আমরা
আমাদের জীবদ্দশায় ইতিহাসের কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য পুনরাবৃত্তি দেখেছি।
ষাটের দশকের সূচনা থেকে সাম্রাজ্যবাদের মূল ভূখ- যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্রমে
ক্রমে পশ্চিম ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের
বিরুদ্ধে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী এবং শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ।
এখন আবার যেন নতুন আঙ্গিকে সেই একই দৃশ্য দেখতে শুরু করেছি। হ্যাঁ, আমি
ফিলিস্তিনের গাজায় সংঘটিত ইসরায়েলের অমানবিক আগ্রাসনের কথাই বলছি।
এ
আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স,
জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও শান্তিকামী সাধারণ মানুষ।
শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েল বাহিনীর অভিযুক্ত গণহত্যা রোধকল্পে সে দেশে পশ্চিমা
জোটের সব ধরনের অস্ত্র সরবরাহ ও বিনিয়োগ বন্ধ করার দাবিতে প্রতিরোধ
আন্দোলন জোরদার করছে শান্তিকামী পশ্চিমা জনগোষ্ঠী। তারা এখন অবিলম্বে
যুদ্ধবিরতি কার্যকর করে ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূখ- ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে
সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ছাত্র বিক্ষোভ ও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিভিয়েতনামের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল।
ষাটের
দশকের শুরু থেকেই সে দেশের শান্তিকামী মানুষ, বিশেষ করে কলেজ ও
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সংগঠিত হয়ে মাঠে নেমেছিল প্রতিবাদ জানাতে। তাদের
সঙ্গে যোগ দিয়েছিল গণতান্ত্রিক ও যুদ্ধবিরোধী প্রগতিশীল শক্তি। ১৯৫৫ সালে
শুরু হওয়া সেই যুদ্ধ প্রায় দুই দশক স্থায়ী হয়। যুদ্ধের শুরু থেকেই
যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ভিয়েতনামে অনেক বোমাবর্ষণ শুরু করে।
সেই সামরিক
আগ্রাসনে অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। তাতে নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষের
সংখ্যাই ছিল বেশি। সেই মর্মান্তিক ঘটনাপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিবাদী ও
কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন এবং
যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের সামরিক অভিযান ও হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক
আন্দোলন গড়ে তোলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত
লিংকন মেমোরিয়ালের পাদদেশে লক্ষাধিক শান্তিকামী ছাত্র ও সাধারণ মানুষের এক
ঐতিহাসিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। সমাবেশ শেষে প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ
পেন্টাগন সামরিক দপ্তর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিল।
তাতে হোয়াইট হাউস
প্রশাসন কেঁপে উঠেছিল এক অজানা আতঙ্কে। সেই আন্দোলন তখন সেখানেই থেমে
থাকেনি; নিউ ইয়র্ক থেকে শিকাগো এবং বোস্টন থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস পর্যন্ত
ছড়িয়ে পড়েছিল। সরকারের নির্দেশ অমান্য করে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে
যোগদানের পরিবর্তে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল অনেকে। শেষ পর্যন্ত
ভিয়েতনাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র
প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি খুব দ্রুতই তাদের
গণবিরোধী চরিত্র ও ইতিহাস ভুলে যায়। সে কারণেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের
গণতন্ত্রমনা ও শান্তিকামী মানুষের কথা ভুলে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন ও
নির্বিচার হত্যাকা-ে মদদ দিয়ে চলেছে। তারা একদিকে গাজায় যুদ্ধ থামাতে বলে,
অন্যদিকে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকারকে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য
দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। সে কারণে আবার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আত্মপ্রত্যয়ে
জেগে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ। তাদের সঙ্গে
যোগ দিয়েছেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। একমাত্র নিউ ইয়র্কের
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে হাজারখানেক
ছাত্র ও শিক্ষককে। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই তাঁবু খাটিয়ে এখন
পর্যন্ত অবস্থান করছে। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা ইহুদিবাদী আগ্রাসন, গাজায় অভিযুক্ত গণহত্যা এবং
সর্বোপরি মার্কিন সরকারের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে অবস্থান
নিয়েছে। এ অবস্থার অবসান না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের আন্দোলন থামাবে না বলে
শপথ নিয়েছে।
উল্লেখ্য যে এই চলমান আন্দোলনে ইহুদি ধর্মাবলম্বী মার্কিন
ছাত্র-ছাত্রীরাও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার আন্দোলন চালিয়ে
যাচ্ছে। তাতেও টনক নড়ছে না ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর। তবে তিনি
বুঝতে পারছেন যে তাঁর সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। তিনিসহ ইসরায়েলের তিনজন
