নিজস্ব প্রতিবেদক: বছরতিনেক ধরে
দেশে ওষুধের দাম কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এখন অনেক পরিবারে মোট সংসার খরচের
প্রায় অর্ধেকই যায় ওষুধ কিনতে। অনেকে খরচ জোগাড় করতে না পেরে প্রয়োজনীয়
ওষুধ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন।
একটি পরিবারে স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৬৭
থেকে ৭০ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধ কিনতে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন অন্তর্র্বতী
সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অনেকে আশায় ছিলেন সাধারণ মানুষের চাপ কমাতে এবারে
ওষুধের দাম কমানো হবে। কিন্তু সরকারের মেয়াদ আট মাস পার হলেও এ বিষয়ে কোনো
পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। আবার বছর-বছর বাজেটের আকার বাড়লেও স্বাস্থ্য
খাতের গুরুত্ব বাড়ানো হচ্ছে না বলেও অভিযোগ বিশ্লেষকদের। ওষুধ কিনতে খরচ
বাড়ার কারণে সাধারণ আয়ের মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।
রাজধানীর মগবাজার
এলাকায় বৃদ্ধ মা, স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন বেসরকারি
চাকরিজীবী আলী আকবর। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, মাসে বেতন পাই ৫৫ হাজার টাকা।
মায়ের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগসহ রয়েছে আরও অনেক রোগ। সারা বছরই
মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে হয়। পরিবারের অন্যদের জন্যও ওষুধ লাগে। প্রতি মাসে
শুধু মায়ের ওষুধই লাগে ১৬ হাজার টাকা। ৫৫ হাজার থেকে এই ১৬ হাজার বাদ দিয়ে
বাকি ৩৯ হাজার টাকায় সংসার চালাতে হয়। বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল,
ডিশ-নেট বিল, বাজার খরচ, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ আর নিজেদের ওষুধও
প্রয়োজনে লাগে, যা বেতনের টাকায় হয় না। ধারদেনা করতে হয়।
শুধু আলী আকবরই
নন! তার মতো এমন অনেকের একই অবস্থা। ইস্কাটন এলাকার আরেক চাকরিজীবী
রোবায়েত খান জানান, তার পরিবারে তিন সদস্য। তিনজনের জন্য বাজার খরচ লাগে
মাসে ২০ হাজার টাকার। আর তার একার ওষুধ লাগে ৭ হাজার টাকার। ওষুধের দাম কম
থাকলে আমার খরচ কমত।
কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ওষুধের
খরচ বাঁচাতে ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ না খেয়ে নিজের মতো করে কমিয়ে
খাচ্ছেন। ডাক্তার তিনবেলা খাওয়ার পরামর্শ দিলেও কেউ কেউ দুবার বা একবার
খান। প্রতিদিন না খেয়ে এক দিন পর খান অনেকে। বিশেষ করে প্রেশারের ওষুধ
কয়দিন খেয়ে একটু কম বুঝলে খান না। আবার শরীর খারাপ বুঝলে খাওয়া শুরু করেন।
ওষুধের দাম বাড়ানোর কারণে অনেকে এভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন।
বাংলাদেশ
এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী প্রতি চারজনের একজন
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ (২৩.৫%) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। গ্লোবাল বারডেন অব
ডিজিজ স্টাডির (জিবিডি) গবেষণা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ
কিডনির কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ২০২৩ সালে
প্রকাশিত ডায়াবেটিস চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকায় দেওয়া তথ্যমতে, দেশে
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩১ লাখ। এসব মানুষকে
প্রতিদিনই ওষুধ খেতে হয়।
বছরতিনেক ধরে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে ওষুধের
কাঁচামাল আমদানিত খরচ বেড়েছে। আমদানি করা ওষুধের দামও আগের চেয়ে বেশি।
ন্যূনতম লাভে বিক্রি করলেও ওষুধের দাম বেশি পড়ছে। অন্যদিকে যতটা বাড়ার কথা
অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন অজুহাতে তার চেয়ে বেশি দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন।
এতে ভোক্তাকে হিসাব ছাড়া বেশি দামে ওষুধ কিনতে হচ্ছে।
ওষুধের কাঁচামাল
বেশি দামে কেনার কারণে দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ
বেড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের দাবিতে সরকার ওষুধের দাম বাড়িয়েছে।
১৯৮২
সালের ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, সরকার গেজেট
প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। অথচ এই নিয়মের তোয়াক্কা
না করে ২০২২ সালে কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়া শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোর
