একশ
চার বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন কমার্স বলে কোনো
আলাদা বিভাগ ছিল না। কমার্স ছিল পলিটিক্স ও ইকোনমিক্স বিভাগের একটি
অঙ্গমাত্র। এর পরে অর্থনীতির শক্তি ও চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং
ইকোনমিক্স পলিটিক্যাল সায়েন্স থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কর্মাস
যে কেবল একটি নতুন অনুষদ হিসেবেই গড়ে উঠেছে তা-ই নয়, তার প্রসারও বেড়েছে।
কমার্স ফ্যাকাল্টিতে এখন ৯টি বিভাগ। তারই পাশাপাশি আমরা তো চোখের সামনেই
দেখলাম আইবিএ কেমনভাবে যাত্রা শুরু করল এবং অতিদ্রুত অত্যন্ত বিশিষ্ট একটি
প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। আইবিএর শিক্ষার্থীরা এখন দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে
রয়েছেন, যেখানেই আছেন তারা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। এই প্রতিষ্ঠানের
শিক্ষার্থী হওয়াটা এখন অত্যন্ত কাক্সিক্ষত বিষয়; ভর্তি হওয়ার প্রতিযোগিতাটা
খুব কঠিন।
কমার্স অনুষদের নামও বদলেছে, নতুন নাম বিজনেস স্ট্যাডিজ
অনুষদ। ইনস্টিটিউট নামও শুরু থেকেই ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্টেশন। এ
নামকরণ বিশ্বব্যাপী বিরাজমান ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পৃথিবীর মানুষ
একটি নয়, দুই দুটি ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে। আশঙ্কা ছিল যে, তৃতীয়
বিশ্বযুদ্ধ বুঝি অনিবার্য। না, আনুষ্ঠানিক অর্থে বড় আকারে কোনো যুদ্ধ
বাধেনি এটা সত্য। কিন্তু নীরবে একটি যুদ্ধ তো চলছেই। সেটা বাণিজ্যযুদ্ধ। এই
যুদ্ধে সারা বিশ্বই কোনো না কোনোভাবে জড়িত। এতে লাভ হচ্ছে সুবিধাভোগীদের।
তারা মুনাফার পাহাড় গড়ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দরিদ্র
মানুষের অন্যকিছু নেই। তারা তাই নিজেদের শ্রম বিক্রি করেন এবং সেই
শ্রমশোষণেই পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য উন্নতির ঘটনা ঘটেছে।
কিন্তু বঞ্চিত
হচ্ছেন শ্রম-বিক্রয় করে বাঁচার চেষ্টায় ব্যস্ত মেহনতি মানুষ। প্রকৃতিও
পরিণত হয়েছে ক্রয়-বিক্রয়ের সামগ্রীতে, এমনকি যে পুঁজি ছাড়া ব্যবসায় অচল সেই
পুঁজিও পণ্যের চরিত্র নিয়েছে। ওদিকে সবচেয়ে রমরমা ব্যবসায় চলছে দুটি ভয়াবহ
পণ্যের, তাদের একটি হচ্ছে মারণাস্ত্র, অপরটি মাদক। ব্যবসা চলছে
পর্নোগ্রাফিরও। বলা হচ্ছে আমরা বিশ্বায়নের যুগে আছি। সেটা সত্য; এবং সত্য
এটাও যে, বিশ্বায়ন আসলে বাণিজ্যযুদ্ধেরই নামান্তর। এবং এর অপর নাম হচ্ছে
বাজার অর্থনীতি। বিশ্বায়ন আর আন্তর্জাতিকতা কিন্তু এক বস্তু নয়। বিশ্বায়নের
ভিত্তি হচ্ছে বাণিজ্য, অপর পক্ষে আন্তর্জাতিকতার ভিত্তি সহমর্মিতা ও
সহযোগিতা।
আন্তর্জাতিকতা বিপর্যস্ত হচ্ছে বিশ্বায়নের পদাঘাতে। ফল
দাঁড়াচ্ছে এই যে, গত শতাব্দীর বিশ্বযুদ্ধ মনুষ্যত্বকে যে বিপদে ফেলেছিল,
সেই বিপদ এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। জলবায়ুতে বিরূপ পরিবর্তন ঘটছে, ধরিত্রী
তপ্ত হয়েছে, সমুদ্রের পানির স্তর ফুঁসে উঠছে, ঝড়ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, খরা,
বন্যা, দাবদাহ, সব কিছু ক্রমাগত ভয়ংকর আকার ধারণ করছে। মহামারি এসে লাখ লাখ
মানুষের প্রাণ হরণ করছে। খাদ্যের প্রাচুর্যে ভরপুর এই পৃথিবীতে না খেয়ে
মারা যাচ্ছেন মানুষ, আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা রেকর্ড ভাঙছে। দারিদ্র্য,
