ঋতু
পরিক্রমায় পুরনো বছরের জীর্ণতা, শ্রান্তি ও ক্লান্তি ঝেড়ে মুছে চৈত্রের
শেষে বকুল ঝরানো পথে বিদায় নেয় বসন্ত। আসে নববর্ষের শুভক্ষণ পহেলা বৈশাখ-
বাঙালি জাতি সত্ত্বার স্বত:স্ফূর্ত বৈশিষ্ট মন্ডিত আনন্দঘন সম্মিলনী
উৎসব-যা আমাদের হতাশা ও নৈরাজ্য থেকে, মনের কালিমা ও চিত্তের দৈনতা থেকে
মুক্তির বারতা শোনায় জাগরনী গানের শুভ কামনায়।
"বর্ষ যায়, বর্ষ আসে, বর্ষ অতিক্রমি, পশ্চাতে পড়িয়া থাকে বিস্মৃতির মৃতবর্ষ মমী।
আবহমান
বাংলার চিরন্তন পরিবেশ প্রকৃতি ও শাশ্বত নৈসর্গিক জীবনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে
বাঙালি সংস্কৃতি। সুদীর্ঘকাল ধরে নানা রূপ-রূপান্তরের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে
কালের বিবর্তনে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সংযোগে তা হয়েছে পরিপুষ্ট।
দ্রাবিড়-অষ্ট্রিক-ভোট-ব্রহ্ম সংস্কৃতির মৌল প্রেরণায় এবং
ব্রাহ্মণ্য-বৌদ্ধ-জৈন ধর্মের প্রভাবে গড়ে উঠেছিলো- বাঙালি সংস্কৃতির
প্রাচীণ রূপ। যদিও ইতিহাসের কোন গহীন লোকে, কোন উৎস বিন্দুতে বাঙালি
সংস্কৃতির শেকড় বিস্তৃত-তার স্বচ্ছরূপ আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবুও একথা
নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এই সংস্কৃতি সুপ্রাচীন ঐতিহ্য তথা হাজার বছর ধরে
বহমান গতিময়তায় সমৃদ্ধ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ধারা।
ইতিহাস ও
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাঙালি সংস্কৃতির উৎসমূলে গ্রথিত বৈশাখের বর্ষবরণ
উৎসব বাঙালি চেতনা ও অনুপ্রাণনার মূল ভিত্তিভূমি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী
নির্বিশেষে এটি সার্বজনীন বাঙালির সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব এবং নববর্ষের
সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান বৈশাখী মেলা। গ্রাম-বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতিক
ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য বৈশাখি মেলা। মানুষের সাথে মানুষের,
শিল্পের সাথে শিল্পির, গ্রামের অবহেলিত দরিদ্র কামার, কুমোর তাতি,
কাঠমিস্ত্রি ও বাশ-বেতের কারিগরের উৎপাদিত পন্যের সাথে ক্রেতার এক অপূর্ব
মেল-বন্ধন তৈরী হয়। হস্ত ও কুটির শিল্প ও রকমারি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর
সমাবেশের মাধ্যমে মেলা হয়ে উঠে উপেক্ষিত গ্রামের মানুষদের আর্থ-সামাজিক
জীবনের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র। পশরা বেচাকেনার লক্ষ্যে গ্রামের সুপ্ত
প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয় নানারকম নকশা-কারু কাজ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে
