ছয়
হাজার কিলোমিটার দূরের এক ভূখণ্ডের নাম গাজা। এই অবরুদ্ধ এই জনপদে প্রায়
২৩ লাখ মানুষের বসবাস, যাদের ওপর চলছে নির্বিচার বিমান হামলা। বিশ্বের
সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের একটি গাজার ওপর ইজরাইল নামক রাষ্ট্র বছরের পর
বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছে একপাক্ষিক যুদ্ধ, যাকে সরাসরি গণহত্যা বলাই যথার্থ।
এই
বর্বরতার প্রতিবাদে মার্চ ফর গাজা। অসাধারণ একটা ঘটনা ঘটে গেল ঢাকায়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং তার চারপাশজুড়ে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ। হাতে
ফিলিস্তিনের পতাকা। লাখ লাখ কণ্ঠে গগনবিদারী সেই স্লোগান, নারায়ে তাকবির,
আল্লাহু আকবার। সম্মিলিত কণ্ঠে বিশ্ববাসীকে তারা জানিয়ে দিল স্বাধীন করো
ফিলিস্তিন।
১২ এপ্রিল দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় সমুজ্জ্বল হয়ে
থাকবে চিরকাল। কারণ ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের জন্য এত বড় সমাবেশ আর
কখনোই বাংলাদেশে হয়নি। অতীতে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে ছোট ছোট প্রতিবাদ
সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে। কিন্তু সব দল-মত ভেদাভেদ ভুলে একই মঞ্চে একই
স্রোতোধারায় একাকার হয়ে এমন ঐক্যের দৃষ্টান্ত আর কখনো দেখা যায়নি।
প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশের উদ্যোগে গাজায় ইজরাইলে
গণহত্যার বিরুদ্ধে এই মহাসমাবেশ একদিকে যেমন জাতীয় ঐক্যের প্রতিফলন
ঘটিয়েছে: তেমনি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের দৃঢ় চেতনার বহিঃপ্রকাশও বটে।
সাধারণ মানুষ এটা জানিয়ে দিয়ে গেল, শুধু ফিলিস্তিন নয়, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের
বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যেকোনো অপশক্তিকে রুখে দিতে তারা সদা প্রস্তুত ও
ঐক্যবদ্ধ। মার্চ ফর গাজার' সেই ঐতিহাসিক সমাবেশেও তরুণদের সরব উপস্থিতি
নগরবাসীকে বিমোহিত করেছে। এই প্রথম একটি মহাসমাবেশে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি
দেশের বিখ্যাত আলেম ও পত্রিকার সম্পাদকদের উপস্থিতি জাতীয় ঐকমত্য
প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনন্য একটা দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে আমার
দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান গাজায় ইজরাইলে গণহত্যার বিরুদ্ধে তার অবস্থান
জানান দিয়ে এটা প্রমাণ করেছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সব মানুষের
সমান অধিকার।
নিউইয়র্ক থেকে ঢাকা, লন্ডন থেকে ফিলিপাইন বিশ্ব জুড়ে
মানুষ রাস্তায় নামছে, স্লোগান দিচ্ছে ফ্রম দা রিভার টু দা সি,
প্যালেস্টাইন উইল বি ফি, ফি্রঁ ফি্রঁ ফিলিস্তিন, স্টপ জেনোসাইড ইন গাজা,
কিংবা ইজরাইল ইজ এ টেররিস্ট স্টেট, ওয়ান টু থ্রি ফোর, ইজরাইল ইজ নো মোর।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এসব করে আদো কী হবে? গাজা কি
মুক্ত হবে? শুধু কণ্ঠস্বর কি পরিস্থিতি বদলাতে পারবে? ইতিহাস বলে কখনো কখনো
একটি কণ্ঠস্বরই হয়ে উঠেছে পরিবর্তনের সূচনা।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে
রাষ্ট্রগুলো সব সময় জনমতকে আমলে না নিলেও, উপেক্ষা করেও থাকতে পারে না।
৯০এর দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জনমতের চাপেই গড়ে উঠেছিল
বিশ্ব আন্দোলন, যার প্রভাবেই অবশেষে বদল যায় শাসনব্যবস্থা। তখনো পশ্চিমা
রাষ্ট্রগুলো অনেকাংশে নীরব ছিল। কিন্তু ক্রমাগত প্রতিবাদ, অর্থনৈতিক বয়কট,
ছাত্র আন্দোলন-সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করে। আজও গাজার বিষয়ে অনেক
পশ্চিমা রাষ্ট্র নীরব, পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু একই সঙ্গে
লক্ষণীয়-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বয়কট মুভমেন্টে নামছেন, পত্রিকায় লেখা
ছাপা হচ্ছে ইজরাইলের বিরুদ্ধে, ইজরাইলকে সামরিক সহায়তা বন্ধের দাবি উঠছে
বিভিন্ন সংসদে।
বস্তুত, এসবের মূলশক্তি হিসেবে কাজ করছে ঐ
কণ্ঠস্বরগুলোই। গাজা কোথায়? ইসরাইল কেন হামলা করছে? ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কি
এখনো আছে? এ ধরনের হাজারো প্রশ্ন আজও শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে। কারণ,
গণমাধ্যম অনেক সময় দ্বিমুখী অবস্থান নেয়। ঠিক এখানেই কাজ করে জনতার
কণ্ঠস্বর। মার্চ ফর গাজা কেবল এটি বড় প্রতিবাদ। এই মিছিল, প্ল্যাকার্ড,
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টগুলোই নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে সত্য
জানার, সত্য অনুধাবনের এবং সত্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার। আর এভাবেই গড়ে
উঠবে আগামীর নেতৃত্ব।
গাজার জন্য পদযাত্রা, পোস্টার, ফেস্টুন হয়তো
তৎক্ষণাৎ ইসরাইলি ড্রোন থামাবে না, কিন্তু এটি ইতিহাসে স্থান করে
নেবে-মানুষ একদিন বলতে পারবে, আমরা নীরব ছিলাম না। ইসরাইলের প্রতিটি হামলা
যেমন গাজার আকাশে আগুন ছড়ায়, তেমনি সেখানে জন্ম নেয় অসহায়ত্ব ও
বিচ্ছিন্নতার বোধ। এই অবস্থায় বিশ্ব জুড়ে মানুষ যখন গাজার পক্ষে রাস্তায়
দাঁড়ায়, তখন সেই বিচ্ছিন্ন জনপদের মানুষেরা অনুভব করে- 'তারা একা নয়'। এই
আত্মিক সংহতি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে যুগের পর যুগ।
গাজার
পক্ষে মিছিল করা কি কেবলই আমাদের দায়, নাকি আমাদের মানবিক দায়িত্ব? আমরা
যদি গাজায় চলমান নৃশংসতা, বর্বরতা দেখেও চুপ থাকি, আজ যদি গাজার পক্ষে
আওয়াজ না তুলি, তাহলে কাল যখন নতুন কোনো অন্যায়, অবিচারের ঘটনা ঘটবে, তখনো
কি আমরা চুপ থাকব? আরো স্পষ্ট করে বললে, যদি আপনার সঙ্গে এমন ট্র্যাজেডি
ঘটে, তখনো কি মুখে তালা দিয়ে বসে থাকতে পারবেন?
প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাও, কুমিল্লা।