বুধবার ২ এপ্রিল ২০২৫
১৯ চৈত্র ১৪৩১
কুমিল্লায় মহাত্মা গান্ধী
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫, ১:০৪ এএম আপডেট: ১৮.০৩.২০২৫ ২:১৩ এএম |

কুমিল্লায় মহাত্মা গান্ধী
মহাত্মা গান্ধী। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা এবং অহিংস প্রতিরোধের অগ্রদূত। তিনিই সত্য ও অহিংসার আদর্শে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কৌশল ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই দর্শন প্রচার ও বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তিনি ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন। কুমিল্লাতেও একাধিকবার আগমন করেছেন। কুমিল্লায় তাঁর স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে অন্যতম হলো ঐতিহাসিক অভয় আশ্রম, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্য অবদান রেখেছিল। অভয় আশ্রমের অনুসারীরা মহাত্মা গান্ধীর সত্য ও অহিংসার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার নীতিতে অটল ছিলেন। যদিও প্রারম্ভিক পর্যায়ে আশ্রমের কিছু সদস্য ধর্মীয় সহিংসতায় জড়িত হয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এটি এ আলোচনার প্রসঙ্গ নয়। মূল প্রসঙ্গ হলো- সত্য ও অহিংসার আদর্শে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বাণী প্রচারে মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লায় ঠিক কতবার এসেছিলেন এবং তাঁর স্মৃতিধন্য স্থানগুলো কী কী ? সাধারণভাবে অনেকে মনে করেন, মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লায় তিনবার এসেছিলেন-দু’বার অভয় আশ্রমে এবং একবার নোয়াখালীর দাঙ্গার সময়। তবে ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত পত্রপত্রিকার সূত্র থেকে জানা যায়, গান্ধীজি মোট পাঁচবার কুমিল্লায় আগমন করেছিলেন।
১৮৮৮ সালে আইন শিক্ষার উদ্দেশ্যে লন্ডনে গিয়ে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জনের পর মহাত্মা গান্ধী ১৮৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় আইন পেশায় নিযুক্ত হন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ শাসনের বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তিনি অহিংস আন্দোলনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। ১৯১৫ সালে তিনি ভারতে ফিরে এসে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা করেন। তার নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-চম্পারণ ও খেড়া আন্দোলন (১৯১৭-১৯১৮), অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২), লবণ সত্যাগ্রহ বা দাণ্ডি অভিযান (১৯৩০) এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২)।
মহাত্মা গান্ধীর অহিংস প্রতিরোধের দর্শন কুমিল্লার রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার একাধিক আগমন কুমিল্লার মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা ও অহিংস প্রতিরোধের মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল। মহাত্মা গান্ধীর কুমিল্লা সফরের এই ইতিহাস আজও বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস অসযোগ আন্দোলনের শুরুতে ট্রেন যোগে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে ১৯২১ সালের ৩১ আগস্ট মহাত্মা গান্ধী প্রথম কুমিল্লায় পদার্পণ করেন। ট্রেন থেকে নেমে তিনি কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় বিপুল সংখ্যক জনতার উদ্দেশ্যে ৫ মিনিট বক্তব্য রাখেন। ১৯২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ইংলিশম্যান পত্রিকায় ‘চট্টগ্রামে গমন’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদে এ তথ্য পাওয়া যায়। পত্রিকাটিতে বলা হয় ‘৩১ আগস্ট সকালে মি. গান্ধী চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে কুমিল্লা অতিক্রম করেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কুমিল্লা স্টেশনে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল। ট্রেন থেকে নেমে তিনি পাঁচ মিনিট ধরে সমাবেশে ভাষণ দেন। তিনি জনগণকে স্বরাজ এবং খিলাফত ও পাঞ্জাবের ভুল সংশোধনের জন্য মদ ও বিদেশি কাপড় ত্যাগ করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি জনগণকে অহিংস থাকার জন্যও অনুরোধ করেন। জনতার উল্লাসের মধ্যে তাঁকে বহনকারী ট্রেনটি কুমিল্লা ছেড়ে যায়।’