বৈষম্য ও বেকারত্ব উন্নতির গল্পকে বিদ্রুপ করছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের
আগমন ভরসার তুলনায় শঙ্কারই অধিক কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ এর প্রধান
অবদান যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তা বহু মানুষকে বেকার এবং অনেক মানুষকে অলস
করে তুলবে। আর এর মালিকানা যদি চলে যায় কতিপয়ের হাতে তবে বাদবাকিদের পক্ষে
সুস্থ থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এসব বিপদের ব্যাপারে রাষ্ট্র ও সরকার
উদাসীনই বলা যায়। কারণ বিশ্বব্যাপী ধনীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারটি
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে অনেকেই ভালোভাবে জানেন। আমাদের ইতিহাসও
বাণিজ্যের বিপজ্জনক দিক সম্পর্কে বিলক্ষণ নিজেদের সজ্ঞান করেছে। বাংলাদেশ
একসময়ে অত্যন্ত সম্পদশালী ছিল। সেই সম্পদ ইউরোপীয় লোভাতুর বণিকদের এখানে
টেনে এনেছিল। তাদের ভেতর সবচেয়ে চতুর ছিল ইংরেজরা; তারা বাণিজ্যের পাশাপাশি
ষড়যন্ত্রও করেছে, এবং শেষ পর্যন্ত গোটা দেশকেই দখল করে নিয়েছে। বিভিন্ন
প্রক্রিয়ার শোষণ ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে তারা আমাদের সম্পদ নিজেদের দেশে
পাচার করেছে, এবং আমরা দরিদ্র একটি দেশে পরিণত হয়েছি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার
আবরণে দেশভাগের ফলে বাংলার অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। এরপর
পাকিস্তানি শাসকরা এসে ইংরেজদের মতোই পূর্ববঙ্গকে একটি উপনিবেশে পরিণত করতে
আদাজল খেয়ে লেগেছিল।
আমরা সেই শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। কঠিন
সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ১৯৭১-এ আবার আমরা স্বাধীন হলাম। কিন্তু শোষণের যে
পুঁজিবাদী ধারা ইংরেজ শাসকরা তৈরি করেছিল এবং পাকিস্তানি শাসকরা অব্যাহত
রেখেছিল, তার হাত থেকে আমাদের মুক্তি ঘটল না। কারণ স্বদেশি শাসকরাও বিদেশি
শাসকদের মতোই শোষণ শুরু করল। তারাও লুণ্ঠনের নতুন সব পন্থা উদ্ভাবন করেছে
এবং লুণ্ঠিত অর্থ বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। উন্নয়ন কিছু কিছু হয়েছে। কিন্তু
যত উন্নতি ঘটেছে তত বেড়েছে বৈষম্য, এবং অবনতি ঘটেছে দেশপ্রেমের। দেশপ্রেম
সুযোগবঞ্চিত মানুষের মধ্যে ঠিকই আছে। কিন্তু সুযোগপ্রাপ্তদের মধ্যে তা
ক্রমাগত কমে এসেছে।
এখনকার বাংলাদেশকে যদি নব্যধনিকদের অভ্যন্তরীণ
উপনিবেশ বলা হয়, তাহলে অন্যায় করা হবে না। এই ধনীদের ধারণা, বাংলাদেশের
কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই যত দ্রুত পারা যায় এখান থেকে দুই হাতে টাকা সংগ্রহ
করে বিদেশে পাচার করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এবং সে কাজেই তারা ব্যস্ত। আর যে
উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান তার অভ্যন্তরে মস্ত বড় একটা ফাঁকও রয়ে গেছে। সেটা হলো
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না-করা। বেকারের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বেকারত্ব
বাড়লে অপরাধও বাড়ে, বাংলাদেশে সেটাই ঘটছে। বেপরোয়া এবং সংঘবদ্ধ গণ-ডাকাতির
খবর এমন হারে পাওয়া যাচ্ছে, যেমনটি আগে কখনো পাওয়া যায়নি। এই লেখাটি যখন
লিখছিলাম তখন সংবাদপত্রগুলোর প্রত্যেকটিতে একটি খবর ছিল, যেটিকে বিদ্যমান
অবস্থায় মোটেই চাঞ্চল্যকর মনে হবে না; কিন্তু সেটি গভীর এক বাস্তবতার এক
