কুমিল্লা ইপিজেড এর কলকারখানা নিঃসৃত পানি দূষণ নিয়ে আলাপ-আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে প্রায় এক দশক। জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এ বিষয়টি তুলে ধরছে বছরের পর বছর। এ ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজন জাতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার। পত্রিকাটির গত ১৮ নভেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় খালিদ বিন নজরুল এর বিশদ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ, ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য সম্বলিত একটি পরিপূর্ণ প্রতিবেদন এটি। এর আগেও ছাপা এবং ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন এসেছে যাতে দেখা গেছে কুমিল্লা নগরীর ১৯, ২০, ২১ নম্বর ওয়ার্ড সংশ্লিষ্ট এবং সদর দক্ষিণের কয়েকটি ইউনিয়নের ফসলী জমি, জলাশয় এবং লোকালয়গুলো এ কালো পানির দূষণের শিকার। প্রতিটি প্রতিবেদনেই সরেজমিন পর্যবেক্ষণে এ কালো পানির অস্তিত্ব এবং তা থেকে উদ্ভুত দূষণটি যে একটি কৃষ্ণবাস্তবতা তা প্রতিফলিত হয়েছে। নানা প্রতিবেদনে মনোযোগ দেওয়ায় কয়েকটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। ১. স্থানীয় সাংসদ এবং স্থানীয় মেয়র এর কুমিল্লা ইপিজেড পরিদর্শনেও অবস্থার উন্নতি না হওয়া। ২. জেলা প্রশাসনের বারবার আশ^াসেও এ দূষণ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি না দেখা। ৩. কুমিল্লা ইপিজেড কর্তৃক কালো পানির দায়ভার এড়ানোর চেষ্টায় এ কালো পানির উৎস নিয়ে প্রশ্ন। এ প্রশ্নগুলো ঘিরেই এ প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করতে অগ্রসর হওয়াটা সমীচীন বলে মনে করি।
১. মাননীয় সংসদ সদস্য আ.ক.ম. বাহাউদ্দিন বাহার ও তৎকালীন মাননীয় সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু কুমিল্লা ইপিজেড পরিদর্শন করেন। এ সমস্যা সমাধানে মাননীয় সাংসদ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন (কুমিল্লা২৪টিভি, ২০ মে ২০২১, ইউটিউব)। ঐ পরিদর্শনের পর প্রায় আড়াই বছর পার হওয়ার পরও কালো পানির অস্তিত্ব থাকায় প্রশ্ন রয়ে যায় যে এ নিরিখে যে সিদ্ধান্তসমূহ নেয়া হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন হয়েছিল কিনা, হলেও তা যথেষ্ট ছিল কিনা?
২. এ প্রতিক্রিয়া লেখার পূর্বে ২০১৮ সাল থেকে প্রকাশিত স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমের আটটি ছাপা প্রতিবেদন পাঠ এবং পাঁচটি ভিডিও প্রতিবেদন দেখা হয়। প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদনেই কুমিল্লা জেলা প্রশাসন থেকে আশ^াস দেয়া হয় অল্প সময়ের মধ্যেই পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ সমস্য সমাধানের চেষ্টা করা হবে। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সেই ‘অল্প’ সময়টি আর ফুরোয় না, এ সমস্যারও সমাধান হয়না।
৩. পঠিত এবং পর্যবেক্ষিত প্রায় সবকটি প্রতিবেদনেই কুমিল্লা ইপিজেড কর্তৃপক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, ইপিজেড থেকে কোন রকম রাসায়নিক যুক্ত কিংবা কালো পানি বের হয়না। ইপিজেড এর কেন্দ্রীয় পরিশোধনাগারে (সিইটিপি) এ পানি পরিশোধিত হয়েই তা খালে ছাড়া হয়। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও কুমিল্লা ইপিজেড এর নির্বাহী পরিচালক জনাব আবদুল্লাহ আল মাহবুব এমনটাই দাবি করেন (দ্য ডেইলি স্টার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩)। তাই প্রশ্ন জাগে, এ পানি তাহলে আসে কোত্থেকে? ২০ নং ওয়ার্ডের একজন বাসিন্দা হিসেবে এ লেখক হলফ করে বলছে যে, ইপিজেড হওয়ার পূর্বে দিশাবন্দ খালের পানি কালো ছিলনা। বরং দিশাবন্দ খাল এবং জলা, পার্শবর্তী উনাইসার খাল ও জলা, কুলাই খাল ও জলা, বিজয়পুর খাল ও জলা, গুইঙ্গাজুরি খাল ও জলা ছিল বর্ষাকালে ঐ এলাকার মানুষের জন্য দেশী মাছের প্রধান উৎস। তাই ইপিজেড কর্তৃপক্ষের দাবি যদি সত্যি হয়, তাহলে এখন খুঁজে বের করতে হবে এ পানি আসে কোত্থেকে? কারণ এর উৎস সম্পর্কে না জেনে তা সমাধানের চেষ্টা করাটা অর্থহীন বলে মনে করি।
স্থানীয় সংগঠন রঙধনু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থার সবুজায়ন কর্মসূচি ‘সবুজ আঙিনা-২০২২’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত বছর জুলাই মাসে। সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের ১৯ ও ২০ নং ওয়ার্ডের এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৭ এর নবনির্বাচিত কাউন্সিলরগণ। ঐ অনুষ্ঠানে পানি দূষণের এ সমস্যা সমাধানের তাগিদ দিয়ে এ নিরিখে পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানায় এ লেখক। কাউন্সিলরগণ পদক্ষেপ গ্রহণের আশ^াস দেন, কিন্তু দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ এবং অগ্রগতি এখনও দেখা যায়নি। বর্তমান মাননীয় সিটি মেয়র জনাব আরফানুল হক রিফাত দায়িত্ব নেয়ার এক বছর হয়ে যাওয়ার পরও নগরীর অন্যতম প্রধান এ সমস্যা সমাধানে কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানা নেই। আমরা কালো পানির কবলে, আমরা দূষণের শিকার। আমাদের জনজীবন দূর্বিসহ। এটা বাস্তবতা। এটা সত্য। এটা কালো। এটা কালো পানি। এটা দুঃসহ দুর্গন্ধ। আমাদেরকে মুক্তি দিন এ কালো পানি থেকে, এ দূর্বিসহ জীবন থেকে। সকল জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার, জেলা প্রশাসন, এবং কুমিল্লা ইপিজেড কর্তৃপক্ষ চাইলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। এখানে চাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ইচ্ছাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাননীয় সাংসদ, মাননীয় মেয়র, মাননীয় জেলা প্রশাসক এর প্রতি নতজানু অনুরোধ, আপনারা একটিবার আমাদের ভুক্তভোগী এলাকাটি পরিদর্শন করুন। দেখে আসুন আমাদের দূর্বিসহ জীবন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন এ সমস্যা সমাধানে আপনারা কতটা তৎপর হবেন।
কুমিল্লা ইপিজেড আমাদের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ। এ ইপিজেড আমাদের এলাকার কর্মসংস্থানেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু আমাদের জনজীবন দূর্বিসহ করে এমন অগ্রগতি কাম্য নয়। একটি বাস্তবিক এবং প্রকৃত ইচ্ছাই পারে আমাদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করতে, যা আমাদের পূর্বপুরুষেরা উপভোগ করেছেন।
আবুল খায়ের টিটু: কুমিল্লা নগরীর ২০ নং ওয়ার্ডের দিশাবন্দ গ্রামের অধিবাসী