তানভীর
দিপু: বাম্পার ফলনে কুমিল্লা জেলায় বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে
গেছে। ধান পাকা শেষ হওয়ায় চারদিকে শুরু হয়েছে ফলন ঘরে তোলার আয়োজন। প্রয়োজন
পড়ছে বাড়তি ধান কাটা শ্রমিকের। তবে মৌসুমের শুরুতেই মহামারি করোনায় লকডাউন
থাকায় দেশের অন্যান্য জেলা থেকে কুমিল্লায় আসতে পারছে না শ্রমিকরা। শ্রমিক
সংকটে কৃষকের পাকা ধান পড়ে আছে জমিতেই। ঠিক সময়ে শ্রমিক না পেলে বৈরী
আবহাওয়ারে কবলে পড়ে ক্ষতির শিকার হবে কৃষকরা। জেলা কৃষি অফিস বলছে শ্রমিক
সংকট যাতে না পড়ে সেজন্য জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সকল ব্যবস্থা নিচ্ছেন
তারা। প্রশাসনের বিশেষ অনুমতিতে উত্তরবঙ্গসহ অন্যান্য জেলায় বাস পাঠিয়ে আনা
হচ্ছে ধানকাটা শ্রমিক।
কুমিল্লা জেলা কৃষি সম্প্রসারন অফিসের
উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান, এবারে জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
কুমিল্লা জেলায় ১ লক্ষ ৫৮ হাজার ৮শ ৮০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছে ।
যা লক্ষ মাত্রার চেয়ে ২শ ৫০ হেক্টর বেশি। জেলায় এ পযর্ন্ত ৯ শতাংশ ধান কাটা
হয়েছে, ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যে পুরোপুরি ধান কাটা শুরু হবে। কৃষকদের ধান
কাটার জন্য সহযোগিতা করার জন্য ৮৫টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন ও ৭৯টি রিপার
রয়েছে। তাছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে কৃষি শ্রমিক আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা
নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বছরের এসময়ে চারদিকে ধান কাটা শুরু হয়।
উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মৌসুমী শ্রমিকেরাই দৈনিক মজুরি
কিংবা চুক্তিতে ধান কেটে কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকের ঘরে তুলে
দেন। এসময় কুমিল্লার মানুষ বেচাকেনার হাট (শ্রম বিক্রির হাট) বেশ জমে উঠে।
এদের শ্রম বিক্রয় হয় দিন, সপ্তাহ কিংবা মাস চুক্তিতে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা
এসব শ্রমিকের সহজ লভ্যতার কারনেই কমমজুরিতে শ্রমিক পায় কৃষকরা। শ্রমিক
সংকট থাকলেই মজুরি বেড়ে যায় দুই তিনগুণ। এবছর লকডাউন থাকায় মৌসুম শুরুতেই
শ্রমিক আসতে পারেনি কুমিল্লায়। যাদের ধান আগে পেকে গেছে তারা অনেকেই
দ্বিগুণ দামে শ্রমিক রেখে ধান তুলেছেন। কেউ কেউ আবার পরিবারের সদস্যদের
নিয়ে বাধ্য হয়েই ধান কাটা ও তোলার কাজ করতে হয়েছে।
কুমিল্লার সদর
উপজেলার আমড়াতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেসরকারি চাকরিজীবী মাইনুল হক নিজেই
নিজের জমি থেকে একা একা ধান তুলে আনছেন। তিনি জানান, দুই দিন আগে একদিনের
জন্য ৮ শ টাকা দৈনিক মজুরিতে দুই জনকে দিয়ে ধান গুলো কাটিয়েছেন। সেগুলো মাঠ
থেকে ঘরে তোলার জন্য দুই দিন ধরে শ্রমিক পাননি। তাই নিজে নিজে যতটুকু পারা
যায় ঘরে নেয়া হচ্ছে। নতুবা বৃষ্টির কবলে পরলে ধান মাঠেই পচবে।
একই
এলাকার কৃষক আনোয়ার হোসেন তার তিন শিশু সন্তানকে নিয়েই মাঠে নেমেছেন ধান
ঘরে নিতে। আনোয়ার হোসেন জানান, চারদিকে শ্রমিকের এত চাহিদা-কয়েক জন আমার
জমিরি ধানগুলো কেটেই অন্য জায়গায় চলে গেছে। এখন নিজের পরিবারের লোকজন নিয়ে
এগুলো মাড়াই করে বাড়ি নিতে হবে। আর শ্রমিকের যে দাম, ক্যান্টনমেন্ট বাজারে
গিয়ে দুই দিন ঘুরে এসেছি- চড়া দাম দিয়ে শ্রমিক আনলে পোষাবে না।
আনোয়ার হোসেন আরো জানান, দৈনিক মজুরিতে ৮শ টাকায় শ্রমিক এনে এই ধানের দাম পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ১২ শ টাকা। তাহলে কৃষকের লাভ টা কি!
