২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারি হিসাবে ৩২৫ জনের শরীরে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয় যাদের মধ্যে ২৩০ জনই মারা যান। গতবছর (২০২২) নিপাহ ভাইরাসে তিনজন আক্রান্ত হন তাদের দুজনকেই বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মৃতদের একজন নওগাঁর আর অন্যজন ফরিদপুরের। হিসাবে দেখা যায় প্রায় ৭১ শতাংশ নিপাহ আক্রান্ত রোগীই মারা যায়। চলতি বছরে, জানুয়ারিতেই দুজন আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেলে মারা যায় এবং একই সময় গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটার এক নারী আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। খেজুরের কাঁচা রস ছাড়া শাক-সবজি, ফল-মূল থেকেও নিপাহ ভাইরাস ছাড়াতে পারে। বিশেষ করে প্রাণী বা পাখীর আংশিক খাওয়া কোন কিছুই খাওয়া যাবে না। বাদুড় ছাড়াও সংক্রমিত প্রাণীর মাধ্যমেও এটা ছড়াতে পারে।
কাঁচা খেজুরের রসে বাদুড়ের বিষ্ঠা ও লালা মিশ্রিত হয় এবং ওই বিষ্ঠা ও লালাতে নিপাহ ভাইরাসের জীবাণু থাকে। ফলে কাঁচা খেজুরের রস পান করিলে মানুষ নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমানে বড়দের সঙ্গে শিশুরাও বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর খেজুরের কাঁচারস সংগ্রহ, বিক্রয় ও বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গাছি ও জনসাধারণকে নিপাহ ভাইরাস থেকে সাবধানতা অবলম্বনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। নানাহ ¯œায়ু ও ¯œায়বিক রোগের লক্ষণের সাথে নিপাহ ভাইরাস আক্রান্তদের লক্ষণের মিল থাকায় মাঠপর্য্যায়ের অনেক চিকিৎসকের পক্ষে হঠাৎ করে সঠিকতা নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে মাথাব্যথা, খিঁচুনী, গা ব্যথা, বমি বমি ভাব, গলা ব্যথা, ঘাড় ও পিঠ শক্ত হয়ে যাওয়া দেখা দিতে পারে। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তি প্রলাপ বকা শুরু করতে পারে। এ ধরনের রোগী আলো সহ্য করতে পারে না। কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতির অবনতি হলে হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া অথবা পক্ষাঘাত গ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অতীতে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির সংক্রমণ ঘটেছে। ফরিদপুর সংক্রমণের সময় (২০০৪ সনে) ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির সংক্রমন খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। রোগীর যতœ নেয়া চার ব্যক্তি মা, ছেলে, খালা, প্রতিবেশী চিহ্নিত রোগীর প্রথম অসুস্থতার ১৫-২৭ দিন পরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগীর আক্রান্ত খালাকে কাছাকাছি গ্রামের যে হুজুর প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছিলেন, তিনিও ১৩ দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। গ্রামের সেই হুজুরের অসুস্থতা গুরুত্বর আকার ধারণের পর তাঁর অনেক আত্মীয় এবং অনুসারীরা তাঁকে তার বাড়ীতে দেখতে যান। দর্শনার্থীদের মধ্যে কমপক্ষে ২২ জনের নিপাহ সংক্রমন হয়। ফরিদপুরের এ ঘটনা নিবীড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, একজন থেকে প্রায় ৩৪ জনের মধ্যে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমিত হয়। এদের অনেকে মারা যায়। এরকম পরিস্থিতিতে খেজুর রস থেকে দূরে থাকার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার ও যতেœর সঙ্গে যুক্ত সবাইকে মাস্ক পরা ও ব্যক্তিগত হাইজিন বজায় রাখা কোভিড-১৯ এর মত খবুই জরুরী। পরিবারের সবাই কোভিডকালীন সতর্কতা মেনে চলা প্রয়োজন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে মেলামেশা অনুচিত, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কোন বিকল্প নাই।
অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে জানা যায়, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত নারী সেরে উঠলে সে নারীর শরীরে নিপাহ বিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। সেই এন্টিবডি সংক্রমন পরবর্তী সন্তানদের দেহে সঞ্চারিত হয়। ফরিদপুর জেলায় ২০২০ এর জানুয়ারীতে পাঁচ বছরের কমবয়সী একটি মেয়ে এবং তার মা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হন। গুরুত্বর ¯œায়ুবিক জটিলতা নিয়ে মা বেঁচে গেলেও শিশুটি মারা যায়। বেঁচে যাওয়া মা ২০২১ এর নভেম্বরে ফের গর্ভধারন করেন। আগষ্ট’২০২২ এ ঐ মহিলার একটি সুস্থ পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। প্রসবের আগে থেকেই ঐ মাকে জাতীয় নিপাহ সার্ভিলেন্স কর্তৃপক্ষ নিবীড় তত্ত্ববধানে রেখেছিলেন। সংক্রমন থেকে সেরে উঠার বা ফলোআপের অংশ হিসাবে নবজাতকের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা করে শিশুর দেহের নিপাহ ভাইরাসের এন্টিবডি পাওয়া যায়।
এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোথাও নিপাহ ভাইরাস রোধকারী কোন টিকা নাই। আইসিডিডিআরবি, বাংলাদেশ সরকারের নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব, শনাক্তকরণ, রোগের সংক্রমনের ধরণ ও মারাত্মক সংক্রমনের বিরুদ্ধে থেরাপিউটিকস এবং ভেক্সিন তৈরিতে দীর্ঘতম নিপাহ ভাইরাস সার্ভিলেন্স পরিচালনা করছে। আশা করি যথাসম্ভব শীঘ্র এ উদ্যোগ নিপাহ ভাইরাস সংক্রমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও চিকিৎসার আলো দেখাতে পারবে, রক্ষা করতে পারবে মানুষের জীবন। তবে যত দিন যাচ্ছে তাতে সচেতনতা বৃদ্ধিই একমাত্র কাম্য। তাই খেজুরের কাঁচা রস, বাদুড়ে খাওয়া ফলমূল থেকে দূরে থাকতে হবে। ফলমূল ও শাক-সবজি পরিষ্কার পানি দিয়ে ধৌত করে খাবেন। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসার পর দুইহাত সাবান পানি দিয়ে ধৌত করে ফেলবেন। নিপাই ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে সাথে সাথে কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