দেশের
শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী এবং তা হতে হবে সময়ের সঙ্গে
সংগতিপূর্ণ। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম কতগুলো বিষয়ে অবশ্যই পড়ালেখা
করতে হবে। একই সঙ্গে প্রত্যেক শ্রেণির ক্ষেত্রে পড়ালেখার পাশাপাশি দক্ষতা
নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাক্রমে কোনো বিভাজন থাকা উচিত নয়। বিজ্ঞান, মানবিক,
বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাজন করেই শিক্ষার্থীদের আমরা আরেকটি জালের ভেতর ফেলে
দিয়েছি। আজকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মানবিকে যায় না। মানবিকের
শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের ধারে কাছে যেতে চায় না। আমি মনে করি, বিভাজনের কোনো
দরকার নেই। শিক্ষাক্রম বিশ্বব্যাপী চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। মানুষের চাহিদা
এবং যুগের প্রয়োজনে এটি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা উচিত।
একই সঙ্গে আমি
মনে করি, পরিবার থেকে শিক্ষার্থীদের বিকাশ শুরু করতে হবে। মা-বাবাকে তার
সন্তানদের দিকে নজর দিতে হবে। সেই নজর দেওয়া বলতে তাদের মেধা সুস্থভাবে
বিকাশ হচ্ছে কি না প্রথমেই সেদিকটা দেখতে হবে। তার পরের দায়িত্ব বর্তায়
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। আমাদের দেশে শিক্ষকরা শিক্ষাদানে যথেষ্ট পরিমাণে
দক্ষ নয়। বিশ্বমানের শিক্ষার্থী তৈরি করতে শিক্ষকদের দক্ষ করে তৈরি করা
দরকার। আমরা দেখেছি শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেও শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণের
বাস্তবায়ন করেননি। এই হলো শ্রেণিকক্ষের ভেতরে শিক্ষকদের দক্ষতার প্রমাণ।
পুঁথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের সরে আসতে হবে। আমরা যদি
পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারি, তাহলে আমাদের বাচ্চারা আরও পিছিয়ে
যাবে।
আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার হয়নি। বরঞ্চ
দিনের পর দিন একইভাবে চলতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা
সৃষ্টি হয়েছে। সোজা কথায়, ক্রমপরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে আমরা বদলাইনি।
ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে পাঠ না দিয়ে, পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া
হয়েছে। কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাইড বইনির্ভর একটি
সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। যেটি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। পৃথিবীর বহু
উন্নত দেশ আছে যেখানে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীর মান নির্ধারণ হয় না কিংবা
দক্ষতা যাচাই হয় না। শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের মধ্যদিয়ে
অর্থাৎ নিয়মিত মূল্যায়ন-প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে দক্ষতা যাচাই হয়। কাজেই
গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে
হবে। একই সঙ্গে সেটি হতে হবে সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে আমি
অবশ্যই মনে করি, শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ধারাকে বিরোধিতা না করে
ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সেটিকে স্বাগত জানানো উচিত।
আমরা জানি, শিক্ষার
মূল ভিত্তিটুকু গড়ে ওঠে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। কাজেই শিক্ষায়
পরিবর্তনও প্রাথমিক পর্যায় থেকে সূত্রপাত হতে হবে। সেই সময়টুকু
শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার
ভিত্তিটুকু শক্ত করতে হলে আমাদের প্রধানত তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।
দক্ষ শিক্ষক, সক্ষম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিয়মিত মনিটরিং ইত্যাদি। সে
ক্ষেত্রে যথার্থ বিনিয়োগ প্রয়োজন। এমনিতেই শিক্ষা সরঞ্জামের দাম অপেক্ষাকৃত
