কুমিল্লার
লাকসামে শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) উপমহাদেশের একমাত্র মহিলা নবাব নারী শিক্ষার
অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেছা জমিদার বাড়ি জাদুঘরের আরো তিনটি গ্যালারি ও অন্দর
মহল উদ্বোধন করা হয়েছে।
ওইদিন বিকেলে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার
(ইউএনও) কাউছার হামিদের সভাপতিত্বে এ উপলক্ষে আয়োজিত উদ্বোধন অনুষ্ঠানে
বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো সাইফুল ইসলাম,জাতীয়
জাদুঘরের সচিব সাদেকুল ইসলাম। এ সময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক
নুতন সময় পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক ও জাদুঘরের সমন্বয়কারী এম এস
দোহা,লাকসাম নবাববাড়ি জাদুঘর ইনচার্জ মো আনোয়ার হোসেন, নবাব ফয়জুন্নেছা
চৌধুরাণীর বংশধর ও এস্টেট'র মোতয়াল্লী সৈয়দ মো. মাসুদুল হক চৌধুরী, তাঁর
অনুজ সৈয়দ কামরুল হক চৌধুরী, লাকসাম প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মো. আবদুল
কুদ্দুস, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলালসহ সামাজিক
সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের ব্যক্তিবর্গ।
উদ্বোধনকৃত নতুন ৩টি গ্যালারীতে
নবাব ফয়জুন্নেছার স্মৃতিবিজড়িত ১২৫টি নতুন নিদর্শন স্থান পায়। এ সময়
অতিথিশালা 'সমন' উম্মুক্ত করা হয় করা হয়। যাতে করে নবাব পরিবারের সদস্যরা
ওই অতিথিশালায় বিনা ভাড়ায় কমপক্ষে তিনদিন পর্যন্ত অবস্থান করতে পারবেন।
পর্যটকদের
জন্য সরকারি ফি পরিশোধ সাপেক্ষে অবস্থানের সুবিধা রাখা হবে। সেই সাথে
শীঘ্রই নবাব ফয়জুন্নেছা হাউজের দ্বিতীয় তালায় গ্যালারী সংযুক্ত করার
পদক্ষেপে গ্রহণের বিষয়টি জানানো হয়।
উল্লেখ্য, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী
১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁয়ে
জন্ম গ্রহন করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার জমিদারি তিনি লাভ করেন। তিনি
প্রজাহিতৈষী জমিদার ছিলেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি কুমিল্লায় নারী শিক্ষা
প্রসারে একটি প্রাথমিক এবং একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এ ছাড়াও
তাঁর জমিদারী এলাকার ১৪টি মৌজায় ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক
বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের
কৃষ্ণনগরেও নারী শিক্ষার প্রসারে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
লাকসামের
পশ্চিমগাঁয়ে নবাব ফয়জুন্নেছার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি অষ্টাদশ শতাব্দীর
মধ্যভাগে নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। একুশে পদকপ্রাপ্ত (মরণোত্তর)
মহিয়সী নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী শিক্ষা বিস্তারে অত্যন্ত তাৎপর্য ও
গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
নবাব
ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী বিগত ১২৯৮ বঙ্গাব্দ ৩০জ্যৈষ্ঠ তারিখে ওয়াকফ দলিলে
জমিদার বাড়িটি ওয়াকফ লিল্লাহ করেন। উক্ত ওয়াকফ এস্টেটটি বিগত ১৯৩৫
খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর তারিখে পাবলিক/ লিল্লাহ সম্পদ হিসেবে ই.সি.নং
৫৪৮ নথিতে বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের তালিকাভুক্ত একটি ওয়াকফ এস্টেট।
ওয়াকফ
দলিলে মোট জমির পরিমাণ ২১ ৬২৫.২৮ একর। তারমধ্যে ২১৩২৭.৯১ একর প্রজাবিলি
সম্পদ।খাস ও নিজ দখলীয় ওয়াকফ সম্পদের পরিমাণ ২৯৭.৩৭ একর। আরএস খতিয়ানে এই
জায়গার সঠিক পরমান জানা যায়নি। বিএস খতিয়ানে জায়গার পরিমান কমে প্রায়
