মূল্যস্ফীতির
কারণে ক্রয়ক্ষমতার যে অবনমন হয়েছে তা স্থির আয় ও নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে
সঙ্গে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তকেও বিপর্যস্ত করেছে। তাদের জীবনমান
উল্লেখযোগ্যভাবে নেমে গেছে। তাদের কীভাবে স্বস্তি দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবতে
হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভিত্তি, প্রাপ্তি, স্থায়িত্ব বাড়াতে হবে।
মূল্যস্ফীতি
হ্রাসের মতো চ্যালেঞ্জ এক দিনে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি
আগামীতে কিছুটা হ্রাস পেলেও মূল্যস্তর কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক ওপরেই
স্থিত থাকবে। সুতরাং, প্রকৃত বিচারে শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে আয়
বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য এখনই কাজ শুরু করতে হবে। উদ্যোক্তাদের
লভ্যতা নিশ্চিত করে কীভাবে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তা নিয়ে ভাবতে
হবে এবং একই সঙ্গে শ্রমিকদের জন্য শোভন মজুরি ও শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত
করতে হবে।
তথ্য-উপাত্তের সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বিগত সময়ে
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা অনেক প্রশ্ন তুলেছেন। এ বিষয়টিও নীতিনির্ধারকদের
বিবেচনায় অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর
ওপরে অযাচিত প্রভাব বিস্তার করে যথাযথ তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক
প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিবিএস, এনবিআরসহ বিভিন্ন
সংস্থাকে প্রয়োজনীয় ও প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক
তথ্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত, এটা স্বীকার করতে হবে,
প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কথা অনেকদিন থেকেই
বলা হচ্ছে। উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তাস্তর এবং আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর
অবধি সরবরাহ শৃঙ্খলে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং
বাধা অপসারণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সিন্ডিকেশন, তা আমদানি
পর্যায়ে হোক বা স্থানীয় উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে হোক এগুলো ভেঙে দিতে হবে।
সরবরাহ-চাহিদার নিরিখে সময়মতো আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মজুত
প্রয়োজনমাফিক রাখতে হবে। বাজারমূল্যকে যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে পণ্য মজুতকে
কৌশলীভাবে ব্যবহার করতে হবে। তাহলে অন্তত নির্দিষ্ট কিছু নিত্যপণ্যের
চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে যে পার্থক্য সেটা কমানো সম্ভব হবে, বাজারমূল্য
নিয়ন্ত্রণ সহজতর হবে। বাজার ব্যবস্থাপনাকে জোরদার করতে হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ
করতে হবে। এসব কার্যক্রমের মধ্যে কিছু বিষয় আছে যেগুলো স্বল্প মেয়াদের;
কিছু আছে মধ্য মেয়াদের। ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনা সে মাফিক সাজাতে হবে।
দেশের
সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বহুমাত্রিক চাপের সম্মুখীন হয়েছে যা
বর্তমানেও অব্যাহত আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভের পতন, বিনিময় হারের
অবনমনসহ অর্থনীতির বিরাজমান সমস্যাগুলো নিকট অতীতে ক্রমান্বয়ে আরও গভীরতর
হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন জরুরি করণীয় হয়ে
দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি, পুঁজিবাজারে অস্থিরতা, রাজস্ব আদায়ে
দুর্বলতা, অর্থনীতি পরিচালনায় ক্ষমতাবান গোষ্ঠী ও গদিনশিন রাজনৈতিক শক্তির
প্রভাব-প্রসূত অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং সামগ্রিকভাবে সুশাসনের অভাব সামষ্টিক
অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করেছে, আয়, সম্পদ ও ভোগ বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলেছে এবং
এসবের প্রতিকারের নিমিত্তে সংস্কারের দাবিকে এখন সামনে নিয়ে এসেছে।
ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা,
রপ্তানিমুখী কার্যক্রম, যোগাযোগ সংযোগসহ বিভিন্ন খাত নানা প্রতিবন্ধকতার
মুখোমুখি হয়েছে, সরবরাহ চেইন অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়েছে যেগুলো
পুনর্গঠনে কাজ করতে হবে। অন্তর্র্বতী সরকারকে নানামুখী চাপ সামাল দিতে হবে।
এসব চ্যালেঞ্জের নিরিখে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং
ছাত্র-জনতার ত্যাগকে মর্যাদা দিতে হবে। আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে যাতে কোনো
সমস্যা না হয় সেদিকটা দেখতে হবে। সরবরাহ চেইনের মধ্যবর্তী যেসব স্বার্থ
সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী আছে তাদের নিয়মনীতির মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
আমাদের
রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত তুলনীয় দেশের নিরিখে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। চলমান
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ সপ্তাহে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার
ক্ষেত্রে যেসব ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে সে পরিপ্রেক্ষিতে অর্থবছরের জন্য যেসব
লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে সেগুলো পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
সামষ্টিক
অর্থনীতির ওপর যে নানামুখী চাপ সৃষ্টি হয়েছে, অন্তর্র্বতী সরকারের পক্ষে
সেগুলো মোকাবিলা সহজ হবে না। এজন্য সক্রিয় উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন
হবে সময়েরও। আমাদের আর্থিক নীতি ও রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।
ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা ও বিনিয়োগকারী স্বার্থ রক্ষায় ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ
নিতে হবে। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িত
প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সঠিকভাবে সেবা দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিনিয়োগ-সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতকরণের সঙ্গে সরবরাহের নিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতি
নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত, সবকিছুই জড়িত।
প্রযুক্তি, প্রণোদনা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর সঙ্গে
জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বেশ কয়েক
বছর ধরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা যে স্থবিরতা দেখেছি সেক্ষেত্রে আস্থা
ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করার জন্য ও বিনিয়োগ ব্যয়
হ্রাসের লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে চাঞ্চল্য
আনতে হলে ওয়ান স্টপ সার্ভিসকে প্রকৃত অর্থে কার্যকর করতে হবে। তা করতে গেলে
বিনিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা
বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কার অবশ্যই
অগ্রাধিকারের দাবিদার। এর দুটি দিক আছে। অতীতের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার
জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি
প্রতিরোধে পরিবর্তনমুখী ও সংস্কারধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসব করা
সম্ভব হলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও আমরা তার ইতিবাচক অভিঘাত দেখতে পাব।
কর্মসংস্থান বাড়াতে হলেও এ কাজগুলো করা দরকার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক
যে কর্ম পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে তা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক
পদক্ষেপ।
আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারত্বের হার অনেক বেশি। শ্রমশক্তির
এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষায়, প্রশিক্ষণে, কর্মসংস্থানে নেই। এর অন্তর্ভুক্ত
শিক্ষিত যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদায়ন ও
যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। যুবশক্তিকে কীভাবে কাজে
লাগানো যায় সে নিয়ে গভীরভাবে ভাবার দরকার আছে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা
ব্যবস্থাপনার মধ্যে পুঞ্জীভূত দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে
হবে। শিক্ষাব্যবস্থার বিরাজনীতিকরণ করতে হবে। জুলাই বিপ্লবের ছাত্রদের
আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাবের প্রশ্নে, মেধার
মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়, এটা মনে রাখতে হবে। তাকে সম্মান দিতে হবে। কোটাবিরোধী
আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে উন্নীত হয়েছিল।
একটি
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য ছাত্র-যুবাদের, আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার প্রতি
বিশ্বস্ত থাকতে হবে। সেই বিশ্বস্ততার পরীক্ষা হবে তাদের জন্য উন্নত জীবন ও
কর্ম সহায়ক শিক্ষা, ইতিবাচক কর্ম পরিবেশ ও বৃহত্তর কর্ম সুযোগ সৃষ্টি করার
মাধ্যমে, দেশে ও দেশের বাইরের বর্তমান ও ভবিষ্যতের শ্রমবাজারের জন্য তাদের
প্রস্তুত করার মাধ্যমে। দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তরুণদের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
অন্তর্বর্তী
সরকারকে অগ্রাধিকারগুলো নির্ধারণ করতে হবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর
সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এবং করণীয়গুলোকে শনাক্ত করে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ
করতে হবে। এ সরকার পুঞ্জীভূত চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করতে পারবেন,
সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করবেন, বিনিয়োগ পরিবেশকে উন্নত করবেন, মূল্যস্ফীতি
নামিয়ে আনবেন- জনমনে এসব বিষয়ে আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা দুই-ই আছে।
ছাত্র-জনতা, যারা এত বড় আন্দোলন করেছেন, আত্মাহুতি দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার
করেছেন, তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের প্রত্যাশার যৌক্তিকতা অনস্বীকার্য। এ
প্রত্যাশা পূরণ অন্তর্বর্তী সরকারেরও অঙ্গীকার বটে। কৌশলীভাবে, সঠিক তথ্য ও
গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করে, যৌক্তিক পদক্ষেপ ও সংবেদনশীলতার
সমন্বয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
ব্যাপক জনগণের সমর্থন ও আস্থাকে
শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচনা করে নতুন সরকার সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম
হবে। আমরা ঋণ নিয়ে যে অর্থ ব্যয় করছি তা কোন কোন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা হবে
প্রয়োজন মাফিক তার পুনর্বিবেচনা ও পর্যালোচনার প্রয়োজন। টেকসই ঋণ
ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের
সতর্ক ও নির্বাচিত হতে হবে। চলমান ও সমাপ্য প্রকল্পের বাস্তবায়নকে
অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের ক্ষেত্রে যেসব
বিচ্যুতি-দুর্নীতি হয়েছে তার কার্যকরণ উদঘাটন করে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে
হবে। দুর্নীতিকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ঋণ খেলাপি, কর খেলাপি ও টাকা
পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রকৃত অর্থে শূন্য সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)