নগরীর
কান্দিরপাড়, পদুয়ার বাজার, শুয়াগাজী বাজার, চৌয়ারা বাজার, নিমসার বাজার,
লালমাই বাজার, ক্যন্টনমেন্ট বাজার, ইলিয়টগঞ্জ বাজার, দেবিদ্বার বাজার,
মুরাদনগর বাজার, বাঘমারা, বিজরা বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে দৈনিক বা চুক্তি
ভিত্তিক মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায়। ধান কাটা মৌসুমে প্রতিদিনই এ সকল বাজারে
শ্রম বিক্রির জন্য একটু বেশি ভীড় করে শ্রমজীবী মানুষরা। পণ্যের মত বিক্রি
হয় তাদের শ্রম।
শ্রমিক সংকট থাকলে মজুরি বাড়ে দিনের পর দিন। সংকটকালীন
সময়ে প্রতিজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি নির্ধারন হয় ৭ শ টাকা থেকে ৮ শ
টাকায়। শ্রমিকের সহজ লভ্যতা বাড়লে কমে আসে মজুরিও, সর্বনি¤œ ৪ শ থেকে ৬শ
টাকায় উঠে এই দর।
কুমিল্লার হাট-বাজারে শ্রম বিক্রি করতে আসা অভাবী
মানুষদের বেশির ভাগেরই বাড়ি রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ময়মনসিংহ,
দিনাজপুর, নেত্রকোণা ও ঠাকুরগাঁওসহ দেশের উত্তরÑপশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে।
পাঁচথুবী
এলাকায় ধান কাটতে আসা রংপুরের শ্রমিক রফিক জানান, এই কয়দিন শ্রমিকের
চাহিদা ভালো, দামও ভালো। তবে সাথের লোকজন লকডাউনে আটকে কুমিল্লা আসতে পারছে
না। তাদের কামাইও থেমে আছে।
তার সাথে আরো দুই শ্রমিক সুলেমান ও মিলন
জানান, লকডাউনের আগে চলে আসায় বেশি দামে কাজ পাচ্ছি। এখন লোক চলে আসছে আবার
লকডাউন ছাড়লে লোক বাড়বে-তখন আবার কম দামে কাজ করতে হবে। কোন কোন দিন কাজ
থাকবেও না।
এদিকে কুমিল্লার স্থানীয় ধানকাটা শ্রমিক ছাড়াও উত্তরবঙ্গসহ
অন্যান্য জেলা থেকে শ্রমিক আনতে বিশেষ ব্যবস্থা করছে কৃষি বিভাগ। যেসব
শ্রমিকরা কুমিল্লায় আছেন তারা এবং কৃষকদের সাথে যোগাযোগ করে অন্য শ্রমিকদের
আনতে বাস পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া লকডাউন থাকলে কেউ যদি ধান কাটার জন্য শ্রমিক
আনাতে চায় তাহলে উপজেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে বিশেষ পরিবহন
ব্যবস্থায় শ্রমিক আনাতে পারে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের
কর্মকর্তারা।
কুমিল্লা জেলা কৃষি সম্প্রসারন অফিসের উপ-পরিচালক
মিজানুর রহমান জানান, কুমিল্লা এবার লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বোরো ধান বেশি
উৎপাদন হয়েছে। এবার করোনা ও লকডাউনের কারনে যাতে শ্রমিক সংকটে না পড়ে সে
জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহন করছি। আমাদের ধান কাটার অনেক যন্ত্রপাতি রয়েছে।
তাছাড়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা ইতিমধ্যে ১০ বাস দেশের উত্তরাঞ্চলে
পাঠিয়েছি শ্রমিক আনতে, পর্যায়ক্রমে আরো পাঠাবো। অন্য জেলা থেকে শ্রমিকদের
বহনকৃত বাস আসতে আমরা বাঁধা দিচ্ছি না। এ পযর্ন্ত প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক আনা
হয়েছে। আশা করি বাকি সময়ের মধ্যে কুমিল্লায় আর শ্রমিক সংকট থাকবে না। খবর
নিয়ে জেনেছি- শ্রমিকদের মজুরিও কমে এসেছে। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। এখন
শুধু ভালো আবহাওয়া থাকলেই হয়।