থাকা লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান বৈচিত্র্যে পূর্ণতা পায় গ্রামীন জনপদ।
প্রথমত: যাতায়াত ব্যবস্থা ও আর্থিক কারণে, দ্বিতীয়ত: দূরত্ব
এবং
সময়োপযোগি যোগাযোগ সীমাবদ্ধতার কারণে গ্রামীন জনপদের কৃষক-শ্রমিক,
পেশাজীবি এমন কি মধ্যবিত্ত শ্রেনীর লোকজন ও জেলা শহরে বা মহকুমা সদরে
সচরাচর যেতে পারত না। সেজন্য বৈশাখের আয়োজনে বছরের শুরুতে যার যার চাহিদা
মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং শখের সওদা মেলার মাধ্যমে ঘরের কাছে সাধ্যমতো
সহজলভ্য হতো বিধায় মেলার অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা জনগনের চাহিদা মেটাতো।
সম্ভবত: ছোট আকারের মেলাকে বলা হতো গাছতল যেমন, অর্জুনা গাছতল, সাধুর গাছতল
ইত্যাদি। বড় আকারের মেলা-যেমন ময়নামতির মেলা-কসবার মেলা ইত্যাদি এক সময়ের
উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত মেলা। জন শ্রুতি আছে মেলার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ খড়গ দিয়ে
এক কোপে পাঁঠা বলি দিয়ে মেলার সূচনা করা হতো। কৃষিপ্রধান গ্রাম বাংলার
প্রত্যন্ত অঞ্চলে পায়ে চলা মেঠোপথে কৃষক জনগোষ্ঠির অত্যাবশ্যকীয় ব্যবহার্য
সামগ্রী নিয়ে বৈশাখের প্রথম প্রহর থেকেই মেলার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাত ক্ষুদে
দোকানিরা। কৃষি ও লোক শিল্প সামগ্রী- যেমন লাঙ্গল, মই, খুস্তি-কুড়াল কান্তে
থেকে শুরু করে ঘরকন্নার সামগ্রী আলমারী সিন্দুক এমন কি শিমুল তুলা পর্যন্ত
সবকিছুই পাওয়া যেতো এই মেলায়। ফুল তোলা রুমাল, হাতপাখা, নকশী কাঁথা,
হুক্কা খড়ম, শীতল পাটি, তাল পাতা ও বাঁশ-বেতের তৈরী আসবাব পত্র ও গৃহস্থালী
সামগ্রী এই বৈশাখী মেলা উপলক্ষে বেচাকেনা হতো। শিশু কিশোরদের বহু আকাঙ্খিত
মেলার আকর্ষণীয় বস্তু ছিলো আমকাটার ছুরি, বাঁশি, টেমটেমি, ফুট কলুইয়া,
বুটভাজি, কাঁঠালকুশি, কাঠের ঘোড়া, খেলনা ঘড়ি, মেয়েদের চুড়ি-কাঁচ, ফিতে
ক্লিপ সেফটি পিন পায়ের মল/ঘুংগুর ইত্যাদি। এর জন্যে সারা বছর ঘরের বাঁশের
খুঁটিতে ছিদ্র করে এক পয়সা-দু পয়সা করে জমানো পুঁজি এবং মেলার সময় আবদার
করা গুরুজনের দেয়া সিকি আধুলি বা টাকাই ছিলো একমাত্র সম্বল। উৎসবের আমেজে
ট্রাল্কে, পোর্টম্যান্টে অথবা আলমারিতে ভাঁজ করে রাখা -তোলা জামা কাপড় পড়ে
তেল চট চটে চুল আঁচড়ে আকর্ষনায় ছিলো কালুর দোকানের ছানা আমির্তি বা জিলিপি,
দাউদকান্দির বাঙ্গি, তরমুজ, রামচন্দ্রপুরের তাঁতের তৈরী লুঙ্গি গামছা শাড়ি
কাপড় ইত্যাদি। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের গভীর অব্দি কৌতুহলি আগ্রহী যুবাদের
ময়ুর কুমীর -বাঘ ঘোড়ার চরকী ঘুরানো ভাগ্যের খেলা আর চামড়া দিয়ে তৈরী ডাব্বা
দিয়ে পিটানো হরতন রুইতন-চিরতন ও মটকার জুয়া খেলা। কোনোটিতে আবার বহুদূর
