বুধবার ১৯ মার্চ ২০২৫
৫ চৈত্র ১৪৩১
অনেক জীবন
আম্মা ছিলেন সনাতনী-মিনিমাল মানুষের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিকৃতি...
মনজুরুল আজিম পলাশ ।।
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫, ১:০৪ এএম আপডেট: ১৮.০৩.২০২৫ ১:৪৮ এএম |



আম্মার মধ্যে খুব অনায়াসভাবে একটা সনাতনী-মিনিমাল সত্তা ছিল। 
শৈশবের প্রকৃতি শাসিত পরিবেশ আর স্বচ্ছল মানবিক পারিবারিক অবস্থা নিশ্চয় এর বিনির্মানে সহায়তা করেছে। 
কিন্তু শুধু পরিবেশ কাউকে নির্মাণ করেনা, প্রতিটি মানুষের গ্রহণ-ধারণ-সৃজন করবার শক্তি আলাদা হয়। 
আম্মা ছিলেন সেই আলাদা শক্তিধরদের দলে।
আম্মা অনুকূল-প্রতিকূল-দুই পরিবেশেই সনাতন সুন্দর থাকতে পেরেছিলেন।
আম্মার এই সনাতনী সত্তা সর্বতোভাবে প্রতিফলিত ছিল তাঁর জীবনে। তিনি মূল চরিত্রে বিশ্বাসে অবয়বে একই রকম ছিলেন। 
সামান্য পাউডার দিয়ে নিজেকে পরিচর্যা করেছেন। তিনি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে কম প্রসাধনে সবচেয়ে বেশি সুশ্রী একজন মানুষ। আম্মার অন্তর সুন্দর ছিল যা দ্যুতি হয়ে মুখায়বেও  প্রকাশ পেয়েছে।
আম্মা ছিলেন সনাতনী-মিনিমাল মানুষের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিকৃতি...
আম্মার রাঁধা তরকারিতেও তেল মসলার আধিক্য ছিলোনা।
তাঁর রাঁধা লাউ দিয়ে শোলমাছ ছিল আমার প্রিয়। লাউয়ের সবুজ আর মাখানো ঝোল থেকে মাছের টুকরোর ব্যক্তিত্বপূর্ণ উঁকি দেয়া উপভোগ করতাম। আম্মার রান্না ইলিশ মাছ ভেজে দোপেঁয়াজা ছিল পৃথিবীর এক সুস্বাদু কিন্তু নিরাপদ খাবার। এখনো আমার বিস্ময় রয়ে গেছে যে আগে একটা ইলিশ মাছে এতগুলো টুকরা কিভাবে হতো। কারণ আম্মাদের হাতে অনেক জাদু থাকে। আহা ইলিশ মাছ। স্বর্গে ইলিশ নেই বলে সৈয়দ মুজতবা আলীর খেদ মনে পরে গেলো।
আম্মা ছিলেন সর্বক্ষত্রে একজন বরকতময় মানুষ।
শত কষ্টে অভাবেও তিনি সঞ্চয় করতেন।
সঞ্চয় এবং অপেক্ষা করতে পারার এক অদ্ভুত স্বাভাবিক গুণাবলি ছিল তাঁর। প্রতিভা বসুর মত ভাংতি পয়সা জমিয়ে আম্মাও হাজার টাকা জন্ম দিতে পারতেন। সেই টাকায় হতো নানা জরুরি কাজ। এই যে মাটির ব্যাংকে একটি দুইটা পয়সা জমিয়ে টাকা বানানো এই স্বভাব আমিও পেয়েছি আম্মা থেকে।
সনাতনী সঞ্চয়ী আমাদের আম্মার কাছে টাকা থাকবেই। 
তিনি আব্বা চাচা মামা এবং আমাদের সবাইকে তাঁর জমানো টাকা দিয়েছেন এবং বিনিয়োগ করেছেন সারাজীবন। আমরা যেমন পকেটে এক হাজার টাকা থাকলে পাঁচশো টাকার বাজার করবো বা উড়িয়ে দেবো সবটাই-আম্মা তেমনটি নন। তিনি নয়শো টাকা জমিয়ে নব্বই টাকার বাজার করবেন আর দশটাকা টুপ করে ব্যাংকে ফেলে দিবেন। সপ্তাহে বা মাসে মাসে জমিয়ে আম্মা লক্ষ লক্ষ টাকা তৈরী করতে পারতেন। কিন্তু অর্থ সমাগমের জন্য আম্মা কখনোই অসৎ পথে হাঁটেননি। ‘অপেক্ষা’ বিনিয়োগ করে অর্থ গড়েছেন। ‘অপেক্ষা’ আমি শিখেছি আম্মার কাছে।