কুমিল্লায় মহাত্মা গান্ধী
পরের বছর ১৯২২ সালের মার্চে মহাত্মা গান্ধী গ্রেপ্তার হলে কুমিল্লার স্বাধীনতাকামী জনতা সে খবর শান্তভাবে গ্রহণ করেন। তবে একটি প্রতিবাদসভা আহবান করে মহাত্মা গান্ধীর শেষ বার্তা অক্ষরে অক্ষরে পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এমন একটি খবর ছাপা হয় উপরে উল্লেখিত পত্রিকাতে। ১৯২২ সালের ২৩ মার্চ প্রকাশিত সে পত্রিকার খবরে বলা হয়- ‘গান্ধীজির গ্রেফতারের খবর এখানে শান্তভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ১৭ মার্চ বাবা অনঙ্গ মোহন ঘোষের সভাপতিত্বে একটি গণসভা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি গান্ধীজির শেষ বার্তা ব্যাখ্যা করেন এবং শ্রোতাদের তাঁর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে ও আন্তরিকভাবে অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ করেন। ১৮ মার্চ  বাবু মথুরা ঝান দেবের উদ্যোগে কংগ্রেস কমিটির অধীনে ত্রিপুরার চরকায় তৈরি সুতা এবং খদ্দরের একটি প্রদর্শনী খোলা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ ভালো সুতা এবং খদ্দর এসে পৌঁছেছে। প্রদর্শনীটি চার দিন ধরে চলবে।’ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে কুমিল্লায় মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় ১৯২১ সালে অভয় আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর চরকায় তৈরি সুতা ও খদ্দরের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল। মুক্তি পাওয়ার পর ১৯২৫ সালের ১৪ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লায় এসেছিলেন। তিনদিন অবস্থানকালে তিনি ১৫ মার্চ ৬টি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে অভয় আশ্রম পরিদর্শনও রয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ লাহোরের সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকায় ১৯২৫ সালের ১৭ মার্চ প্রকাশিত হয়। কিন্তু খবরটিতে আর বিস্তারিত তেমন কিছু উল্লেখ নেই। কুমিল্লায় আসার আগে তিনি নোয়াখালীতে ছিলেন এবং ১৭ মার্চ শনিবার রাতে কুমিল্লা থেকে তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১৯২৭ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতা থেকে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর দল কুমিল্লায় আসেন। এ তথ্য ৮ জানুয়ারি সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিস্তারিত কিছু পাওয়া যায় নি। তবে অভয় আশ্রমের সাবেক সভাপতি নৃপেন্দ্রনাথ বসু ‘শাশ্বত ত্রিপুরা’ গ্রন্থে মহাত্মা গান্ধী ১৯২৭ সালে অভয় আশ্রম পরিদর্শন করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকায় ‘মি. গান্ধীর আসন্ন সফর’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল, গান্ধীজি কুমিল্লা থেকে বেনারস যান। এরপর ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীতে দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। সে সময় কুমিল্লায় তাঁকে ঘিরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সভা আহবান করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তখন কুমিল্লায় এসেছিলেন বলে তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি। 
ক্রীড়াসাহিত্যিক সুপ্রিয় সেনের লেখা ‘সেই শহর সেই কাল’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী থেকে চাঁদপুর হয়ে ফিরেন। চাঁদপুরে একটি প্রার্থণা সভায় বক্তব্য রাখেন। কুমিল্লা থেকে ট্রেনে করে বিপুল সংখ্যক মানুষ চাঁদপুর যায়।
