কুমিল্লায় ফসলের মাঠে বোরো আবাদের ধান কাটার ধুম পড়েছে। ভালো ফলনের কারণে এবার কাটা ও মাড়াই শেষে স্বপ্নের সোনালী ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষাণ-কৃষাণীরা। ধান কাটা যেন ফসলের মাঠজুড়ে উৎসবে পরিণত হয়েছে। চলতি মওসুমে নতুন নতুন নানা স্বল্প মেয়াদিপ্রজাতির ধান এবং অগ্রিম রোপণের ফলে গেল বছরের তুলনায়এবার প্রায় সপ্তাহ, পনেরো দিন আগেইপাকা ধান কাটতে শুরু করেছে কৃষকেরা। একই প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কাকে সামনে রেখেও কৃষকের রয়েছে তড়িঘড়ি। গেল বর্ষায় ভারতীয় পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণে বন্যায় প্লাবিত হয় কুমিল্লা জেলার বেশিরভাগ ফসলি মাঠ। বিশেষ করে কুমিল্লার দক্ষিণ অঞ্চলসহ জেলার ১৪ উপজেলা বন্যার পানিতে তুলিয়ে যায়। এতে নষ্ট হয় আমনসহ হেক্টরের পর হেক্টর ফসলি জমির ফসল। তবে আমন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বন্যায় ব্যাপকভাবে পলি মাটি জমে উর্বরতাশক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবারের মওসুমে গেল বছরের তুলনায় বোরো ধানের অধিক ফলনের কথা বলছেন কৃষকরা। এছাড়া ভালো ফলন হওয়ায় উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছেন কৃষি বিভাগ।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস বলছে, চলতি মওসুমে কুমিল্লায় এক লাখ ৬১ হাজার ৯৭১ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। যা গেল মওসুমের তুলনায় ১৮১ হেক্টর বেশি। কুমিল্লা জেলায় গেল বোরো মওসুমে আবাদকৃত জমিতে ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪৮৭ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। তবে এবার সেই রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাবার প্রত্যাশা করছেন কৃষি বিভাগ।
কৃষি বিভাগ জানান, এবার জেলায় এক লাখ ৬১ হাজার ৯৭১ হেক্টর জমিতে আবাদকৃত বোরো ধানের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। যা প্রায় ২৮ শতাংশ ধান। এবার মওসুমে কুমিল্লার মাঠে মাঠে বেশি আবাদ হয়েছে ব্রি ধান-৭৪, ব্রি ধান-৮৬, ব্রি ধান-৮৮, ব্রি ধান-৯৬ এবং ব্রি ধান-১০০ জাতের ধান।
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ কেয়ারি গ্রামের আবদুল কালাম বলেন, গেল বছরের তুলনায় এক বছর তার ফসলি জমিতে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো ফলন হয়েছে বোরো ধানে। বন্যায় তার কিছু ফসল নষ্ট হলেও পলি মাটি জমে জমির উর্বরশক্তি বাড়ায় সারের পরিমাণও কম লেগেছে চাষাবাদে। ধান পাকাও শুরু হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। এখন ধান ঘরে তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছেন বোরো ধান ঘরে তোলার কাজে।
এদিকে, বোরোর ভালো ফলনে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা তৈরি হলেও ফসলের মাঠজুড়ে শ্রমিক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে কৃষকের মাঝে। মাঠে মাঠে ধান কাটার ধুম পড়লেও শ্রমিকের উচ্চ মজুরি ভোগাচ্ছে কৃষকদের। শ্রমিক সংকটের কারণে বাড়তি মজুরি দিয়ে শ্রমিকের শ্রম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক।
কুমিল্লা লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, চৌদ্দগ্রাম, বরুড়া, লালমাই, সদর দক্ষিণ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ধান কাটার ধুম পড়েছে। লালমাই ভুশ্চি এলাকার কৃষক আবদুল হাই বলেন, তার এলাকায় শ্রমিক সংকট চরমে। ভরা মওসুমে ধান কাটা শ্রমিকের চাহিদা বাড়ায় উত্তর আঞ্চলের শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় প্রতিটি শ্রমিক স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ২-৩শ টাকা বেশিতে ৭শ থেকে ৮শ টাকায় মজুরিতে শ্রম কিনতে হচ্ছে তাদেরকে। এতে করে তাদের ফসল রোপন, চাষাবাদ এবং কাটার খরচ শেষে লাভের অংশ টিকিয়ে রাখা কষ্ট হচ্ছে।
অন্যদিকে কিছু মাঠে সনাতনী পদ্ধতির বাইরে ধান কাটাতেও এসেছে আধুনিকতা। ধান কাটা শ্রমিকের পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক যন্ত্র কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন। লালমাই শানিচোঁ গ্রামের কৃষক মো. মতিন বলেন, শ্রমিক সংকট থাকলেও ধান কাটার আধুনিক যন্ত্র আসায় কিছুটা সংকট দূর হয়েছে। তবে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন সব সময় পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেক কৃষক খড়ের কথা চিন্তা করায় আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করছেন না ধান কাটায়।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আইয়ুব মাহমুদ বলেন, চলতি মওসুমজুড়ে আবহাওয়া ভালো থাকায় বোরো আবাদ ভালো হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় খুশি কৃষকেরাও। গেল বছরের তুলনায় এবার আবাদিক জমির পরিমাণ বেড়েছে। একই সঙ্গে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাবার প্রত্যাশা রয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৮ শতাংশ জমিতে ধান কাটা হয়েছে। শতভাগ কাটা ও মাড়াই শেষে বোরো ধানের উৎপাদন নির্ধারণ করা যাবে।