আম্মা অপচয় করতেন না, তিনি বিলাসী নন, কৃপণও নন। তিনি ছিলেন পরিমিত। প্রকৃত সনাতনী। মিনিমালিস্ট। অপেক্ষার দেবী-দূত।
আম্মা সুতি শাড়ি পড়া চুলখোলা ঘোমটা দেয়া অপূর্ব কমনীয় মুখের একজন সুশ্রী মানুষ। স্রস্টা-প্রকৃতি তাঁকে যা দিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন। প্রসাধন মেখে নিজের কমনীয়তাকে কখনো বিক্ষত করেননি। এখনকার মিনিমালিস্টরা কত কষ্ট করে নিজেদের ক্লাটার ফ্রি করেন। আম্মাকে কখনো ডেকো-শো পিস কিনতে দেখিনি। তিনি আজীবন বিলাসিতার আবর্জনামুক্ত মানুষ ছিলেন।
তিনি ছিলেন আমার দেখা একজন দারুন ‘অর্গানিক মিনিমালিস্ট’। আম্মার মিনিমাল জীবন নিয়ে ডকু হতে পারে একটা যা দেখলে পৃথিবীর প্রচারবাদী মিনিমালিস্টরা লজ্জা পাবে।
যৌবনকালে পাপ আর বয়সকালে ধর্ম কর্ম-আম্মা মুক্ত ছিলেন এই বিপরীতধর্মী দ্বৈত জীবন থেকে। আম্মার ধর্ম ছিল ঘোমটাময়-মৃত্তিকালগ্ন লোকজ ইসলাম যেখানে কোরান তেলাওয়াত আছে সুরের আহবান আছে কিন্তু কোন বিদ্বেষ নেই। আম্মা শান্তির জায়নামাজে ধ্যানী থেকেছেন অহরাত্রি। তিনি জীবন প্রয়োগে ছিলেন আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক। আমার সনাতনী জীবনসঙ্গীকে বরণ করে নিয়েছিলেন মানুষ হিসেবে। আম্মাকে বিভিন্নসময় আত্মীয়স্বজনরা কত কথা বলে মনটা ছোট করতে চেয়েছে কিন্তু লাভ কী?! আম্মা নিজেইতো চিন্তা চারিত্রে সনাতনী। আমরা দেখেছি আম্মাকে বাঁচাবার প্রক্রিয়ায় সনাতনী মানুষরাও একই আবেগে ছুটে এসেছে হসপিটালে। আম্মা যোগ্য ছিলেন সেই সেবা নেয়ার এবং মরণেও সকল কিছু ধারণের।
আম্মা ছিলেন বেলি জুঁই টগর হাসনাহেনা গন্ধরাজ ফুলের মত সুন্দর শুভ্র সুগন্ধময়। হাজীগঞ্জ আম্মাদের বাড়ির সামনে পেছনে আক্ষরিক অর্থেই সেইসব ফুল ফুটে থাকতো।
যিনি পাপই করেননা তার পুণ্যের জন্যও ছটফটানি থাকেনা। আম্মা কখনোই হ্বজ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা করতে চাননি। এইসব এক্সপেনসিভ পুণ্য প্রক্রিয়ায় তিনি আগ্রহী ছিলেন না। পাপের কোন ভার ছিলোনা তাঁর দেহমনে। তিনি তারচেয়ে একটা পুকুর পারে বসে থাকতে পছন্দ করতেন। খুব খুশি হতেন তাঁকে নিয়ে যখন হাজীগঞ্জ বা গুলবাহার গ্রামে যেতাম। প্রকৃতি বৃক্ষ ফুলের সুবাস মানুষের ভালোবাসা ছিল আম্মার তীর্থ।
আম্মার বিনোদন, সময় কাটানো ছিল পরিমিত। কখনোই কোনকিছু জমকালো নয়। তাঁর পছন্দের রং খয়েরি আকাশি ধূসর অফ হোয়াইট। আম্মাকে আমরা কখনো একফোঁটা জরি চুমকি সমৃদ্ধ পোশাক পরিধান করতে দেখিনি। একটা থান কাপড়েই তিনি চমৎকার ছিলেন। আমি ছাত্রাবস্থায় ঢাকা নিউমার্কেট থেকে আম্মার জন্য একজোড়া থান শাড়ি নিয়ে আসতাম কুমিল্লা। দুটো থান কাপড় দিয়ে আম্মা অনেকদিন চলতে পারতেন। এখনকার নিজের শাড়ি সংগ্রহ ভুলে যাওয়া নারীরা কল্পনাই করতে পারবে না দুটি থানের পরিমিত সেই জীবন।