বেশি। এর আগে কলম উৎপাদনে ভ্যাট বসানো হয়েছিল। বিদেশি সফটওয়্যারে ৫ শতাংশ
থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে আবার ১৫ শতাংশ ভ্যাটও বসবে। এর
ফলে শিক্ষার্থীদের নানারকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। পরিবারকে শিক্ষা
সরঞ্জামগুলোর ব্যয়ভার বহনে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়।
আমাদের দেশে শিক্ষা
খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত বাজেট
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নিম্নতম। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো সেদিক থেকে অনেক
বেশি অগ্রগামী। এখন পর্যন্ত শিক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ জাতীয় আয়ের খুবই
সামান্য অংশ, যা অবশ্যই কয়েক গুণ বাড়ানো দরকার। আন্তর্জাতিক মানের
শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাস্তব বিষয়গুলো আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে
শিক্ষাব্যবস্থাপনায় আমাদের বড় বড় মেগা প্রকল্প দরকার। আমরা যদি মানবসম্পদ
বিনির্মাণে বিনিয়োগ না করি, তাহলে বড় বড় গার্মেন্টসের মতো স্ট্রাকচারগুলো
চালু করার জন্য বিদেশ থেকে আমাদের জনশক্তি আমদানি করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে
আবাসনসংকট প্রকট। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনসংকট রয়েছে। অধিকাংশ
হোস্টেলে ৬৫ শতাংশ মেয়েরা এক রুমে তিন-চারজন করে থাকে। ছেলেরা অপেক্ষাকৃত
একটু আরামেই থাকে। এই জায়গায় জেন্ডারবৈষম্য আছে বলে মনে করছি। কারিগরি
শিক্ষায় কর্মসংস্থান বাড়াতে বৈষম্য কমানোর জন্য প্রযুক্তি এবং কারিগরি
শিক্ষাকে আরও এগিয়ে নিয়ে আসা দরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা বিশেষ
প্রকল্পই আছে এটার জন্য। বিশেষ করে শিক্ষা গবেষণা উন্নয়নে আমরা সঠিক
মাত্রায় বিনিয়োগ দেখি না। বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা
না করে ঠিকাদারদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা মতানৈক্য
আগে প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ করে কত বড় সাফল্য
দেখিয়েছে। শিক্ষা গবেষণায় বিনিয়োগটা খুব দরকার বলে মনে হয়।
আমরা আশাবাদী
মানুষ। আমাদের কিছু হতাশাও আছে। আশার কথা, সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন-পরিমার্জন হচ্ছে এবং অবশ্যই তা হতে হবে।
দেশে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, নীতিনির্ধারক যারা আছেন, তারা প্রতিনিয়তই
চেষ্টা করছেন। এখনো পুরোপুরি না হলেও ইতোমধ্যে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন এসেছে।
ধীরে ধীরে সব শ্রেণিতেই সেটি সম্ভব হবে বলে আশা করি। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি এত সহজ কাজ নয় যে, চাওয়ামাত্রই সেটি দ্রুত
বাস্তবায়িত করে ফেলা সম্ভব। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সে জন্য আমাদের
সময় দিতে হবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ডিজিটাল বৈষম্য দূরীকরণের জন্য প্রযুক্তিগত কাঠামো উন্নয়ন।
এখানে
ব্যাপকভাবে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। প্রযুক্তি সবার জন্য।
বিশ্বব্যাপী নারীরা এই প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে আছে। ইউনেস্কোর রিপোর্ট
সেটা বলছে। যেখানে ছেলেদের অংশগ্রহণ ৬০ শতাংশের ওপর, সেখানে নারীদের
অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশেরও কম। নারী-পুরুষ ও ধনী-দরিদ্রের একটা বৈষম্য আমরা
দেখেছি। আমরা তরুণ প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের জন্য একটি
সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে চাই এবং সেটা অবশ্যই আমাদের করে দেখাতে হবে।
শিক্ষায় আরও মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি যারা মিথ্যাচার করে, জনমনে হতাশা ছড়ায়,
তাদের বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি
এবং আমি বিশ্বাস করি, পরিবর্তন আসবেই।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা