মুসলিম
সমাজসহ সব সমাজেই ঘৃণিত ও নিন্দিত একটি পাপ আত্মহত্যা। ক্ষণিকের কষ্ট থেকে
স্বস্তি পেতে কিছু মানুষ এই ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, বিনিময়ে তারা
আলিঙ্গন করে চিরস্থায়ী যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিকে। ইসলামে যাকে স্পষ্টভাবে
হারাম ঘোষণা করা হয়েছে; বরং ইসলাম আত্মহত্যাকে জঘন্যতম গুনাহ হিসেবে
বিবেচনা করে, কারণ এটি সেই জীবনকে ধ্বংস করার নামান্তর, যা আল্লাহ মানুষকে
দান করেছেন এবং সংরক্ষণের আদেশ দিয়েছেন। অতএব, আত্মহত্যাকারী তার আত্মা ও
দেহের ওপর অন্যায় করছে, যেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ তার ওপর
অর্পণ করেছিলেন।
এমন ব্যক্তি মূলত নিজের ওপরই জুলুম করছে।
পবিত্র
কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তোমরা নিজেরা নিজেদের হত্যা কোরো না।
নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু। আর যে কেউ সীমা অতিক্রম করে
অথবা জুলুমের বশবর্তী হয়ে এ কাজ করে, ফলত নিশ্চয়ই আমি তাকে জাহান্নামে
নিক্ষেপ করব এবং আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজসাধ্য।’ (সুরা : নিসা, আয়াত :
২৯-৩০)
পবিত্র কোরআনের দ্বারা বোঝা যায় যে ইসলাম আত্মহত্যাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। নিম্নে আত্মহত্যার কিছু কুফল তুলে ধরা হলো-
জাহান্নামে
চিরস্থায়ী হওয়া : কখনো কখনো প্রিয় মানুষের দেওয়া আঘাত, ধোঁকা, অবহেলা
ইত্যাদি মানুষকে ভীষণ কষ্ট দেয়, কিন্তু এটা সাময়িক। সময়ের ব্যবধানে মানুষ
এসব কষ্ট ভুলে যায়। পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে যায়।
কিন্তু এই সাময়িক কষ্ট
থেকে পালাতে যারা আত্মহত্যার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, তারা চিরস্থায়ী
নিদারুণ কষ্টের দিকে নিজেকে ঠেলে দেয়। যে কষ্ট দুনিয়ার কষ্ট থেকে বহুগুণ
যন্ত্রণাদায়ক, যে কষ্ট কখনো লাঘব হওয়ার নয়। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু
হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, লৌহ অস্ত্রের
মাধ্যমে যে লোক আত্মহত্যা করবে, সে ওই অস্ত্র হাতে নিয়ে কিয়ামত দিবসে হাজির
হবে। জাহান্নামে সে এটা সর্বদাই তার পেটের মধ্যে বিদ্ধ করতে থাকবে এবং
অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। যে লোক বিষপানে আত্মহত্যা করবে, সে ওই বিষ হাতে
নিয়ে কিয়ামত দিবসে হাজির হবে জাহান্নামে।
সে ওটা সর্বদা পান করতে থাকবে
এবং অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে যে লোক
আত্মহত্যা করবে, সে সর্বদাই জাহান্নামের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে থাকবে এবং
চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। (তিরমিজি, হাদিস : ২০৪৪)
এই হাদিস স্পষ্টভাবে
জানিয়ে দেয়, আত্মহত্যাকারী জাহান্নামে চিরকাল থাকবে এবং যে পদ্ধতিতে সে
নিজেকে হত্যা করেছে, সেই একই পদ্ধতিতে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।
নাউজুবিল্লাহ।
জান্নাত হারাম হয়ে যাওয়া : হাসান বসরি (রহ.) জুনদুব ইবনে
আবদুল্লাহ (রা.) সূত্রে বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের পূর্ব
যুগে জনৈক ব্যক্তি আঘাত পেয়েছিল, তাতে সে কাতর হয়ে পড়েছিল। অতঃপর সে একটি
ছুরি হাতে নিল এবং তা দিয়ে সে তার হাতটি কেটে ফেলল। ফলে রক্ত আর বন্ধ হলো
না। শেষ পর্যন্ত সে মারা গেল। মহান আল্লাহ বলেন, আমার বান্দাটি নিজেই প্রাণ
দেওয়ার ব্যাপারে আমার থেকে অগ্রগামী হলো। কাজেই আমি তার ওপর জান্নাত হারাম
করে দিলাম। (তিরমিজি, হাদিস : বুখারি, হাদিস : ৩৪৬৩)
এই হাদিসে মূলত
আত্মহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে, যা মানুষকে জান্নাত থেকে বঞ্চিত করতে
পারে। কারণ এই কাজ সীমা লঙ্ঘনের চূড়ান্ত মাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়।
নবীজি
(সা.) আত্মহত্যাকারীর জানাজায় অংশ নেননি : রাসুলুল্লাহ (সা.)
