদ্ধদেরও সমাজসংসারকে কিছু দেওয়ার থাকে যদি তাঁরা তেমন সৌভাগ্যবান হন। সকলের সেই সৌভাগ্য হয় না। শান্তভাবে বিদায় নিতে শেখাটাই মূল কথা। আমাদের পুরাতন ঐতিহ্য বার্ধক্যে অনশনে দেহত্যাগের কথাও বলা হয়েছে। সেটা অবশ্য চরম পথ। আসল কথাটাই বিবেচ্য। সেটা সরল, তবু দ্বন্দ্বমূলক।
জীবনধারণের জন্য অনিবার্যভাবে সমাজের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করতে হয় প্রত্যেক মানুষকেই। সমাজকে কিছু দিয়ে তবেই আমরা সেই ঋণ শোধ করি। একটা বয়সের পর দেওয়ার শক্তি ক্রমে হ্রাস পায়। কারও অবশ্য সৃজনশীলতা অসাধারণ। শতবর্ষে পা রেখেও নীরদ চৌধুরী থাকেন সৃষ্টিশীল। নব্বই পেরিয়েও কবীর চৌধুরী আরও কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এঁরা কিন্তু ব্যতিক্রম। সাধারণ নিয়মে দেহ ও মনের শক্তি সাত দশক পেরিয়ে হ্রাস পেতে থাকে লক্ষণীয়ভাবে। বাইবেলে সাত দশকের কথা বলা হয়েছে, মানুষের আয়ুর এইখানে কোথাও সীমা টানতে হয়।
এখানে দেখা দেয় একটা দ্বন্দ্ব, যেটা একই সঙ্গে জৈবিক ও নৈতিক। চিকিৎসাবিদ্যার গুণে নানারকমের ব্যাধি অতিক্রম করে জীবনটাকে টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সেটা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একদিকে সমাজকে কিছু দেওয়ার শক্তি আমাদের কমে যায়। অন্যদিকে দেহটাকে মেরামত করে চলনসই রাখার খরচ ক্রমেই বেড়ে চলে। শেষ পর্যন্ত একটা হিসাবনিকাশ করার সময় আসে। প্রিয়জনেরা অন্য কথা বলবেন। সেটা তাঁদের মুখে শোভা পায়, যদিও মুখে না বললেও তাঁরাও একদিন সেবা করে করে ক্লান্ত হন। নৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ব্যক্তি স্বয়ং। যে বাড়িটা কোনোক্রমে আরও নৈতিক বিচারে গ্রাহ্য! একটি জীর্ণ দেহকে কোনোক্রমে আরও দুই-চার বছর টেনে নেওয়ার চেয়ে ওই অর্থটা লোকহিতকর অন্য কোনো উদ্দেশ্যে খরচ করতে পারলেই কি ভালো হয় না? সমাজের কাছে ব্যক্তির ঋণ শোধ করার সেটাই কি শ্রেয় পথ নয়? যুক্তি কি বলে? আমাদের দূর্মর জীবনতৃষ্ণা মিটাতে চায় না। কবি বলেন, যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব? পশ্ন যথার্থ। তবু পালটা প্রশ্ন থেকেই যায়, যেতে বাধা কি? কতটা মূল্য দিয়ে টিকে থাকা সার্থক? জীবনের প্রতি জৈব আসক্তি টিকে থাকে দীর্ঘকাল; শৈশবের বিস্ময়ের দৈব শক্তি কিন্তু ক্ষয় হয়ে যায় দ্রুত। সীমাবদ্ধ স্থান মানুষের এই সংসারে। বার্ধক্য যদি স্থান ছেড়ে দেয় বিনা অভিযোগে, তারুণ্যের প্রতি পরম শুভেচ্ছায়, তবে আপত্তি তোলা যাবে কোন যুক্তিতে?
যেতে বাধা কি? কোনো অভিযোগ নিয়ে চলে যাওয়া অর্থহীন। অভিমান অবশেষে হয়ে ওঠে হাস্যকর। যতদিন সমাজকে দেওয়ার মতো সাধ্য আছে ততদিন মানুষের মাঝখানে থাকার অর্থ হয়। কিন্তু তারপর? সমাজে সব ন্যায়-অন্যায়ের বাইরে আছে অন্য এক বিশ্বলোক। আকাশভরা সূর্য তারায় বিস্তৃত, তবু কী আশ্চর্য সে বাঁশি বাজায় মর্ত্যরে মানুষের হৃদয়ে। তার কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, যা পেয়েছি এই জীবনেই, তার কি কোনো প্রতিদান সম্ভব! সম্ভব শুধু কৃতজ্ঞ স্বীকৃতি। ‘যাওয়ার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই– যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’ জীবনকে যখন অন্ধভাবে আঁকড়ে থাকতে চাই তখন বিশ্বলোক থেকে অতুলনীয়কে পাওয়ার এই শক্তিটা আমরা হারাই। সহজে বিদায় নিতে পারাটাই আসল কথা। সেটা সহজ নয়, সমস্যা এইখানেই।
সন্ধ্যার সুর আর মধ্যাহ্নের সুর এক হতে পারে না। বার্ধক্যের প্রজ্ঞা আর যৌবনের প্রতিজ্ঞা একইভাবে উচ্চারিত হয় না। এইমাত্র কিছু কথা যেভাবে বলা হলো সেটা বার্ধক্যের উচ্চারণ, তাতে বিদায়ের সুরটা প্রধান। মৃত্যুভয় শোভা পায় না যৌবনেও। কিন্তু যৌবনের প্রধান কথাটা ভিন্ন, তার ভাব ও ভাষা ভিন্ন। এই বিশ্বময় যে-তেজ ও শক্তি প্রবাহিত, মানুষের সচেতন আধারে যাকে ন্যস্ত করেছে প্রকৃতি, যৌবনেই তার দীপ্ত প্রকাশ। সেই তেজকে নিষ্ঠা ও বীর্যের সঙ্গে জীবনের রূপায়ণে নব নব সৃষ্টিতে নিযুক্ত করাই যৌবনের পবিত্র দায়িত্ব। কোনো সাময়িক নৈরাশ্যকে চরম বলে মেনে নেওয়া জীবনের ধর্ম হতে পারে না। আত্মহত্যা যদি হয় হতাশার গান তবে সেই গান শোভা পায় না কোনো ঋতুতেই, যৌবনে একেবারেই নয়।
শুদ্ধ নৈতিকতার দৃষ্টিতে ব্যক্তিমানুষের প্রধান কর্তব্য নয় নিজের জীবনটাকে যেকোনো প্রকারে যথাসম্ভব দীর্ঘ করা। বরং তার দায়িত্ব যুগে যুগে ধাবিত সমগ্র মানুষের জীবনধারাকে জীর্ণতা থেকে উদ্ধার করা, নিজ সাধ্য অনুযায়ী সমৃদ্ধ করা। এই কথাটুকু এরপর বলে যাওয়া যায়, যেতে যদি হবে, যেতে যেন পারি তবে অনায়াসে আনন্দিত মনে। এ কথা শোভা পায় যেমন শহিদের কণ্ঠে তেমনই অনাসক্ত ঋষির প্রার্থনায়।












সর্বশেষ সংবাদ
বিএনপি চেয়াপার্সনের উপদেষ্টা হলেন হাজী ইয়াছিন
মুয়াজ্জিনের পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে ওসির বিরুদ্ধে মামলা
‘বিমানবন্দরেই ডাকাতদের টার্গেট হন প্রবাসীরা’
১৬ বছর যাবৎ পৌর মার্কেটের ২৬ দোকানের ভাড়া আত্মসাৎ
প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বাধ্যতামূলক ছুটিতে কুবি শিক্ষক কাজী আনিছ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বিএনপি চেয়াপার্সনের উপদেষ্টা হলেন হাজী ইয়াছিন
কুমিল্লায় বিদেশী পিস্তলসহ দুই ডাকাত গ্রেফতার
কুমিল্লায় র‌্যাবের অভিযানে অস্ত্র ও গুলিসহ যুবক গ্রেফতার
১৬ বছর যাবৎ পৌর মার্কেটের ২৬ দোকানের ভাড়া আত্মসাৎ
মুয়াজ্জিনের পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে ওসির বিরুদ্ধে মামলা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২