সুপারিশে ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয় ঔষধ
প্রশাসন। সে সময় প্যারাসিটামল এবং হৃদরোগ, ব্যথানাশক ও গ্যাস্ট্রিকের
ওষুধের দাম ৫০ থেকে ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সেই দাম বাড়ার রেশ না
কাটতেই পরের বছর আবারও ছয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ২৩৪টি জীবনরক্ষাকারী ওষুধের
দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গত বছর যেখানে ৫০টির বেশি ওষুধের
বাড়িয়েছে। কোনো কোনো ওষুধের দাম ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে
স্কয়ার ফার্মা, বিকন ফার্মা, অ্যারিস্টো ফার্মা, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল,
এসিআই, সার্ভিয়ার ফার্মা, ইউনিমেড ইউনিহেলথ ও নুভিসতা ফার্মার বিভিন্ন ওষুধ
রয়েছে। এসিআই কোম্পানির অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স ট্যাবলেটের দাম বেড়েছে ১১০
শতাংশ। অন্যান্য কোম্পানির ৮টি ওষুধের ৫০ শতাংশের বেশি, ১১টির ৩০ থেকে ৫০
শতাংশ, ২২টির ১০ থেকে ৩০ শতাংশ, ৯টির দাম বেড়েছে ৬ থেকে ১০ শতাংশ। যদিও
ওষুধ প্রশাসন বলেছে দামের সমন্বয় করা হয়েছে। এসব ওষুধের মধ্যে নাপার মতো
ওষুধও আছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, উচ্চরক্তচাপের ওষুধ রসুবা ৫
মিলিগ্রামের প্যাকেট ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। আগে এক পাতা
১০০ টাকায় বিক্রি করতাম। এখন ১২০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। এটির দাম বেড়েছে
২০ শতাংশ। রসুবা ১০ মিলিগ্রামের বক্স ৬০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৬০ টাকা করা
হয়েছে। ২০০ টাকার পাতা ২২০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। ভায়োডিন মাউথওয়াশ ৩০
টাকা থেকে ৫০ টাকা, অর্থাৎ ৬৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, গ্লুভান প্লাস ৫০
মিলিগ্রামের প্যাকেট ৫০০ টাকা থেকে ৭২০ টাকায় (৪৪ শতাংশ) ইউট্রোবিন ৫
মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকায় (৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ) ড্যাফলন
৯০০+১০০ মিলিগ্রাম ৬৯০ থেকে ৮৪০ টাকায় (২১ দশমিক ৭৩ শতাংশ), মোটিগাট ১০
মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ৩৫০ থেকে ৪২৫ টাকায় (২১ দশমিক ৪২ শতাংশ), এমপামেট
ট্যাবলেট ৫ মিলিগ্রামের প্যাকেট ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় (২০ শতাংশ) বেশি দামে
বিক্রি করা হচ্ছে।
দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির
মহাসচিব ডেল্টা ফার্মা লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. জাকির হোসেন
বলেন, ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ যেমন: কাঁচামাল, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ
অন্যান্য জ্বালানি, প্যাকেজিং বাবদ খরচ আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে
সম্পর্কিত এবং যা সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত
বেশির ভাগ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর হওয়ায়, ডলারের দাম বেড়ে গেলে ওষুধের
উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যায়। কেননা, ওষুধ তৈরির ৮০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে
হয়।
অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের দিনে তিনবেলাই কোনো না কোনো
ওষুধ খেতে হয়। সম্প্রতি এক চিকিৎসক বলছিলেন, সপ্তাহে একবারও ওষুধ লাগে না
এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অনেক মানুষ কয়েক ধরনের ওষুধ নিজের ইচ্ছামতো
কিনে খান। যেমন গ্যাসের ওষুধ, মাথাব্যথার ওষুধ, অ্যালার্জির ওষুধ,
প্রেশারের ওষুধ। খাওয়ার পর একটু গ্যাসের সমস্যা মনে করলেই ফার্মেসিতে গিয়ে
ওষুধ কিনে খেয়ে নেন। একটু মাথাব্যথা হয়েছে, ফার্মেসিতে গিয়ে নিজেই
মাথাব্যথার ওষুধ কিনে খান।
তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইএমএস হেলথের
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ৯ মাসে বিক্রির শীর্ষে থাকা ১০টি ওষুধের
মধ্যে পাঁচটি গ্যাসের ওষুধ। এরপর বিক্রি হয়েছে সেফ-থ্রি, মোনাস, এক্সিয়াম,
সেক্লো ও বিজোরান।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা.
মো. সায়েদুর রহমান এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যান হচ্ছে
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার প্রধান উপাদান
হচ্ছে মেডিসিন কাভারেজ। ৬৭ থেকে ৭০ শতাংশ আউট অব পকেট ব্যয় হচ্ছে ওষুধ
ব্যয়।