আত্মহত্যাকারীর জানাজা নামাজ আদায় করেননি। এটি তিনি একটি বার্তা হিসেবে
দিয়েছেন, যাতে মানুষ এই ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত থাকে। তবে তিনি অন্যদের জানাজা
পড়তে নিষেধ করেননি। জাবির ইবনে সামুরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী
(সা.)-এর কাছে জনৈক ব্যক্তির লাশ উপস্থিত করা হলো। সে চ্যাপ্টা তীরের
আঘাতে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু রাসুল (সা.) তার জানাজার নামাজ আদায় করেননি।
(মুসলিম, হাদিস : ২১৫২)
হাদিস থেকে বোঝা যায়, যদিও নবী (সা.) নিজে
জানাজায় অংশ নেননি, তবে সাহাবিদের জানাজা আদায়ে নিষেধও করেননি। এতে বোঝা
যায়, আত্মহত্যাকারী ইসলামের বাইরে নয়, বরং সে এক গুরুতর গুনাহ করেছে।
এ
বিষয়ে ইমাম মালিক, আবু হানিফা, শাফেয়ি, হাসান বসরি, কাতাদা, নাখঈ এবং বেশির
ভাগ আলেম একমত, আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়া জায়েজ। তবে বিজ্ঞ আলেমদের মতে,
সমাজের নেতৃস্থানীয় আলেমদের আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়া থেকে বিরত থাকা
উচিত, যাতে মানুষ আত্মহত্যার মতো গর্হিত কাজ সম্পর্কে সচেতন হয়।
আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগলে করণীয়
আল্লাহর
সাহায্য চাওয়া : সাধারণত আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগলে, নিজেকে অসহায় ভাবলে,
নিজের সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান খুঁজে না পেলে, কিন্তু আল্লাহ যদি কারো সহায়
হোন, তার আবার কিসের ভয়? তাই এমন উদ্ভট ইচ্ছা জাগলে মুমিনের উচিত আল্লাহর
ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে ধৈর্য সহকারে তাঁর সাহায্য চাওয়া। পবিত্র কোরআনে মহান
আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য
চাও, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত :
১৫৩)
ধৈর্য ধরা : জীবনের সাময়িক কষ্টগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে
পরীক্ষাস্বরূপ। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়,
ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের
সুসংবাদ দাও।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৫৫)
তাকওয়া অবলম্বন করা : কেননা
মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ বের
করে দেন।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ২)
আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা : কেননা
মহান আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য
যথেষ্ট। (সুরা : তালাক, আয়াত : ৩)
আত্মহত্যার শাস্তির কথা স্মরণ করা :
কারো মনে শয়তান যদি আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগায়, তার উচিত কোরআন-হাদিসে
আত্মহত্যার যেসব ভয়াবহ শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে সেগুলো স্মরণ করা।
নামাজ
ও কোরআন তিলাওয়াতে মনোযোগী হওয়া : কেননা আল্লাহর স্মরণ হৃদয়কে প্রশান্ত
করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত
হয়।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ২৮)
নির্ভরযোগ্য কারো সঙ্গে পরামর্শ করা :
মানুষ অনেক সময় এমন কিছু বিষয় নিয়ে হতাশ হয়ে ওঠে, যা তার কাছে পাহাড়সম মনে
হলেও বাস্তবে এর প্রতিকার খুব সহজ। তাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে পরিবারে কোনো
নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করা যেতে পারে, কোনো বিজ্ঞ আলেম কিংবা
মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
আল্লাহর কাছে উত্তম বিনিময় আশা
করা : দুঃখ-কষ্ট মানুষের জীবনের অংশ, যারা সব পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর ভরসা
রাখে, উত্তম বিনিময়ের আশা রাখে, মহান আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় দান করে।
হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) থেকে
বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি,
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি আসে, এমনকি যে কাঁটা তার
দেহে ফোটে, এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহলো ক্ষমা করে দেন। (বুখারি,
হাদিস : ৫৬৪১)
মহান আল্লাহ সবাইকে সুখময়, বরকতময়, আমলময় ও সম্মানজনক
জীবন দান করুন। সব পরিস্থিতিতে একমাত্র তাঁর ওপর ভরসা করার তাওফিক দান
করুন। আমিন।