আমাদের শেয়ারবাজারে বিশৃঙ্খলা চলছে অনেক দিন ধরে। এই খাত থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। অপরাধীরা প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হওয়ার পরও তখন সরকার থেকে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে সরকার পরিবর্তনের পর পুঁজিবাজার নিয়ে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, যার প্রভাবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরবর্তী চার কার্যদিবসে বড় উত্থান দেখা দিয়েছিল।
তবে এসইসিতে কমিশন পুনর্গঠনের পর আবারও পতনের ধারায় নেমে আসে বাজার। নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী।
পত্রিকান্তরে প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা করার আশা ‘নিরাশা’য় পরিণত হয়েছে। সরকার পতনের পর আশায় বুক বেঁধেছিলেন ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারী।
কিন্তু সেই বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ এখন পথে নেমেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে চলা পতন থামছে না কোনো উদ্যোগেই। উপরন্তু চলমান অস্থিরতার মধ্যে ভালো কম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাচ্ছে। এই বিষয়টিকে ‘আশঙ্কাজনক’ বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে দরপতনের প্রধান কারণ হচ্ছে আস্থার অভাব। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে উচ্চ সুদের হার, মার্জিন ঋণের বিপরীতে কেনা শেয়ার বিক্রি (ফোর্সড সেল), নিয়ন্ত্রক সংস্থায় অস্থিরতাসহ নানা কারণে অনেকে বাজার ছাড়ছেন। ভালো ব্যাংকগুলো এখন আমানতের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশের ওপরে সুদ দিচ্ছে, অন্যদিকে ট্রেজারি রেটও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর প্রভাবে শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ সরে গেছে এবং বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একসময় পুঁজিবাজারে ৩৩ লাখ সক্রিয় বিনিয়োগকারী ছিলেন, এখন তা নেমেছে ১২ লাখে।
গত বৃহস্পতিবারও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্সের পতন হয়েছে ৫০ পয়েন্ট। এ নিয়ে টানা ৯ কর্মদিবস ধরে এই প্রধান সূচকের পতন চলছে। ধারাবাহিক দরপতনের ফলে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪০০০ পয়েন্টের ঘরে নেমে এসেছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সিএসসিএক্স সূচক আগের দিনের চেয়ে ২৫.৬০ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ৮৫২৪ পয়েন্টে।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত স্বল্পকালীন সরকার থাকে, ততক্ষণ বিনিয়োগকারীরা নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে।’ তিনি মনে করেন, অত্যন্ত সংবেদনশীল এই বাজারকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছুটা তাড়াহুড়াও করেছে। এর প্রভাবেও শেয়ারবাজারের পতন হচ্ছে। ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, দলীয় সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই শেয়ারবাজার চাঙ্গা হতে পারে।
অতীতে কোনো সরকারই পুঁজিবাজার নিয়ে ভাবেনি। অন্যদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে তিনজন বড়মাপের অর্থনীতিবিদ থাকার পরও পুঁজিবাজার তাঁদের কাছে গুরুত্ব পায়নি বলে বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করছেন। পুঁজিবাজারে মানুষ আসে মূলত ক্যাপিটাল গেইন ও ডিভিডেন্ড বা মুনাফা লাভের আশায়। মানুষ যখন দেখবে যে পুঁজিবাজারে যেসব কম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে, তাদের কার্যক্রম ভালো; ভালো ডিভিডেন্ড দেয়, সেখানে সুশাসন রয়েছে, স্বচ্ছতা রয়েছে, আছে শেয়ারহোল্ডারদের কাছে জবাবদিহির ব্যবস্থা, শেয়ার কেনাবেচা নিয়ে নেই কোনো কারসাজি, তখনই মানুষ স্বেচ্ছায় এই বাজারে চলে আসবে। কিন্তু আমাদের পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা নেই, আছে হঠকারিতা। এ থেকে বের হয়ে আসার সর্বাধুনিক কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা রয়েছে বিএসইসির। এ কাজের ওপরই সংবেদনশীল এই বাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা নির্ভরশীল।