নেতার (মন্ত্রী) বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি
করতে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর
প্রধান হামাস যোদ্ধাদের পরাজিত করতে ব্যর্থতার কারণে খুব শিগগির পদত্যাগ
করতে পারেন বলে আভাস দিয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর শক্তিমত্তা ও
শ্রেষ্ঠত্বের দাবি ও আস্ফাালন গাজার মতো এক চিলতে ভূখ-ের প্রতিরোধ
যোদ্ধাদের আক্রমণেই ধরাশায়ী হয়ে পড়েছে। ছয় মাসও তারা হামাস, হিজবুল্লাহ ও
হুতিদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়নি। এরই
মধ্যে প্রকাশ্যেই রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইরান। তারা এবার
পারতপক্ষে আর কোনো ছাড় দেবে বলে মনে হয় না।
এই সামগ্রিক পরিস্থিতির
মধ্যেও ইসরায়েল রাষ্ট্র ও তার সার্বিক অর্থনৈতিক এবং সামরিক অবস্থানকে আবার
সুসংগঠিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও অর্থনৈতিক
সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির
নেতা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, তাঁর দলীয় নেতৃবৃন্দ এবং এমনকি বিরোধী
রিপাবলিকান দলের নেতারা কোনো শিক্ষা নেননি। অর্থাৎ দেশের জনগণ ও সরকার
কিংবা বিরোধী দল সম্পুর্ণ দুই মেরুতে অবস্থান করছে। সে কারণেই ফিলিস্তিন
কিংবা তার প্রতিরোধযোদ্ধা, আরব নেতৃবৃন্দ কিংবা ইরান, দুই রাষ্ট্রের
ভিত্তিতে ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো ন্যায়সংগত বা ন্যায্য সমাধান দেখতে পাচ্ছে
না। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ব্যবস্থা কঠোরভাবে কার্যকর করার পরিবর্তে
নেতানিয়াহুকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সে কারণে
সংগতভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এটি কি শুধু যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী
সাড়ে ছয় মিলিয়ন ইহুদিকে খুশি করা এবং আসন্ন নির্বাচনে তাদের ভোট পাওয়ার
আশায়? অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সমানসংখ্যক আরব ও অনারব মুসলিমরাও
রয়েছে। তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছে যে দ্বিচারিতা এবং দ্বৈত চরিত্রের
অধিকারী জো বাইডেনকে আগামী নির্বাচনে তারা ভোট দেবে না। ওপরে উল্লেখিত এ
গ্রুপের নেতাকর্মীরা এই মুহূর্তে বাইডেনের বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় বিভিন্ন
প্রতিবাদ ও বাধার সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। এর মধ্যেও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং
গাজায় বুভুক্ষু মানুষের মধ্যে খাদ্য ও ত্রাণ বিতরণের বৃহত্তর স্বার্থে
তুরস্কের ইস্তাম্বুল, কাতারের দোহা এবং মিসরের কায়রোতে একের পর এক জরুরি
সভা ডাকা হচ্ছে। কিন্তু রাফায় নেতানিয়াহুর সম্ভাব্য হামলা, বন্দি বিনিময় ও
গাজাসহ ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জটাজালে আটকে যাচ্ছে সব কিছু,
প্রায় নদীর কূলে এসে বারবার ডুবে যাচ্ছে তরি।
বিরাজমান জটিলতার কারণে
অনেকে মনে করে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান মোটেও সহজ নয়। তা ছাড়া সেসব
জটিলতাকে কেন্দ্র করে নেতানিয়াহু চান ইরানের বিরুদ্ধে একটি পূর্ণমাত্রার
যুদ্ধ, যাতে যোগ দেবে যুক্তরাষ্ট্র। নতুবা ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব
সুনিশ্চিত হবে না। শেষ পর্যন্ত টিকবে না ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল।
ইহুদিবাদীরা মনে করে, সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যোগ না দিলে সেটি হবে তাদের
সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অতীতে স্বাক্ষরিত ‘অতি গোপন’ চুক্তির বরখেলাপ। কিন্তু
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন, পেন্টাগন ও তাদের ইন্টেলিজেন্স মনে করে, এ মুহূর্তে
কেউই একটি বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। তাতে ধ্বংস হয়ে যাবে বিশ্বের
অর্থনীতি ও সার্বিক বিশ্বব্যবস্থা। ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী
নেতানিয়াহু মনে করেন, তাতে তাঁর এবং ইহুদিবাদীদের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ
তাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা তরতাজা সুযোগ পাবে।
এ
অবস্থায়ও হামাসের সর্বোচ্চ কৌশলী নেতা বাসেম নাইম মনে করেন, ১৯৬৭-পূর্ব
সীমানা বা অঞ্চল নিয়ে এখনো একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব। এ
ক্ষেত্রে অর্থাৎ পূর্ব জেরুজালেমের আল-কুদসকে রাজধানী করে প্রস্তাবিত
রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের দেশে ফেরার অধিকার
দিতে হবে। তা ছাড়া হামাস যোদ্ধাদের নিয়মিত সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত
করতে হবে এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) ঘোষণাপত্রে
পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করতে হবে। তাতে সব কূল সীমিতভাবে হলেও রক্ষা করার
একটি প্রচেষ্টা দৃশ্যমান থাকবে। আর তা না হলে বাসেমের বিবেচনায় ভবিষ্যতে
ইসরায়েল নামে কোনো রাষ্ট্র থাকবে না। এ অঞ্চলে একমাত্র ফিলিস্তিনই হবে
একমাত্র ‘বিজয়ী রাষ্ট্র’ এবং মুসলমানদের উপাসনালয় বায়তুল মোকাদ্দাস তাদের
হাতে নিশ্চিতভাবেই আসবে। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক