শুক্রবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
১৩ পৌষ ১৪৩১
বন্ধুরা কেন আগে চলে যায়?
মাসুদ কামাল
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০২ এএম |

  বন্ধুরা কেন আগে চলে যায়?
রীভানের সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। তারপরও তার অশ্রুসজল চোখ-মুখ আমাকে বেশ কয়েক দিন বিচলিত করে রেখেছিল। স্কুলড্রেস পরা শিশুটি তখন তার পিতার কোলে ছিল। দৃশ্যটি অদ্ভুত, পিতা হাসছে, পুত্র কান্না করছে। এই পিতা ভদ্রলোকটি আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, সহকর্মী। তার ফেসবুকেই ছবিটি আমি দেখি। সেখানে তিনি অবশ্য পুত্রের কান্নার কারণটি লিখে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “কষ্টটা হলো সবাই একসাথে কেন দৌড়ালো না। বন্ধুরা আগে পিছে কেন হলো!” বুঝলাম, স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পরের ছবি এটি। ছোট্ট শিশু রীভানের অকপট প্রশ্ন আমাকে স্পর্শ করলো। আসলেই তো– আমরা একসঙ্গে থাকি না কেন? কেন আমরা বন্ধুরা পর্যন্ত আগে-পিছে হয়ে যাই, পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই? কেন বন্ধুরা অন্যদের ছেড়ে আগে চলে যায়?
ফেসবুকে স্ট্যাটাসটা দেখার কয়দিন পর শেরিফের (রীভানের পিতা) সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা। কথার শুরুতেই আমি বললাম, আমি তো আপনার পুত্রের ভক্ত হয়ে গেছি। কী অবলীলায় সে জগতের সিংহভাগ সমস্যার মূলে থাকা প্রশ্নটি করে ফেললো! ওর এই প্রশ্নের কী জবাব দিয়েছেন আপনারা?  শেরিফ জানালো, স্কুলের শিক্ষকরা নাকি পরে এসে রীভানকে আদর করেছে, সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেছে—কাঁদছো কেন, তুমিই তো ফার্স্ট হয়েছো।
আমি হতাশ হলাম। শিক্ষক তো আবার সেই প্রতিযোগিতার কথাই বললেন। কেবল তা-ই নয়, তিনি আবার একধাপ এগিয়ে একটা মিথ্যাও বললেন, সান্ত্বনা দিতে গিয়ে শিশুটিকে দৌড়ে মিথ্যামিথ্যিভাবে ফার্স্ট বানিয়ে দিলেন! এতে একই সঙ্গে সমস্যা হলো একাধিক। প্রথমত, তিনি ছোট্ট শিশুটির কাছে ফার্স্ট হওয়ার সংজ্ঞাই পাল্টে দিলেন, ফলে এই ভুল শিক্ষা শিশুটিকে জীবনে আরও বেশ কয়েকবার হোঁচট খেতে বাধ্য করবে। দ্বিতীয়ত, তিনি শিশুটিকে তার মৌলিক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া থেকে বঞ্চিত করলেন। শিশুর মনের প্রশ্নটি ছিল, বন্ধুরা সবাই কেন একসঙ্গে দৌড়ালো না? কেন তারা আগে পিছে গেলো? কেন আগে পিছে যেতে হয়? একসঙ্গে না গেলে সবাই কি আলাদা হয়ে গেলো না? এসব প্রশ্নের জবাব রীভান সেদিন পায়নি। আসলে আমাদের কোনও শিশুই পায় না। আমরা এই উত্তরগুলো তাদের দিই না। বরং তাদের ভুল উত্তর দিয়ে বিভ্রান্ত করি। প্রশ্ন করার ক্ষমতাকেই নষ্ট করে দিয়ে এক ধরনের বিকৃত আমোদ অনুভব করি। অথচ প্রশ্নটি তো জরুরিই ছিল। কেন আমাদের সমাজ একেবারে শৈশব থেকেই শিশুদের আগে-পিছে যেতে শেখায়? এই যে সব বন্ধুকে ফেলে আগে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, একটা শিশুর মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া, এটা কি সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ? এটা কি একটা রোগ নয়?  