থেকে আসা চড়কগাছের (নাগরদোলা) খেলা বাচ্চাদের জন্য লোভনীয় এবং আনন্দদায়ক
হতো। গ্রামের কবিয়াল গ্রাম জনপদের কোনো উল্লেখ যোগ্য আলোড়িত ও বহুল আলোচিত
প্রেমকাহিনী খুন ডাকাতির লোমহর্ষক ঘটনা নিয়ে পয়ার ছন্দে লেখা কবিতা সুর করে
গেয়ে দর্শক শ্রোতার মনোরঞ্জন করতো আর এক আনা-দু-আনায় কবিতার চটি বই বিক্রি
হতো। দুপুরে উন্মুক্ত মাঠে ষাঁড়ের লড়াই আর পড়ন্ত বিকেলে ঘুড়ি উড়ানো ও
সন্ধায় পুঁথি পাঠেব আসর জমতো। গ্রামের যুবকদের মধ্যে লাঠিখেলা, কুস্তি এবং
ঘাটু নাচানোর (কমবয়সী সুন্দর ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে) পাশাপাশি কবিগানের আসর
(খেউড়, টপ্পা-পাঁচালি) বসতো। চৈত্রের তাপদাহে নিদাঘদগ্ধ গ্রামবাঙলার
ছেলেবুড়ো দল বেঁধে তখন বৃষ্টির কামনায় খালি কলসি নিয়ে পানি মাঙ্গার গীত
গেয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি মা-চাচি, বোন বৌদি সবার ঘরে ঘরে মহড়া দিত। পল্লীবধু ও
গৃহস্থতনয়া বাইরে উঠানে অপেক্ষমান ছেলে-যুবাদের সমন্ববে গাওয়া-ওরা (ঝুড়ি)
ভরা খই, সিক্যা ভরা দই, রামরাজার মা মরছে পানি পামু কই-। কালা হাজে (মেঘ)
ধলা হাজে এক সুন্দর ভাই, আল্লা মেঘ (বৃষ্টি) দে ঘরে ভিজ্যা যাই- গীতে সাড়া
দিয়ে ঘরের কলসি থেকে দরজার পৈঠায় দাড়িয়ে পানি ঢেলে সকলকে ভাসিয়ে দিত। আর
সকলে মিলে উঠানের কাদা জলে গড়াগড়ি খেয়ে বৃষ্টির জলে ভেজার আনন্দে মেতে
উঠত।
নববর্ষের আগমন উপলক্ষে চৈত্রের শেষে ব্যবসায়ী ও দোকানিদের মাঝে
ধুম লেগে যায় শুভ হালখাতা অনুষ্ঠানের আলোকমালা ও সুগন্ধি (ধূপ, আগরবাতি)
দিয়ে সাজানো অনুষ্ঠানে অভ্যাগতদের মিষ্টান্ন- ভোজের আপ্যায়নে প্রীতিময়
অতিথি সেবা চলে। দোকানি বড় থালা সাজিয়ে নতুন খাতা খুলে বসেন। আগত
ক্রেতা-সাধারণ (নিমন্ত্রিত) বিদায়ী বছরের বকেয়া পরিশোধ এবং নতুন বছরের
যাত্রা উপলক্ষে সেই থালায় কিছু টাকা রেখে হালখাতার সম্মান রক্ষা করেন। এ
ভাবে ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্কের নবায়ন ঘটে শুভ হালখাতা
অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সেকালে কাঁচা টাকার প্রচলন ছিল বিধায় সারা বছর হাতে
টাকা থাকবে এবং ঘরে টাকা আসবে এই বিশ্বাসে বছরের প্রথম দিনে পুকুরে জাল
ফেলে আঁশ-অলা মাছ বিশেষ করে কাতল, রুই, প্রভৃতি মাছ ধরে খাওয়ার প্রচলন
ছিলো। অবশ্য অবস্থাপন্নরা মাছের মেলা (কুমিল্লা টাউন হল) থেকে কিনে নিত
ঘটাকরে। পাঁচন বা ব্যঞ্জন অথবা পাঁচমিশালি তারকারি বা লাবড়া, কলাগাছের
বগুলি/কাঞ্জল, গাইট্যা কাঁঠালের ইঁচর, মিঠ কুমড়ো, পেঁপে, কাঁচাকলা ইত্যাদি)
পাক করে পল্লী বালার দল পুকুর ঘাটে গোসলে যেত। কাঁচা হলুদ বাটা আর সোঁদা
মেথি গায়ে মাথায় ঘসে মেজে চান গোসল সারা হতো। যদিও বাংলার নিবিড় পাল্লীতে