১০একরে দাঁড়িয়েছে।
ওয়াকফ দলিলে শর্ত হিসেবে মোতাওয়াল্লীর জবাবদিহিতা,
ধর্মীয় ও জনকন্যালমুলক কর্ম সম্পাদন বিষটি গুরুত্ব পায়। মসজিদ, মাদরাসার,
এতিমখানা, মুসাফিরখানা,লিল্লাহ বোডিং পরচালনার কথা বলা হয়েছে। এজন্য
মোতাওয়াল্লীর জন্য মাসিক বেতন বা সন্মানীও নির্ধারন করা হয়।
অভিযোগ
রয়েছে, নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর ওয়াকফ রাহে লিল্লাহ দলিলের অধিকাংশ
সম্পদ মোতয়াল্লীদের কারসাজিতে বেহাত হয়ে গেছে। কখনো মোতয়াল্লী ওয়াকফ দলিল
গোপন করে মালিক সেজে বিক্রি করেছেন। আবার কখনো অন্যকে মোতয়াল্লী বানিয়ে
নিজেই ওয়াকফ সম্পদের মালিক হয়েছেন। মুলত; এসব কারনে হারাতে বসেছিলো
পশ্চিমগাও নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর বাড়ির স্হাবর-অস্হাবর সম্পদ। বাড়ির
অনেক দরজা জানালাও উধাও হয়ে গেছে।
নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর
স্মৃতিবিজড়িত নবাব বাড়িটি একটি মিউজিয়াম করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক,
সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ দাবি করে আসছেন। অবশেষে
বাধ্য হয়ে সরকার ২০১৭ সালে গেজেটের মাধ্যমে নবাব ফয়জুন্নেছা এ বাড়ির ৪.৫৫
একর জায়গা প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করেন।
দীর্ঘদিন বিভিন্ন
জটিলতার কারণে সংস্কার, অযত্ন ও অবহেলার কারনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে
পৌঁছে নবাব একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ফয়জুন্নেছার স্মৃতিবিজড়িত
পশ্চিমগাঁয়ের জমিদার বাড়িটিসহ বেদখল হয়ে গেছে ওয়াকফ এস্টেটের অনেক
সম্পত্তি। লুটপাট হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ও মুল্যবান নিদর্শন। ধীরে ধীরে বাড়ির
ইট বালু খুলে নেওয়ারও প্রস্তুতি চলছিলো।
সূত্র আরো জানায়, তৎকালীন
সাংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে.এম.খালিদ ২০২৩ সালের ২জুন নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি
পরির্দশন করেন এবং যাদুঘর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে একই বছরের ২৮
আগস্ট সাংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের ১৩৯.২০-৩৭০ স্মারকে জাতীয় জাদুঘরের শাখা
চালুর সিদ্ধান্তের আলোকে ২০ সেপ্টেম্বর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাথে জাতীয়
জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই বছরের গত ৬ নভেম্বর
আনুষ্ঠানিক ভাবে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর এ বাড়িটি জাতীয় জাদুঘরের শাখা
হিসেবে উদ্বোধন করা হয়। এ সময় তৎকালীন স্হানীয় সরকার মন্ত্রী, সাংস্কৃতি
মন্ত্রনালয়ের সচিব ও ওয়াকফ প্রশাসকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উর্ধতন
কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনকৃত জাদুঘরের ৩টি গ্যালারীতে ২০টাকা দর্শনার্থী ফি'র বিনিময়ে প্রদর্শিত হয়ে আসছে।
সর্বশেষ
গত বছরের ২৭মে নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণীর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে জাদুঘর
পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসন ও জাতীয় জাদুঘরের মধ্যে সমঝোতা
স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এতে ওয়াকফ প্রশাসনের ক্ষমতা অটুট রেখে জাদুঘর
পরিচালনা সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। শর্ত থাকে, জাদুঘরে
দর্শনার্থী ফি'র ৫% প্রদান এবং ওয়াকফ এস্টেটের বার্ষিক চাঁদা পরিশোধ জাতীয়
জাদুঘর করবে। মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন'র বেতন ভাতা জাতীয় জাদুঘর পরিশোধ
করবেন।