১৯৪৬ সালের ১১ ডিসেম্বর একটি বিশেষ বিমানে দিল্লি থেকে কুমিল্লায় আসেন ভাদ্রীর রাজা। তিনি কুমিল্লা বিমান বন্দরে নেমে নোয়াখালীর শ্রীরামপুরে যান মহাত্মা গান্ধীর সাথে দেখা করতে। তিনি কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালানীর কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে এসেছিলেন-এমন খবরই জানিয়েছে ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকা। ১৪ ডিসেম্বর একই পত্রিকায় একটি খবর ফলাও করে ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়, ১৭ মার্চ মঙ্গলবার পূর্ব বাংলার কুমিল্লায় ভারতীয় অন্তর্বর্তী সরকারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট পণ্ডিত নেহরু ও মি. গান্ধীর সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। তবে সে সাক্ষাতটি যে অনুষ্ঠিত হয় নি তা ১৮ ডিসেম্বরের পত্রিকা থেকে জানা যায়। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কুমিল্লায় বৈঠকের সম্ভাবনা ছিল, নোয়াখালীতে অবস্থানরত মহাত্মা গান্ধীর সাথে বৈঠক প্রসঙ্গে পণ্ডিত নেহেরু সাংবাদিকদের বলেন, তিনি নিজে মহাত্মা গান্ধীর সাথে বৈঠকের সুযোগটি কাজে লাগাতে না পারায় কিছু কংগ্রেস নেতা অদূর ভবিষ্যতে মহাত্মা গান্ধীর সাথে দেখা করবেন এবং তিনি এ মাসের শেষের দিকে মহাত্মা গান্ধীর সাথে দেখা করতে পারবেন বলে মনে করছেন। এতে প্রতিয়মান হয় যে, মহাত্মা গান্ধী কুমিল্লায় আসার কর্মসূচি পরে বাতিল হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯৪৭ এর ১২ জানুয়ারির সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকায় এক খবরে বলা হয়- অভয় আশ্রমের কোষাধ্যক্ষ এম.এল.এ. শ্রী অন্নদাপ্রসাদ চৌধুরীর মতে, মহাত্মা গান্ধী অদূর ভবিষ্যতে কুমিল্লায় অভয় আশ্রম পরিদর্শন করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। শ্রী চৌধুরী বলেছেন, কুমিল্লা সফরের সময় মি. গান্ধীকে এক লক্ষ টাকার থলি উপহার দেওয়া হবে। শ্রী চৌধুরী মি. গান্ধীর সাথে দেখা করে নোয়াখালীর দাঙ্গায় পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, অভয় আশ্রম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ১০০ জন অসহায় মেয়েকে এক বছরের জন্য আশ্রয় ও শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ইতিমধ্যে ২৪ জন মেয়ে আশ্রমে এসেছে। আহমেদাবাদ রিলিফ কমিটি এই সংযোগে আশ্রমকে এক বছরের জন্য মাসিক ৪ হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মহাত্মা গান্ধী সে সময় কুমিল্লায় অভয় আশ্রম পরিদর্শন করেছেন বলে কোন সংবাদের কপি পাওয়া যায় নি। ধারণা করা যেতে পারে যেহেতু মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী থেকে চাঁদপুর হয়ে ফিরেছেন, সে কারণে তিনি আর কুমিল্লায় আসেন নি।
মতামত জানাতে-+৮৮০১৭১১১৫২৪৪৩












সর্বশেষ সংবাদ
নির্বাচনের আগেই জুলাইয়ে গণহত্যার বিচার চান কুমিল্লার তিন শহীদ পরিবার
কুমিল্লায় ঘাস নিয়ে নদীতে নিখোঁজ কৃষক, চার ঘন্টা পর উদ্ধার হলো মরদেহ
কুমিল্লায় পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
কুমিল্লার চান্দিনায় বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা লেগে ৩ জন নিহত
মুসল্লিদের ঢল নেমেছিল কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহে। স্বস্তির ঈদ জামাত
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লা জিলা স্কুলে গ্র্যান্ড ইফতার মাহফিল
কুমিল্লায় আইনজীবী আবুল কালাম হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার
কুমিল্লায় ঈদের প্রধান জামাত সকাল সাড়ে ৮টায়
কুমিল্লার ৩৮পরিবারে ‘বিষাদের ঈদ’
হরিশ্চর ইউনিয়ন হাই স্কুল এন্ড কলেজের চতুর্থ পুনর্মিলনী
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২