ঝলক উন্মোচক বটে। ঘটনাটি হলো সুরক্ষিত বলে পরিচিত রাজধানীর একটি এলাকায় ভোর
রাতে সংঘবদ্ধ গণ-ডাকাতি। ডাকাতদের সংখ্যা ছিল ২০-২৫ জন। তারা এসেছে তিনটি
মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেট কারে চেপে। নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে প্রবেশের
চেষ্টা করে, নিরাপত্তাকর্মীরা বাধা দেয়।
ডাকাতরা তখন নিজেদের র্যাবের
সদস্য বলে পরিচয় দেয়, কয়েকজনের গায়ে র্যাবের পোশাকও ছিল। তারা দাবি করে
তাদের সঙ্গে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও আছে। ছাত্ররাও রয়েছে। বাড়িতে তারা নাকি
যৌথ তল্লাশি অভিযান চালাবে। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললে ডাকাতরা বাড়ির
নিরাপত্তাকর্মীদের মারধর করে। তারপর বাড়িটির বিভিন্ন তলায় ঢুকে ৩৬ লাখ টাকা
ও বেশ কিছু স্বর্ণালঙ্কার লুণ্ঠন করে। জরুরি বার্তা পেয়ে টহল পুলিশ এলে
ডাকাতরা তাদের ওপরও চড়াও হয়। পরে স্থানীয় লোকেরা এসে পড়লে পুলিশের পক্ষে
ডাকাতদের চারজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়, পরে আরও দুজন ধরা পড়ে। বোঝা
যাচ্ছে এরা একটি সংগঠিত দল। এ রকম দল নিশ্চয়ই আরও আছে। পুলিশ জানাচ্ছে যে,
গ্রেপ্তার করা ছয়জনের মধ্যে তিনজন আবার নিজেদের পরিচয় দিয়েছে একটি বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে। সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তো না মেনে উপায় নেই
যে ‘উন্নতি আমাদেরকে মোটেই উন্নত করছে না’। এর বহুবিধ প্রমাণও বিদ্যমান।
সিন্ডিকেট
রয়েছে, যারা জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। কিশোররা ব্যাপকহারে মাদকাসক্ত হচ্ছে,
গ্যাং তৈরি করছে এবং হেন অপরাধ নেই যা করছে না। ধর্ষণ আগেও ছিল। কিন্তু
গণধর্ষণের ঘটনার কথা শোনা যায়নি। পাকিস্তানি হানাদাররা জঘন্য ওই অপরাধ করে,
কিন্তু তারা তো ছিল শত্রুপক্ষে, নেমেছিল গণহত্যায়। কিন্তুএখন কেন এমনটা
ঘটবে? বাংলাদেশের মেয়েরা অনেক এগিয়ে এসেছে, সর্বত্র তাদের উপস্থিতি
দৃশ্যমান, কিন্তু তারা যে পথে-ঘাটে কর্মস্থলে, এমনকি গৃহের অভ্যন্তরেও
নিরাপদে নেই সেটি তো কোনো ভালো খবর নয়। ওদিকে আত্মহত্যার সংখ্যাও বাড়ছে।
বিশেষ করে তরুণদের এবং মেয়েদের মধ্যে।
দেশজুড়ে বিষণ্নতা ও হতাশা ঘন
কুয়াশার মতো বিছিয়ে রয়েছে। এই বাস্তবতা কারও অজানা তা নয়। দেশপ্রেমিক
তরুণরাই ব্যবস্থাকে বিশেষভাবে চেনেন ও বোঝেন। বুদ্ধি দিয়ে চিনেন, হৃদয়
দিয়েও বোঝেন। তাদের অধ্যায়নের যে বিশেষ ক্ষেত্র সেখানেও বিদ্যমান বাস্তবতার
কথা আসে।
প্রশ্ন দাঁড়ায় এই ব্যবস্থাটাকে কী আমরা মেনে নেব, নাকি সচেষ্ট
হব একে বদলাতে? বদলানো কী সম্ভব? তাছাড়া বিদ্যমানকে বদলিয়ে কোন ব্যবস্থা
আনব? চালু ব্যবস্থাটার সংস্কার অবশ্যই আবশ্যক, একে মানবিক করার চেষ্টা চাই।
কিন্তু কতটা মানবিক করা সম্ভব? পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যবস্থা, তাকে
বিচ্ছিন্নভাবে এক দেশে বদলানো সম্ভব নয়। এবং সংস্কারে যে কুলাবে অবস্থা
এমনো নয়। কারণ গোটা ব্যবস্থাই এখন মনুষ্যত্ববিরোধী হয়ে পড়েছে। মানুষকে সে
আর মানুষ থাকতে দিচ্ছে না। সুবিধাভোগীরাও সুখে নেই, তারাও অসন্তুষ্ট; দুই
কারণে, ভোগলিপ্সা এবং নিরাপত্তার অভাব। দেয়াল তুলে পাহারা বসিয়ে কতক্ষণ আর
নিরাপদে থাকা যায়, চতুর্দিকে যখন অসন্তোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে?
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়