শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫
৬ বৈশাখ ১৪৩২
মানবাধিকারের অবক্ষয় রোধ করবে কে!
আবুল কাসেম ফজলুল হক
প্রকাশ: রোববার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৫, ১:৩২ এএম আপডেট: ১৩.০৪.২০২৫ ২:১২ এএম |

 মানবাধিকারের অবক্ষয় রোধ করবে কে!
ইউরোপে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে একসময় বিশাল বিরোধ ছিল। সেই বিরোধে ইহুদিরা টিকতে পারেনি। তারা রাজনৈতিক ও আচরণগত দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। ইহুদিদের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করত। খ্রিষ্টানদের সঙ্গে ইহুদিদের বিরোধের পর ইউরোপে ইহুদিরা অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় পড়েছিল। তখন থেকেই ইহুদিদের প্রতি খ্রিষ্টানদের অন্য রকম এক সহানুভূতি দেখা গেছে। গ্রেট ব্রিটেনই নেতৃত্ব দিয়ে ইহুদিদের মেরেছে এবং তাড়িয়ে দিয়েছে। তারাই ইসরায়েলে ইহুদিদের বসিয়ে দিয়েছে। একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরাই ছিল সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী।
আমেরিকা শক্তি অর্জন করতে শুরু করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। আমেরিকা অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশরাই প্রথমে জেরুজালেমে ইহুদিদের প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার ক্ষেত্রে কাজ করেছে। এখন আমেরিকা ইহুদিদের রক্ষার ক্ষেত্রে কাজ করছে। ১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যদি ইতিহাস দেখি গ্রেট ব্রিটেন প্রথমে এবং বর্তমানে ন্যাটো ইহুদিদের প্রশ্রয় দিয়ে রক্ষা করে যাচ্ছে। তারা ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা এবং তার জন্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করে যাচ্ছে। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে। প্রথমে ব্রিটিশরা এবং  বর্তমানে আমেরিকা ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এগুলো দেখার মতো এখন পৃথিবীতে তেমন কোনো নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান নেই।  যদি আমেরিকা ইহুদিদের রক্ষার পেছনে এমনভাবে না থাকত, তাহলে আপস ও আলোচনার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকত এবং এর একটা সমাধান হতো। আমেরিকা যুদ্ধ থামাতে চায় না। আমেরিকার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্টও স্পষ্টভাবে বলেছেন যে যুদ্ধ থামানো যাবে না। অস্ত্র বিক্রি করা আমেরিকার একটি বড় ব্যবসা। সারা দুনিয়ার ওপর কর্তৃত্ব করা তাদের আরেকটি লক্ষ্য। এসবের কারণেই তারা পৃথিবীব্যাপী মানবতাবিরোধী ও মনুষ্যত্ববিরোধী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ  সবাই এক পক্ষ। আন্তর্জাতিকভাবে এরা অন্যায়ের পক্ষে কাজ করে। ইউক্রেন যুদ্ধ আপস ও আলোচনার মধ্য দিয়ে মীমাংসা করা যেত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চায় যুদ্ধ থাকুক এবং চলতে থাকুক। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য তাদের কর্তৃত্ব বিশ্বে টিকিয়ে রাখা। রাশিয়াকে তারা সব সময় দুর্বল করে রাখতে চায়। অন্যদের দুর্বল করে নিজেদের জাতি ও রাষ্ট্রকে উন্নত ও শক্তিশালী করতে চায় আমেরিকা। যারা সংবাদপত্র পড়েন, তারা সবাই বুঝতে পারেন যে বিশ্বে কী হচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারলেও কেউ কথা বলতে পারছেন না। অনেকে ধারণা করেন, বড় শক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতে নেই। বড় শক্তির সঙ্গে থাকলে নানান দিক দিয়ে লাভবান হওয়া যায়। এই মানসিকতা পরিবর্তন হতে পারে যদি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তাহলে একটা সমাধান হতে পারে।  অনেক দেশের সরকার হয়তো কথা না বলতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তো ঘনিষ্ঠভাবে এসব ব্যাপারে আলোচনা করতে পারে। বিভিন্ন দেশের বুদ্ধিজীবীরা ও রাজনৈতিক দলগুলো তো যদি সত্য কথা ও ন্যায়সংগত কথা বলে, তাহলে মানবাধিকার  লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলোর সমাধান হতে পারে। আমরা যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবী দেখতে চাই না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা যে দলেরই হোক না কেন, তারা পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ চালিয়ে রাখতে চান। বিশ্বে তারা নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চান। যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্রের ব্যবসায় সফল হতে চায়। ইউক্রেন যুদ্ধের পরে ইউরোপের কিছু রাষ্ট্র যে পরিমাণ অস্ত্র কিনে নিয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়েছে।
পৃথিবীব্যাপী মানবতার লঙ্ঘন হচ্ছে, দেখার মতো কেউ নেই।  বর্তমানের বাস্তবতা আর আগের দিনের মতো নেই। আগের দিনে বার্ট্রান্ড রাসেল কোনো বক্তব্য দিলে বিভিন্ন দেশের পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে তুলে ধরা হতো। একজন বার্ট্রান্ড রাসেল যেকোনো রাষ্ট্র বা সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।  তিনি ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিপক্ষে ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ ভালোর জন্য কথা বলেন। এমন ব্যক্তি পৃথিবীতে এখন নেই। আলবার্ট আইনস্টাইন কোনো বক্তব্য দিলে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ত। কারণ তারা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে সব সময় কথা বলেছেন। এখন এমন ব্যক্তি নেই বলেই কথা বলার মানুষ নেই। কে কথা বলবে? কথা বললে যদি বিপদ হয়, তার চেয়ে চুপ থাকা ভালো। 