আমরা প্রায়ই বলতে শুনি, প্রতিযোগিতাহীন সমাজ নাকি একটা স্থবির সমাজ। আসলেই কি তাই? আমি ঠিক বুঝি না। আমার মনে হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কথাটি সত্য হতেও পারে। কিন্তু তাই বলে প্রতিযোগিতার এই মনোভাবটি একেবারে শিশুকালে, কিংবা ছাত্রজীবনেই মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক? এ ব্যাপারে আমার খুবই তিক্ত এবং মর্মান্তিক কিছু অভিজ্ঞতা আছে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ফার্স্ট হওয়ার দৌড়ে যে দুজন ছিল, কেবল এই প্রতিযোগিতার কারণে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক কীভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, সেটা আমি দেখেছি। কেবল তাদের সম্পর্কই নয়, এই দুজনকে কেন্দ্র করে পুরো ক্লাসেই একটা বিভক্তি দেখা দিয়েছিল।
আর একটি ঘটনা বলি, আমার এক আত্মীয় ছিল, সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। ক্লাসে সে ফার্স্ট-ই ছিল। কিন্তু সেকেন্ড পজিশনে থাকা ব্যক্তিটির সঙ্গে তার দূরত্ব ছিল খুবই কম। সবসময় সে আতঙ্কে থাকতো—এই বুঝি পেছনে থাকা সহপাঠী তাকে অতিক্রম করে যায়। অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষার আগে আগে তারই আরেক সহপাঠী অসদুপায়ের অভিনব এক বুদ্ধি নিয়ে হাজির হলো। সেই বুদ্ধির ডিটেইলে আর যাচ্ছি না। কেবল এতটুকু বলছি—সেই কুবুদ্ধি অনুযায়ী পরীক্ষা দিতে গিয়ে সে ধরা পড়ে যায়। তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় কিছু দিন পর ছেলেটির মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। আমার সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। জানতে চেয়েছিলাম—কেন তুমি এমন করলে? উত্তরে বলেছিল-সে আসলে দ্বিতীয় হওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। ছেলেটির জবাব ছিল, আমি তো কখনও দ্বিতীয় হইনি!
আমার মনে হয়, প্রতিযোগিতার এই মনোভাবটি আমার ওই আত্মীয়র মনে একেবারে ছোটবেলাতেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হয়তো একেবারে প্রাথমিক ক্লাসে সে প্রথম হয়েছিল। ব্যস, আর যায় কোথায়। বাবা-মা, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে তখন তার মাথায় এই বিষয়টি ঢুকিয়ে দিয়েছিল—তুমি আর দশ জনের মতো নও। তুমি আলাদা। তুমি মেধাবী। এতটাই মেধাবী যে তুমি সবসময় পরীক্ষায় প্রথম হবে। এই যে অন্য সকলকে পেছনে ফেলে প্রথম হওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা, এটিই তার জীবনে ক্ষতির কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
আমার নিজের মেয়ে, এখন যে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যখন স্কুলে পড়তো, তখন মাঝে মধ্যে তাকে স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজ আমি করতাম। দেখতাম স্কুলের সামনে অভিভাবকদের জটলা, ভিড়। তাদের কথাবার্তা কিছু কিছু কানে আসতো। বিষয়বস্তুগুলো ছিল খুবই পরিচিত, প্রায় একই রকম। সন্তানের রেজাল্ট, টিউশন, টিচারের প্রশংসা-নিন্দা, এসব। আবার অনেককে দেখেছি—সন্তানকে বকাবকি করছেন। বাবা-মা (অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা)-কে বলতে শুনেছি, অমুকে পারে তুই কেন পারিস না? তোকে কি টিচার কম দিয়েছি, খাবার কম দিয়েছি? তাহলে তুই কেন ওর মতো হতে পারিস না, ইত্যাদি ইত্যাদি। ইদানীং আবার একটা প্রবণতা দেখা যায়। পাবলিক পরীক্ষা, এসএসসি বা এইচএসসি’র যখন রেজাল্ট হয়, ফেসবুকে অভিভাবকদের