শুক্রবার ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
১৩ পৌষ ১৪৩১
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস
হারুন-অর-রশিদ
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৩ জুন, ২০২৩, ৩:৩৭ পিএম |

আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস
আওয়ামী লীগ এ দেশের বৃহত্তম, অন্যতম প্রাচীন, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠার পর প্রায় সাড়ে সাত দশকের ঐতিহ্যবাহী এই দল জাতীয় রাজনীতির অগ্রভাগে থেকেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের মাধ্যমে আমরা মহান স্বাধীনতা ও জাতিরাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পেয়েছি।

আওয়ামী লীগের গত ৭৪ বছরের ইতিহাস সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের ইতিহাস। আওয়ামী লীগের ইতিহাস আমাদের জাতীয় উন্নয়ন, অগ্রগতি-সমৃদ্ধি, অর্জন-সাফল্যের ইতিহাস। এত অর্জন, সংগ্রাম আর এত দীর্ঘ সময় ঐক্য ও অগ্রগতি ধরে রাখতে পারার পেছনে শক্তির উৎস কী?

পুরান ঢাকার কেএম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেন’ ভবনে যাঁদের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয়, তাঁরা ছিলেন বঙ্গীয় মুসলিম লীগের ‘প্রগতিশীল গ্রুপ’ নামে পরিচিত সোহরাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থক। ঢাকার নবাব পরিবার বা আহসান মঞ্জিলের বিপরীতে ভারত বিভক্তির আগে পুরান ঢাকার ১৫০ নম্বর মোগলটুলী পার্টি হাউসকে কেন্দ্র করে তাঁরা সংগঠিত হয়েছিলেন। ওই পার্টি হাউস বা কর্মী শিবিরের প্রধান ছিলেন শামসুল হক (যিনি টাঙ্গাইলের শামসুল হক হিসেবে খ্যাত)।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক মাস পর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে মোগলটুলী পার্টি হাউসে ওঠেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ভর্তি ফরমে ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল ১৫০, মোগলটুলী, ঢাকা। এটি ছিল তাঁর বন্ধু শওকত আলী ওরফে শতকত মিয়ার বাড়ি। সেপ্টেম্বর মাসেই কিছুসংখ্যক বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মীর উদ্যোগে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তবে কিছুদিনের মধ্যে তিনি এ সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। কারণ, বাস্তব পরিস্থিতিকে বিবেচনায় এনে সংগঠনের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের ‘অতি বামপন্থা’ অবলম্বন। অতঃপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাড়ে চার মাসের মধ্যে তাঁরই উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ)।

সোহরাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থকদের উদ্যোগেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২২ মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ (২৩ জুন ১৯৪৯, বর্তমানে যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ)। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। কারাগারে বন্দি অবস্থায় তিনি নতুন এই দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক হন শামসুল হক।

তখন বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা সহজসাধ্য ছিল না। মুসলিম লীগ শাসকগোষ্ঠীর রোষানল মোকাবিলায় দলের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করা ছিল সময়ের প্রয়োজনে। ভারত বিভাগ-পূর্বকালে তিনি আসামে রাজনীতি করতেন এবং সেখানকার কৃষক আন্দোলনের নেতা হিসেবে খ্যাতি পান। ১৯৪৮-এর খাদ্য আন্দোলন এবং ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।

‘আওয়াম’ শব্দের অর্থ ‘জনগণ’। জনগণের মধ্য থেকেই এই দলের সৃষ্টি। তাই প্রতিষ্ঠাগতভাবে আওয়ামী লীগ হচ্ছে জনগণের দল। দীর্ঘ ৭৪ বছরের পথচলায় আওয়ামী লীগ কখনও জনবিচ্ছিন্ন হয়নি। বরং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সমাজ-চাহিদা বিবেচনায় রেখেই প্রধানত বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ পথ চলে আসছে। জনগণই হলো আওয়ামী লীগের শক্তির মূল উৎস। যে কারণে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের যে সংবিধান রচিত হয়; এর ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নামের সঙ্গে ‘জননেত্রী’ অভিধা যুক্ত। একই চিন্তা-চেতনা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ আওয়ামী লীগ খাদ্য সংকট, বন্যা-খরা-প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারিতে জনগণের পাশে এসে দাঁড়ায়।

আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীকে দেখেছি কভিড মহামারির সময় অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে। মাঠের ফসল কৃষকদের ঘরে তুলতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাশে দাঁড়াতে। এ ছাড়া অনাথ, বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নিয়মিত ভাতা প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বিধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) সময়েই হয়েছে। কোনো মানুষ যেন গৃহহীন না থাকে, সে লক্ষ্যে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই লাখ লাখ গৃহহীন অসহায় মানুষের জন্য সরকারি খরচে গৃহ নির্মাণ করে দিয়ে নজির সৃষ্টি করছে। গ্রামীণ মানুষের সহায়তা প্রদানে তাঁর সরকারই সারাদেশে ১৮ হাজার কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি অন্যান্য দেশে অনুকরণের জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রশংসিত।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার বছর ১৯৪৯ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছবি: সংগৃহীত