আম্মা কোন অস্থিরতা প্রদর্শন ছাড়াই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে পারতেন। দুপুরে একটু বিশ্রাম। সন্ধ্যায় ভালো কিছু সিরিয়াল দেখতেন। চিনতেন কারা অভিনয় করছে। তিনি স্মার্ট ফোনে সামাজিক মাধ্যমে মূলত ছেলে মেয়ে আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ পেতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর একটা পর্যায়ে সিরিয়াল দেখা বা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর কোন কিছু নিয়েই কিন্তু অভিযোগ ছিলোনা, অভিযোজন ক্ষমতা ছিল তীব্র। মানিয়ে নিতেন পরিবেশের সাথে।
মানুষকে জ্বালানো বা নিজের কোন বিষয়ে চাপপ্রয়োগ আম্মার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। কোনদিন বয়েসের সুযোগ নিয়েও কাউকে জ্বালাতন করেননি। একমাস আগে নিজে পোশাক পছন্দ-পরিধান করে হেঁটে গিয়েগাড়িতে উঠেছেন হাসপাতাল যাওয়ার জন্য। আম্মা ছিলেন নিজেই একজন পরিপূর্ণ সত্তা-আত্মার অধিকারী যিনি জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত অন্যের দয়া-করুনা ছাড়া বসবাস করেছেন।
আমাদের আম্মা ছিলেন এই পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ,
অনায়াস এক সনাতনী এবং অর্গানিক একজন মিনিমালিস্ট। আপনারা যদি ভাবেন আমাদের মা বলে আমরা আবেগের শীর্ষে উঠে এগুলো বলছি তাহলে নিজেকে বঞ্চিত করবেন তাঁকে জানা থেকে। আম্মার জীবন সত্যিকারভাবেই অনুপ্রেরণার অনুকরণের এবং অনুসন্ধিৎসার সবার জন্য।
এইরকম একজন মা আমাদের জন্য অসীম অস্তিত্বের ভ্রমণ হয়েই থাকবে। আপনারাও তাঁর উন্মোচন জানবেন।
আম্মা ছিলেন সনাতনী-মিনিমাল মানুষের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিকৃতি...













সর্বশেষ সংবাদ
চান্দিনায় এনজিও'র পুরুষ কর্মীকে আটকে রেখে নারী কর্মীকে যৌন নির্যাতন
জরুরি সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দিন-ডা. তাহের
দাউদকান্দিতে শিশু বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার ১
ধর্ষণের ঘটনা ফেসবুকে শেয়ার করায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত ১৫
মেঘনার বাজার গুলোতে মুরগী ড্রেসিংয়ে অতিরিক্ত চার্জ, ভোক্তাদের অভিযোগ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চলছে তদন্ত
অর্থ আত্মসাৎ মামলায় কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কারাগারে
কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কারাগারে
লাকসামে তরুণীকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, গ্রেপ্তার-৫
কুমিল্লা মানবিক টিম এর উদ্যোগে দোয়া ও ইফতার মাহফিল
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২