জাতিসংঘের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলো দেখার কথা। কিন্তু জাতিসংঘ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। আলবার্ট আইনস্টাইন ও বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো লোক এখন দরকার ছিল। কিন্তু এমন লোকের খুবই অভাব। এখন যারা আছেন তাদের কথা অনেকটাই অরাজকতায় ভরা। এখন যারা বুদ্ধিজীবী আছেন তাদের কথা বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো জনমনে গুরুত্ব পায় না। কারণ তাদের রাজনৈতিক দর্শন হলো বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। সরকারবিহীন কর্তৃপক্ষের যে চিন্তা তা সাধারণ মানুষ কখনো গ্রহণ করবে না। 
বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো স্বাধীন চিন্তক এবং দুঃসাহসের সঙ্গে সত্য কথা বলার মতো ব্যক্তিত্ব এখন নেই। আমেরিকা, এমনকি ভারত ও বাংলাদেশেও এমন ব্যক্তিত্ব নেই, যারা রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবে। ইতিহাসের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কখনো কখনো এমন ব্যক্তির জন্ম হয়।  
ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে প্রতিবাদ হচ্ছে না এমন নয়। তবে প্রতিবাদগুলো খুব মৃদু। জাতিসংঘ কার্যকরভাবে এখনো শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। জাতিসংঘ সব রাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিনিধিত্ব করে। জাতিসংঘ মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে কাজ করে। 
আগের দিনে যারা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক  ছিলেন তাদের কথা গণমাধ্যম সুন্দরভাবে প্রচার করত। এখন গণমাধ্যমগুলোরও তেমন স্বাধীনতা নেই। যার ফলে মানবতা লঙ্ঘনের মতো বিষয়গুলোর সত্য চিত্র বিশ্বের মানুষ পাচ্ছে না। এই যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে তা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনার দরকার। মানবতাবিরোধী কোনো বক্তব্য কখনোই আমরা  সমর্থন করব না। আমরা যুদ্ধমুক্ত ও মানবতাবাদী শক্তি হিসেবে মানবজাতি উন্নতি লাভ করুক, সেটাই চাই। কোনো রাষ্ট্র যদি অন্য রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে আসে, তাহলে তা হবে অনধিকার চর্চা। অনধিকার চর্চার বিরুদ্ধে প্রচারণা করা দরকার। রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া কখনোই এমন অনধিকার চর্চা বন্ধ হবে না। ভবিষ্যতের কথা সবাইকে ভাবতে হবে এবং তার জন্য সুদৃঢ় চিন্তাভাবনা দরকার।
মানবতার ধারণাটা মধ্য যুগ থেকেই রেনেসাঁর মাধ্যমে ইউরোপে শুরু হয়েছে। যুদ্ধের মধ্যে অবশ্যই মানবতাবিরোধী ও মনষ্যত্ববিরোধী কর্মকাণ্ড রয়েছে- যা আমরা কখনোই সমর্থন করতে পারি না। বিভিন্ন রাষ্ট্র বা সরকারের এর প্রতিবাদ করা উচিত। নতুন প্রযুক্তি যখন মানুষের ব্যবহারের মধ্যে চলে এসেছে, তখন অনেক কিছুই ভেঙে পড়েছে। যার ফলে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়ার নেপথ্যের কারণগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পেছনে আমেরিকার হাত রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন মুক্তনীতি  ও রিকনস্ট্রাকশন নিয়ে কাজ করেছিল, তখন আমেরিকা তার ঘোর বিরোধী ছিল। ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগে রাজনীতিবিদদের মধ্যে একধরনের নৈতিকতা ছিল। কিন্তু এখন সেটা নেই। তাই নতুন কোনো আদর্শ বা নীতি পৃথিবীতে নেই। প্রযুক্তির আবির্ভাবের সঙ্গে নতুন আদর্শ বা নীতির কথাও চিন্তা করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে  শক্তিধরদের সমাবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দুর্বল ও গরিব রাষ্ট্রের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। পৃথিবীর মানুষের জন্য কল্যাণ করার মতো অনেক সুযোগ রয়েছে। তাই মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, মানুষকে ভালোবাসতে হবে। তাহলেই পৃথিবী অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
লেখক: সভাপতি, বাংলা একাডেমি ও রাষ্ট্রচিন্তক













সর্বশেষ সংবাদ
পুঁটি মাছ কাটা নিয়ে ঝগড়া, স্ত্রীকে খুন করে থানায় আত্মসমর্পণ স্বামীর
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও আ.লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ৬ সদস্য গ্রেপ্তার
এলডিপিতে যোগ দিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী
এনসিপির জেলা-উপজেলা কমিটির আহ্বায়কের ন্যূনতম বয়স হতে হবে ৪০
কুমিল্লায় বাসচাপায় অন্তঃসত্ত্বা নারী নিহত
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
কুমিল্লায় বাসচাপায় অন্তঃসত্ত্বা নারী নিহত
সাবেক গাড়ি চালককে হত্যার হুমকি দিলেন সূচি
পুঁটি মাছ কাটা নিয়ে ঝগড়া, স্ত্রীকে খুন করে থানায় আত্মসমর্পণ স্বামীর
কুমিল্লার ৪ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করল জামায়াত
কুমিল্লায় ২২ পরীক্ষার্থী বহিষ্কার; দুই পরিদর্শককে অব্যাহতি
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২