আজও এগুলোর কিছু প্রচলন আছে বা চলছে।
কালের বিবর্তনে আকাশ- সংস্কৃতির
আগ্রাসনে ও বৈশ্বিক সভ্যতার বাহ্যিক আকর্ষণে আজ বাঙালির সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও
সংস্কৃতি শুধুই স্মৃতি, ধুলিমলিন বিস্মৃত ইতিহাস। বর্তমানে নাগরিক সভ্যতা
নতুন ভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহবে খুবই আড়ম্বর পূর্ণ
জাঁক জমকে বর্ষবরণ করে আসছে প্রতি বছর ইতিহাসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। কারন
আজও বর্ষবরণ উৎসব জীবন সংগ্রামে কর্মক্লান্ত শ্রান্ত বাঙালির জীবনে আনে
বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অন্যান্য উৎসব
ব্যক্তিগত পুন্যসঞ্চয় এবং পাওয়া না পাওয়ার মাঝে সীমিত থাকে। পক্ষান্তরে
বৈশাখের সার্বজনীন বর্ষবরণ উৎসবের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় বাঙালির উদার
মানসিকতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রাতি ও সমন্বয়ধর্মী আদর্শ। এই উৎসব অনুষ্ঠানের
মধ্য দিয়েই উদ্ভাসিত হয় বাঙালির ঐতিহ্য চেতনার প্রাণস্পন্দন ও জাতীয়
সংস্কৃতির উন্মেষ। আর সেই চেতনাই মনুষ্যত্ববোধের প্রীতিময় বন্ধনকে আরও
দৃঢ়তর করে। ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে আমরা উদ্বুদ্ধ হই বৃহত্তর
জীবনবোধ ও সমষ্টি চেতনায়- যা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে সাংস্কৃতিক
রাষ্ট্রজাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ রাখতে শক্তি যোগায় যারা ধর্ম বর্ণ গোত্র
আঞ্চলিকতা বা সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায় আমাদের আচ্ছন্ন করতে চায়, তাদের
অপচেষ্টার বিরূদ্ধে বাংলা নববর্ষের সূচনায় বৈশাখের রমনার বটমূলে ছায়ানটের
বর্ষবরণ উৎসব আমাদের চেতনার অগ্নিমমাল। বৈশাখ মূলত: সকল মানুষের শুভ কামনায়
মানবস্বীকৃতি বাঙালি সত্ত্বার সার্বজনীন রূপ। নববর্ষের আনন্দলোকে অবগাহন
করে আমরা নতুন দিনের সূর্যকে, চারপাশের প্রকৃতিকে নব আশা-উদ্দীপনার মধ্য
দিয়ে চেনা অচেনা সব মানুষকে আপন করে নিতে পারি। “ছায়ানটের” আদর্শে উদ্বুদ্ধ
হয়ে সারােেদশর মতো কুমিল্লায়ও পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে দল,
মত শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সকল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠিসমূহ বৈশাখে অবগাহন করে
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারা বহন করে চলেছে দুর্বার গতিতে। কবি গুরুর সেই অমোঘ
বাণীর সাথে আমরা একাত্ম হয়ে আমরা গেয়ে উঠি এসো হে বৈশাখ এসো এসো।
তাপস নিশ্বাসবায়ে, মুমুর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা..........
মায়ার কুঞ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।