দেশে হতদরিদ্রের হার বিস্ময়করভাবে হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। আজ গ্রামের মানুষও শহরের মতো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। দেশব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর ৪০ কোটির মতো পাঠ্যপুস্তক প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেকসংখ্যক নারী। এই অর্ধেকাংশকে গৃহকোণে সীমাবদ্ধ রেখে জাতির সার্বিক উন্নয়ন যে সম্ভব নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের সময় সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন যে মাত্রায় ঘটেছে, তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।

রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের শক্তির আরেকটি উৎস হলো বাস্তববাদিতা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ ও বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও, এ লক্ষ্য পূরণে সময় নিয়েছে বা যথোপযুক্ত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শাসকগোষ্ঠীর বৈরী আক্রমণ মোকাবিলায় শুরুতে দলের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দটি ছিল বটে; ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন-উত্তর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ামাত্র তা বাদ দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের দরজা সব সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর ১৯৭২ সালের সংবিধানে অসাম্প্রদায়িকতাকে (‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র নামে) রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এক দল ঘাতকের হাতে জাতির পিতা ও স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু সপরিবারে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে প্রাণ দেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় স্বপ্ন ছিল উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। এ লক্ষ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রায় সব দল ও ব্যক্তি নিয়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সুযোগ ঘাতক-খুনি চক্র দেয়নি।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগের শক্তির অপর একটি উৎস হলো সৃজনশীলতা। যেমন বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু প্রণীত ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি। ১৯৮১ সালে দলের নিশ্চিত ভাঙন রোধে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ভারতে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। নির্বাচনকে ইতিবাচক হিসেবে নেওয়াটাও আওয়ামী লীগের শক্তির একটি উৎস।

পরিশেষে, আওয়ামী লীগ মানে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শ সুরক্ষা। আওয়ামী লীগ মানে দেশের উন্নতি, সমৃদ্ধি, সাফল্য ও অগ্রগতি। আওয়ামী লীগ মানে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের শান্তি, সম্প্রীতি ও সহাবস্থান। আওয়ামী লীগ মানে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ। আওয়ামী লীগ হচ্ছে অসহায়, গরিব, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঠিকানা। আওয়ামী লীগ পথ হারালে কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হলে জাতি আর সঠিক পথে চলতে পারবে না। এক অর্থে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতির ভাগ্য অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। তাই আওয়ামী লীগ যাতে কিছুতেই পথ না হারায়; জনগণের মণিকোঠায় যাতে স্থায়ী আসন করে নিতে পারে– দেশ ও জাতির স্বার্থে দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটিই একান্ত কামনা। এর দায়ভার দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে সর্বস্তরের নেতৃত্ব ও কর্মীদের। তাঁদের রাজনীতির পাথেয় হবে ভোগ নয়, ত্যাগ; জনগণের সেবায় আত্মোৎসর্গ। সেটিই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ও আদর্শ।

ড. হারুন-অর-রশিদ: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী; সাবেক উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়












সর্বশেষ সংবাদ
নতুন বইয়ের বর্ণিল নতুন বছর
নৌকায় ভোট নিতে ভাতার কার্ড আটকে রাখার অভিযোগ
শান্তির নোবেলজয়ী থেকে দণ্ডিত আসামি
শ্রমিক ঠকানোর দায়ে নোবেলজয়ী ইউনূসের ৬ মাসের সাজা
ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লা অধ্যক্ষ পদে অধ্যাপক ডাঃ রুহিনী কুমার দাস এর দায়িত্ব গ্রহণ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্ধু নিহত
বরুড়ায় শ্রমিকদল নেতাকে ছুরিকাঘাত
অর্ধেক দামে ফ্রিজ বিক্রি করছেন ফ্রিজ প্রতীকের প্রার্থী
বাড়ির জন্য কেনা জমিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যাওয়া একই পরিবারের ৪ জনের কবর
৫৫ কেজি সোনা চুরি, ফের রিমান্ডে দুই রাজস্ব কর্মকর্তা
Follow Us
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোহাম্মদ আবুল কাশেম হৃদয় (আবুল কাশেম হৃদয়)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ ১২২ অধ্যক্ষ আবদুর রউফ ভবন, কুমিল্লা টাউন হল গেইটের বিপরিতে, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা ৩৫০০। বাংলাদেশ।
ফোন +৮৮ ০৮১ ৬৭১১৯, +৮৮০ ১৭১১ ১৫২ ৪৪৩, +৮৮ ০১৭১১ ৯৯৭৯৬৯, +৮৮ ০১৯৭৯ ১৫২৪৪৩, ই মেইল: [email protected]
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত, কুমিল্লার কাগজ ২০০৪ - ২০২২