স্ট্যাটাসের বন্যা বয়ে যায়। আমার ছেলে জিপিএ-৫ পেয়েছে, মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে, গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে, ইত্যাদি। সেই সঙ্গে ছেলে অথবা মেয়ের একটা ছবি। তারপর—‘ওর জন্য দোয়া করবেন’ জাতীয় প্রার্থনা। কেন, যারা জিপিএ-৪ বা জিপিএ-৩ পেয়েছে তাদের জন্য দোয়ার দরকার নেই? নাকি তারা দোয়া পাওয়ার অযোগ্য? যারা জিপিএ-৫ পায়নি তারা কি এই সমাজ বা দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে না? তাহলে তাদের বাবা মায়েরা কেন এ ধরনের স্ট্যাটাস ফেসবুকে দেন না? তারা কি তাদের সন্তানদের নিয়ে লজ্জিত থাকেন? এই মানসিকতাও কি ঠিক?  এই যে গর্বিত অথবা লজ্জিত বাবা-মা, এদের প্রতি আমার কোনও ক্ষোভ নেই। বরং এক ধরনের মায়া আছে। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাকেই আমরা এমনভাবে সাজিয়েছি, যেখানে প্রতিযোগিতাটাই মুখ্য। অন্যকে হারিয়ে দেওয়ার মধ্যেই আনন্দ। আমাদের সেই অসুস্থ বিন্যাসের হতভাগ্য শিকার এই অভিভাবকরা।
কেবল শিক্ষাজীবনেই নয়, প্রতিযোগিতার এই প্রবণতা আমরা সমাজের সকল ক্ষেত্রেই আজকাল দেখি। সমাজ, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য-সকল ক্ষেত্রেই। কোথাও এগিয়ে যাওয়া প্রতিযোগিতা, কোথাও অন্যকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার প্রতিযোগিতা, কোথাও মুনফার প্রতিযোগিতা। ইদানীং আবার দুর্নীতির প্রতিযোগিতাও যেন একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে বসে আছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দেখি প্রতিপক্ষকে বাতিল করে দেওয়ার, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যদি জনগণকে সেবা করার প্রতিযোগিতা থাকতো, সেটাকে হয়তো প্রশংসা করা যেত। কিন্তু তা কি হয় বাস্তবে? বরং দেখা যায়Ñজনগণের সঙ্গে কে কতটা প্রতারণা করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে। এরকম প্রতিযোগিতা করতে করতে আমাদের মানসিকতা এমন দাঁড়িয়েছে যে পাশের লোকটিকেও আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে থাকি। অনেক সময় নিজের ছায়াকেও ঈর্ষা করি। আমরা আর যুথবদ্ধ থাকতে পারি না, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। এরকম বিচ্ছিন্ন সমাজ অগ্রসর হবে কীভাবে?
নাকি আমাদের সমাজপতিরাই চান, যাতে সাধারণ মানুষগুলো এভাবে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্নই থাকে? বিচ্ছিন্ন থাকলেই প্রতারণা বা শোষণ করাটা সহজ হয়। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলেই বরং বিপদ।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক













সর্বশেষ সংবাদ
নতুন বইয়ের বর্ণিল নতুন বছর
নৌকায় ভোট নিতে ভাতার কার্ড আটকে রাখার অভিযোগ
শান্তির নোবেলজয়ী থেকে দণ্ডিত আসামি
শ্রমিক ঠকানোর দায়ে নোবেলজয়ী ইউনূসের ৬ মাসের সাজা
ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা অধ্যক্ষ পদে অধ্যাপক ডাঃ রুহিনী কুমার দাস এর দায়িত্ব গ্রহণ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধু নিহত
বরুড়ায় শ্রমিকদল নেতাকে ছুরিকাঘাত
অর্ধেক দামে ফ্রিজ বিক্রি করছেন ফ্রিজ প্রতীকের প্রার্থী
বাড়ির জন্য কেনা জমিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যাওয়া একই পরিবারের ৪ জনের কবর
৫৫ কেজি সোনা চুরি, ফের রিমান্ডে দুই রাজস্ব কর্মকর্তা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২