দেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ (ক) বলা আছে “রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।” অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ২১ মোতাবেক ‘জাতীয় সম্পত্তি’ রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। এসব সম্পত্তি সকলের এবং এসবের উপর প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার। এ অধিকার সুসম্পন্ন রাখার সাংবিধানিক দায়িত্ব পরে রাষ্ট্রের উপর। রাষ্ট্রীয়ভাবে নদ-নদী রক্ষার জন্য ‘জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন আইন ২০১৩’ পাশ করা হয়। এ আইন অনুযায়ী ২০১৪ সালে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’ গঠিত হয়। এ আইনের ১২নং ধারায় কমিশনের দায়িত্ব ও কার্যাবলী বিবৃত হয়েছে। নদীর সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় বা বিভাগের কার্যাবলীর মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যেঃ অবৈধ দখলমুক্ত এবং পূণর্দখল রোধ করার বিষয়ে; নদী ও নদীর তীরে স্থাপিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ সংক্রান্ত; নদীর পানি দূষণমুক্ত রাখা; বিলুপ্ত বা মৃতপ্রায় নদীখনন; পরিবেশগত ভারসাম্য ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ; খাল জলাশয় ও সমুদ্র উপকূল দখল ও দূষণমুক্ত রাখার বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ করা। ২০১৩ সালে দ্রুত আইনটি তৈরির কারণে কমিশনকে নদীর ‘আইনি অভিভাবক’ ঘোষণা করা হলেও কেবলমাত্র সরকারের পরামর্শ ও সুপারিশ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। নদী রক্ষায় প্রয়োগিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়ন ও নদী রক্ষার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে সংশোধনী জারি করার কথা থাকলেও আইন কমিশন ঠুনকো যুক্তি দেখিয়ে প্রয়োগিক ক্ষমতাটি নাকজ করে দেন। ফলে শক্তিশালী হয়ে উঠে দখলদারিত্ব।
চরাঞ্চলে জেগে উঠা জমি দখল করে নেয় প্রভাবশালীরা। নদীখননের নামে কেটে নেয়া হয় কৃষকের আবদি জমি, নদীর বালু ফেলে ধ্বংস করা হয় জমি। রংপুর অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যহীনতা ও পানিশুন্যতা ব্যাপকভাবে দুর্বিসহ অবস্থার সৃষ্টি করে চলছে। ভারতের গজলডোবায় ব্যারেজ নির্মান করে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা নদী শুকিয়ে নদীর চিহ্ন বিলুপ্ত প্রায়। তিস্তা বন্যাপ্রবন নদী হওয়ার কারণে বর্ষাকালে বাংলাদেশের এ অঞ্চল প্রবল বন্যার মুখে পড়ে। প্লাবন ভূমি অবৈধভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে। দুপাড় ভেঙ্গে গিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষের জীবন জীবিকা এক চরম অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাচ্ছে। বাগেরহাট, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরার কেন কয়েকটি উপজেলায় লবনাক্ততা ও জলাবদ্ধতায় পরিবেশ প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কুমিল্লায় গোমতি নদীর প্রবাহ শহরের বাহির দিয়ে সৃষ্টি করায় শহরের ভেতরের প্রায় ছয় কিলোমিটার পুরাতন গোমতী দখলে দূষণে পরিবেশকে বিপন্ন করে রেখেছে। দখলদারদের বাড়ীর সেনিটারি পাইপটি নদীর দিকে খুলে রেখেছে। নদীর পানি সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপযোগী। ৫০০ এর অধিক দখলদার জেলা প্রশাসন লিষ্ট তুলে ধরলেও তাদের উচ্ছেদের কোন প্রচেষ্টা নাই। বিপন্ন পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে সৃষ্ট এ হৃদটিকে পর্যটনমুখী করার দাবী শহরের সকল সচেতন নাগরিকের। হাওরে অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে হাওরের জীববৈচিত্র্য, হাওর অঞ্চলের নদীগুলো পাথর, বালু ও পানি জমে ভরাট হয়ে হারাচ্ছে নাব্যতা। ফলে অগ্রিম ও আকষ্মিক বন্যায় ভেসে যায় হাওর অঞ্চল। শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকার কারণে মৎস্য, জনজীবন, জীববৈচিত্র্য ও অর্থনীতির উপরে দেখা দিচ্ছে চরম সংকট। বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ কাজ গভীর নলকূপ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্স্থ পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঐ অঞ্চলের খালবিল নদী জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে। ভূমি, পানিসম্পদ ও নৌ পরিবহন এ তিন মন্ত্রনালয়ের ১৬টি সংস্থা ও দুটি ট্রাষ্টি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নদী ব্যবস্থাপনার প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে ও দায়িত্বহীনতার কারণে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছে না যা কমিশনের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। প্রকল্পের সমীক্ষায় নদী দখলকারী প্রায় ৩৮ হাজার ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। দখলদারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে ওই প্রকল্পের চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি বাতিল করা হয়। ফলে দখলদারদের দৌরাত্ম আরো বাড়তে থাকে। ২০১৯ সালে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনে সারাদেশে দখলদারের সংখ্যা পাওয়া যায় ৫৭ হাজার ৩৯০ জন। একই বছর দখলদারের সংখ্যা হয় আরো ৫ হাজার বেড়ে মোট দখলদারের সংখ্যা দাড়ায় ৬৩ হাজার ২৪৯। নদ-নদীর তীরে অবৈধভাবে শিল্প-কারখানা, ইটের ভাটা, বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানী বা অবৈধ স্থাপনা নির্মান করে, নদী বা খালের জায়গা ভরাট বা দখল করে অবিরাম দখলীপানা চলছে। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য, দুর্গন্ধযুক্ত পানি, তরল ও কঠিন শিল্প বর্জ্য, ময়লা আবর্জনা ও পলিথিন ফেলার কারণে নদীর পানি বিষাক্ত হয়। নদীতে অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা, কালভার্ট, ব্রীজ, পোল্ডার, স্লুইস গেইট ও বাঁধ নির্মানের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই খালবিল ও নদ-নদীর গতিপথ বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। প্রবাহমান নদীকে বদ্ধ জলাশয় দেখিয়ে ইজারা দেয়ায় নদী দখল করে নেয় প্রভাবশালী ইজরাদার। অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে কৃষকের কৃষি জমি বিলীন হয়ে যায়।
নদী রক্ষা ও নদীর জীবন্ত সত্ত্বা ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে ‘জাতীয় নদীরক্ষা আইন ২০১৩’ সংশোধন করে নদী ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের নিয়ে সক্ষমতা অর্জন ও সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়া প্রয়োজন। জীববৈচিত্র্য ও নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষার জন্য দূর্নীতিমুক্ত শক্তিশালী গণসংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নদীর সীমানা নির্ধারণ ও নদীর প্রবাহ ঠিক রেখে নীতিমালা অনুযায়ী নদী খনন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে টেকসই নতুন বাঁধ নির্মান, বাঁধের পাশ দিয়ে বনায়ন ও স্লুইস গেইট সচল রাখার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। উন্মুক্ত জলাশয়ে প্রকৃত মৎসজীবিদের মাছ ধরার অধিকার দিতে হবে। চিৎড়ি চাষের জন্য কৃষি জমিতে লবন পানি আটকের প্রবণতা, পরিবেশ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস বন্ধ করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চল উন্নয়নের জন্য ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ এর অনুরূপ বোর্ড গঠন প্রয়োজন। তিস্তা নদীর অববাহিকার কৃষি জমি, বসতি, জনজীবন রক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ প্রতিরোধে স্থায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। নদী দখল, দূষণ, নদী খননের নামে কৃষকের জমি কেটে নেয়া ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