ছয় দফা দাবিতে সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন করছেন। প্রায় সাত মাস আগে তারা প্রথম এই আন্দোলন শুরু করেন। দ্বিতীয় দফায় গত বুধবার আবার তারা এই আন্দোলন শুরু করেছেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে তারা সড়ক অবরোধ করেছেন। পরদিন রেলপথ অবরোধের ঘোষণা দিলেও তা থেকে সরে এসে মশাল মিছিল এবং গত শুক্রবার ‘কাফন মিছিল’ করেন।
অবরোধে ঢাকার চিত্র ছিল ভয়াবহ। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে দীর্ঘ সময় যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। অধিকাংশ সড়কে তৈরি হয় তীব্র যানজট। ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় এই অবরোধ কর্মসূচি পালিত হওয়ায় সেসব এলাকার সড়ক-মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও আবার রেলওয়ে স্টেশনে অবরোধ করা হয়। সামগ্রিকভাবে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। অনেক এলাকায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে নিরলস তৎপরতা চালাতে দেখা যায়। জরুরি প্রয়োজনে যারা ঘর থেকে বাইরে এসেছিলেন, তাদের অধিকাংশই যানজটে চরম বিড়ম্বনার শিকার হন। এ রকম অবস্থায় একপর্যায়ে আন্দোলনস্থলে উপস্থিত হন শিক্ষাসচিব ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
শিক্ষা উপদেষ্টার আহ্বানে শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি শিথিল করে রেলপথ অবরোধের মতো কর্মসূচি থেকে সরে আসেন। কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে সচিবালয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা তার দেখা পাননি। এতে তারা অসন্তুষ্ট হয়ে গত বৃহস্পতিবার মশাল মিছিল এবং শুক্রবার জুমার নামাজের পর একযোগে মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। সেই সঙ্গে তারা ৬ দফা দাবি মেনে না নেওয়া হলে কঠোর কর্মসূচিরও ঘোষণা দেন। শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি হচ্ছে ২০২১ সালের বিতর্কিত নিয়োগপ্রাপ্ত ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের কারিগরি অধিদপ্তর এবং সব প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত স্থানান্তর করতে হবে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চার বছর মেয়াদি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রতি সেমিস্টার (পর্ব) পূর্ণ মেয়াদের (ছয় মাস) করতে হবে। উপসহকারী প্রকৌশলী পদে (দশম গ্রেড) ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ব্যতীত অন্য কেউ আবেদন করতে পারবেন না এবং উপসহকারী প্রকৌশলী ও সমমান পদ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে। এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সংস্কার করে কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত কোনো জনবল থাকতে পারবে না। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের বিতর্কিত নিয়োগবিধিমালা সংশোধন করে সব শূন্যপদে কারিগরি জনবল নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষকসংকট দূর করতে হবে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রস্তাবিত চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শতভাগ সিট নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা পলিটেকনিক বা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৮২টি। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান (ব্যানবেইস) অনুসারে ১ লাখ ৫ হাজারের মতো। গত পাঁচ-ছয় বছরে পাস করে বেরিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হবে নিঃসন্দেহে। এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এ সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়ায় হবে সরকারের জন্য সুবিবেচনার কাজ। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় হওয়াটা জরুরি ছিল। সাত মাস আগে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি নিয়ে রাজধানীর একাংশ অবরোধ করেন। জনজীবনে দুর্ভোগ দেখা দেয়। সরকার সে সময় তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসও দেয়। কিন্তু সাত মাস অপেক্ষার পরও তাদের দাবির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে নতুন করে গত বুধবার থেকে তারা আবার আন্দোলন শুরু করেন।
আমাদের এই এক সমস্যা। কেউ কোনো দাবি জানালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সেই দাবি সমাধানের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। সময়ক্ষেপণ করে। এতে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সাত মাস আগে উত্থাপিত দাবি সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক রকম ঘুমিয়েই ছিল। আমরা মনে করি, এখনই দাবিগুলো নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করাটা জরুরি। সেসব দাবি কতটা যৌক্তিক, বিবেচনা করে সমস্যার সমাধান করুন। সাময়িক আশ্বাস নয়, স্থায়ীভাবে সমস্যার সমাধান হওয়া প্রয়োজন। সেটা করা না গেলে, শিক্ষার্থীরা বারবার আন্দোলনে যাবেন আর জনদুর্ভোগ হতে থাকবে। আমরা আশা করব, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার সমস্যার সমাধানে ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ করবে। সাধারণ মানুষ তাহলে জনদুর্ভোগ থেকে রেহাই পাবেন।